Ads

বিজয়ের হাসি

রাজিয়া সুলতানা

চোখ বুজে ইজিচেয়ারে দুলছেন আজাদ সাহেব। মেয়ে দীপিকার ডাকে কিছুটা ঘোর কাটলো উনার। বাবা; ও বাবা আজ কত তারিখ মনে আছে তোমার? আজাদ সাহেব কিছু বলে ওঠার আগেই আবারও দীপিকা বলে উঠলো জানো বাবা আজকে এই একটা দিনের অপেক্ষায় অপার হয়ে বসে থাকি ৩৬৪ দিন। তোমার মুখের একপশলা হাসি দেখবো বলে। আজ ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ বাবা। তুমি যাবে না বাবা? তিনি সংক্ষিপ্তভাবে উত্তর দিলেন হুম। তাহলে আর দেরি করো না বাবা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও আমি বাগান থেকে ফুল তুলে নিয়ে আসি বলে বাগানের দিকে চলে গেল দীপিকা। আজাদ সাহেবের তবুও কোন সাড়া নেই। বাবাকে নিয়ে শহীদ মিনারে যাবে এমন সময়
–আম্মু, তুমি নানা ভাইকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছো।
–শহীদ মিনারে মামুনি।
–আমিও যাবো তোমাদের সাথে আমিও ফুল দোবো।
— দাঁড়া দীপিকা! আমিও তোদের সাথে যাবো শ্রদ্ধা জানাতে তাছাড়া তোর বাবার ঔ এক উজ্জ্বল, সতেজ, প্রাণবন্ত শুভ সকালের হাসি দেখার জন্য আমিও কম অপেক্ষায় থাকি না। কি যে হয়েছে তোর বাবার এতো বছর ধরে ও তা বুঝে উঠতে পারিনি।
শীতের আমেজ বেশ ভালোই পড়েছে মনে হচ্ছে। ফুরফুরে উত্তরের হাওয়া বইছে। সকালের মিষ্টি রৌদ্দুরে পায়ে হেঁটে শহীদ মিনারে যাবার আনন্দটায় বেশ আলাদা। ভেতরে কেমন যেন গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে। সম্মান জানানোর সময় বাবা হু হু করে কেঁদে উঠলো আর তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরলো। কিছুক্ষণ মাথা নুইয়ে বসে থেকে আবারো অনেক জোরে জোরে হেসে উঠলেন। এই হাসি মোটেও স্বাভাবিক ছিল না তা লোকজনের মুখের পানে চেয়ে বোঝা যাচ্ছে। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নবীনদের মাঝে যারা প্রথম এবার শহীদ মিনারে সম্মান জানাতে এসেছেন তবে প্রবীণেরা মোটেও অবাক নন কারন এটা নতুন নয় প্রতি বছর ঘটে এই দিনে। বাবার এমন বিশাল আকুলতা আমরাও দেখি বছরে মাত্র একটি বার। জানিনা এর কি কারণ। আমার জন্ম থেকে আজ অব্দি এই দিন ছাড়া অন্য কোন দিন তাকে হাসতে বা কাঁদতে দেখি নাই। কারো সাথে মন খুলে কথাও বলেন না। কেমন যেন পৃথিবীটা থমকে গেছে তার। বাবা সম্পর্কে জানা বলতে শুনেছিলাম যুদ্ধের সময় আমি নাকি গর্ভে ছিলাম মায়ের। তখন অব্দি জন্ম হয়েছিল না আমার। একদিন বাবা মাকে লাল শাড়ির পাশাপাশি সাদা শাড়ি কাছে রাখতে বলেছিলেন যদি তিনি আর বেঁচে ফিরতে না পারেন। মা তো সবসময় লাল শাড়ি পরা পছন্দ করতেন। মা প্রথমে ভয় পেয়েছিলেন, কিছুটা বাধা দিয়েছিলেন পরে ভাবলেন যাক, যাক না মায়ের জন্যই তো যুদ্ধ করবে। স্বাধীন করবে পরাধীনতার শিকল থেকে। মুক্ত করবে দেশ মাতৃকে। মনে সাহস যুগিয়েছিলেন সেদিন।
বাবা ফিরে এসেছিলেন কিন্তু ফিরে আসেনি তার দুটি চোখ ও একটি পা। হানাদার বাহিনী চোখদুটো নষ্ট করে দিয়েছিল বাবার। পায়ের গুলিটা বের করা গেলেও সুচিকিৎসার অভাবে সেখানে পঁচন ধরে আস্তে আস্তে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় একটি পা শরীরের সাথে আর রাখা সম্ভব হলো না।
