Ads

ম গল্প: ভটকা বিড়ি

নুরে আলম মুকতা

কিছু গল্প থেকেই যায় মনে হয় জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্টে । এ গল্পগুলো কয়েক প্রজন্ম তো চলে মনে হয়। গল্পগুলো চালিয়ে নেয়ার জন্য অলীক কোন কল্পনার প্রয়োজন হয় না। যাপিত জীবনের সাথে সাথে চলতে থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আমরা আমাদের প্রজন্মদের পূর্বপুরুষ কিংবা তাঁদের সাথে যুক্ত মানুষ অথবা এমনও হতে পারে কোন প্রাণীর গল্প শুনিয়ে মজা পাই। বিষাদে হৃদয় ভারাক্রান্ত হতে পারে। নানা নানী আর দাদাদাদীর গল্প তো চলতেই আছে। আমার এক দাদার সাথে আমরা প্রায়ই মজায় মেতে উঠতাম। কি যে নির্মল আনন্দ ছিলো তা প্রকাশ করা মুশকিল। জমি জমাতে কাজ করতেন সারাদিন। সন্ধ্যাবেলা দাদার অবসর। কি সব অদ্ভুত গল্প করতেন। আমরা হা করে  ভটকা বিড়ি দাদার গল্প গিলতাম। এর মধ্যে সবচেয়ে সিরিয়াস গল্পগুলো ছিলো, বুনো দাঁতাল শুয়োর তাড়ানোর গল্প, বাঘের গোরু ধরার গল্প আর ভালুকের সাথে দাদারা কি রকম করে ধানের জমিতে মারামারি করে  কাঁদায় লুটোপুটি করে বেঁচেছিলেন সে কাহিনি । তখন আমাদের কাছে দাদার বাচন ভঙ্গি আর গল্পগুলোর বর্ননার আকাশ ছোঁয়া গ্রহনযোগ্যতা ছিলো। দাদার সাথে আমরা কখনও কখনও নির্মম তামাশা করতাম। যেমন দাদার পানবাটা বা বিড়ির প্যাকেট লুকিয়ে দিতাম। উনি আর খুঁজে পাচ্ছেন না। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। জমিতে যেতে হবে।

আমাদের ভয় ছিলো আম্মার কাছে অভিযোগ করলে মার খাওয়া ছাড়া গতি নেই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো দাদা সহজে অভিযোগ করতেন না। এত কাছের, এত নিজের স্বজন! এখন আর নেই। রক্তের সম্পর্কের না। তার পরেও কতো নিজের। গল্প তো এখনো চলছে। শেষ জীবনে দাদা আর ভালো চলতে ফিরতে পারতেন না। আমাদের এলাকায় আম বাগান পাহারা দেয়ার জন্য মৌসুমি পাহারাদার নিয়োগ দেয়া হয় এখনও। এদের স্থানীয়ভাবে বাগান যোগানদার বলে। দাদা প্রতি বছরই বাগান যোগানের কাজ পেতেন। এ কাজ পাবার কারণটি আমরা জানতাম না। আব্বা একদিন বলেছিলেন, তোমাদের কালু দাদা অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত ব্রিটিশ আর্মীর সদস্য ছিলেন। আমরা তো আকাশ থেকে পড়লাম !  তৎক্ষনাৎ দাদাকে রাগানো শুরু করে দিয়েছিলাম, তুমি কতো বাঙ্গালি পিটিয়েছো বলো, ইলা মিত্রের ওপর কতো অত্যাচার করেছো ? ভটকা বিড়ি  দাদা নিশ্চুপ থাকতেন। এসব বিষয়ে কথা বলতেন না। দাদা একশিরা আর হার্নিয়া রোগে মারাত্মক আক্রান্ত ছিলেন।

কালু দাদা অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত ব্রিটিশ আর্মীর সদস্য ছিলেন। আমরা তো আকাশ থেকে পড়লাম !  তৎক্ষনাৎ দাদাকে রাগানো শুরু করে