সেই থেকেই বাবা এমন। অনেকবার ডাক্তার দেখিয়েছিলাম, তিনি বলেন, এ রোগ ওনার শরীরের নয় এ রোগ ওনার মনের। আপনারা ওনাকে যতটা সম্ভব আনন্দে রাখার চেষ্টা করুন দেখবেন আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বাবার কাছে কোন আওয়াজ ই করা যায় না না আনন্দের না কষ্টের। উনি ভীষণ রেগে যান। মনে করেন বেঁচে থেকেও মৃত। তার জীবনে কোন আলো নেই। জীবন থেকে তার সবকিছু চলে গেছে যেদিন তার চোখদুটো অন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার বছরে এই একটা দিনের হাসি কান্না এখনো সবার কাছে অজানা। সুপ্তাকে ঘুমিয়ে দিতে গিয়ে কখন যে নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা জানা ছিল না। ঘুম ভেঙ্গে দেখি ভোর হয়ে গেছে। কেমন যেন থমকে আছে আজকের আকাশ। নিস্তব্ধ চারিদিক। পাখিদের মিষ্টি কিচির – মিচির ও শোনা যাচ্ছে না আজ ভোরে। গাছের পাতাদের ও বুঝি অভিমানে বুক ভরে আছে। লুকোচুরি খেলছে আজ একে অন্যের সাথে। সুপ্তার ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে দেখি লাল টুকটুকে দোপাটের ফ্রক পড়ে লাল কম্বলের মাঝে লেপটে চুপসে ঘুমাচ্ছে। কি! অপরূপ স্নিন্ধ সৌন্দর্য। চরম উপভোগ্য।
এই নিষ্পাপ শিশুটির মনেও হাজারো প্রশ্ন তার নানা ভাইকে নিয়ে। নানা ভাই কেন আমার সাথে খেলা করে না? কেন আমাকে গল্প শোনায় না, ঘুম পাড়িয়ে দেয় না, কেন নানা ভাই আমাকে ঘুরতে নিয়ে যায় না। আমি কিছুই তাকে বোঝাতে পারি না শুধু নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকি তার প্রশ্নবিদ্ধ বদনের পানে। একদিন তো সুপ্তার কি কান্না। সে কান্না দু ঘন্টাতেও সামাল দিতে পারিনাই কেউ। সুপ্তা দেখেছে তার এক বন্ধু নানা ভাইয়ের সাথে মার্কেটে গিয়ে অনেক শপিং করেছে লাল জুতো ও একটা গাড়ী কিনেছে তার বায়না তার নানা ভাইকেও সাথে নিয়ে শপিং এ যাবে কিন্তু সে ভাগ্য কি তার। বাবাকে ডেকে ডেকে ড়োরটায় খুললো না। সুপ্তা বাবার দরজার কাছে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমের কোলে ঢোলে পড়লো তবুও বাবা দরজায় খুললো না।
হঠাৎ এক কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, কে? কে কাঁদছে এত ভোরে। উঠে দেখি তো একবার ভেবে ঘুমন্ত পরী সুপ্তার পাশ থেকে উঠে করিডোরে গেলাম। এক পা দু’পা করতে করতে দেখি মা..আ এতো মায়ের কন্ঠ। তাহলে মাই কাঁদছে নাকি ভেবে দৌড়ে গেলাম মায়ের ঘরে। হুম সত্যিই তো এতো মাই কাঁদছে জায়নামাজে বসে অঝোরে কেঁদেই যাচ্ছে। মায়ের রুম আলাদা, বাবা মাকে আলাদা রুম করে দিয়েছে অনেক দিন আগে। মা বাবাকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতো নানা সময় তাই বিরক্ত হয়ে নিজের রুম আলাদা করে নিয়েছেন। মায়ের প্রশ্নই বা আর কি কেন তিনি সবার কাছ থেকে নিজেকে দূরে রাখেন। মা —মা কি হয়েছে তোমার? কেন কাঁদছো? বাবা কি তোমাকে কিছু বলেছে? কিছু বললে সে তো হতোই … এটাই তো আমার কষ্ট রে..। কোনদিন একটা কথাও বলেনা, খাবার না দিয়ে আসলে না খেয়ে থাকবে তো একবার ডাকবেনা কাউকে। কিভাবে চলি আমি এই মানুষটার সাথে। এত বছর ধরে মনকে অনেক বুঝিয়েছি আর যে পারছি না রে কান্নার সুরে বলে গেলেন মা কথাগুলো। কি পাপ করেছি আমি তার শাস্তি বিধাতা দিচ্ছেন আমায়। তারচেয়ে আমাকে উঠিয়ে নাও খোদা উঠিয়ে নাও। মায়ের কান্নার শব্দে সুপ্তার ঘুমও ভেঙ্গে গেল। উঠে এলো মায়ের ঘরে। নানুর কান্না দেখে সেও কান্না করতে লাগলো। আমার প্রচন্ড রাগ হলো বাবার উপর। খুব জানতে ইচ্ছে করছিল কী কারণ কেনই এতো কষ্ট দিচ্ছেন আমাদের সেভাবে কখনো কটাক্ষ করে প্রশ্নবিদ্ধ করিনি বাবাকে তবে ভাবলাম আজ করবো। মায়ের কান্না সইতে পারছিনা আমি। মা কান্না করতে করতে বলেই যাচ্ছে তার যুদ্ধের সময়ে ধৈর্যের কাহিনী। বাবার ঘর থেকে অবশ্য সবই শোনা যায় তবুও তিনি হয়তো না শোনার ভান করে আছেন। আজ আর দেরী করলাম না। রাগে ক্ষোভে বাবার দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দরজা ধাক্কা দেবো এমন সময় ভেতর থেকে দরজা খুলে গেল। বাবা বেরিয়ে এলেন আমরা অবাক হয়ে গেলাম। ভাবলাম কোন অনুভূতির উদয় হলো বুঝি। বাবা সুপ্তাকে কাছে ডাকলেন, সুপ্তা ভয়ে ভয়ে এক পা দু পা করে কাছে এগিয়ে গেল। কাছে যেতেই তাকে জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে কাঁদতে লাগল বাবা। বাবার কান্না দেখে মাও অবাক হয়ে দেখতে লাগলো কান্না থামিয়ে। বলবো সব বলবো আজ তোদের সব খুলে বলবো। আমি আর পারছিনা হাফিয়ে উঠেছি আমি।
আমাদের গ্রামটা যশোরের এক কোনে তবুও মানলো না হানাদার বাহিনী ঝাপিয়ে পড়লো গ্রামের উপর। আমরা যুবকেরা পরিকল্পিত ছিলাম। গোপনে প্রশিক্ষণ নিতাম দেশমাতৃকে স্বাধীন করবো বলে। একদিন যদি বেঁচে থাকি তবে স্বাধীন মাতৃভূমিতে বাঁচবো এটাই আমাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। তাই তোর মাকে সাদা শাড়ি কাছে রাখতে বলেছিলাম। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই দুচোখে কতো কি দেখেছি যা আজও ভুলতে পারিনা। আমার সহ যোদ্ধা আকবর তার দুই হাত- দুই পা শরীর থেকে আলাদা করে দিয়েছিল জয় বাংলা বলার কারণে তবুও সে মাথা নোয়ায়নি পশুদের কাছে। কত জনকে জবাই করেছে, গুলি করেছে লাশের উপর দিয়ে যেতে হয়েছে আমাদের। পাঁচ দিন বন্দি রেখেছিল একফোঁটা পানিও খেতে দেয়নি আমাদের। এগুলো ভোলার নয় দীপিকা এগুলো ভোলার নয়। শাহেদের স্ত্রীকে আমাদের সামনে লাঞ্ছিত করেছে বাধা দেওয়াতে আমার দুই চোখে চাকু বসিয়ে অন্ধ করে দেয় আর হাসি ফাটিয়ে হানাদার বাহিনী বলে দেখবি না যখন চোখ অন্ধ করে থাক। এই চোখ নিয়েই কোন রকমে পালিয়ে আসি তবে যুদ্ধ ছেড়ে নয়। চোখ বেঁধেই যুদ্ধ শেষ করেছি মনের চোখ দিয়ে আর হাতের নিশানা ঠিক রেখে কিন্তু শেষ সময়ে ওরা পায়ে গুলি করে দেয়। গুলিবিদ্ধ পা নিয়ে অন্ধ চোখে আর কতদূরই বা যেতে পারি ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে ছিলাম। তারপরে শেষ পর্যন্ত পা টাকে বাদ দিতেই হলো। তাই নিজেকে বোঝা মনে হতো বারবার। তোদের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হতো কোনো ক্ষমতায় নেই আমার তাই লুকিয়ে রাখতাম নিজেকে। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর আসলে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারতাম না। শহীদ মিনারে ছুটতাম সহযোদ্ধাদের টানে। হারিয়ে যেতাম সেই দিনে। তাদের আর্তনাদের কথা মনে হয় আর তখন কান্নায় ভেঙে পড়ি তৎক্ষনাৎ আবার মনে পড়ে আমাদের রক্তক্ষয়ী জয়ের কথা। তখনই বিজয়ের হাসি ফুটে উঠে মনে। আমরা হারিনি। হারিনি। নাইবা থাকলো দু ‘চোখ, পা তবুও আমরা জয়ী। কেন আমি বন্ধ ঘরে লুকিয়ে থাকবো আমি হাসবো, হাসবো বার বার বিজয়ের হাসি।

লেখকঃ কবি ও সাহিত্যিক

আরও পড়ুন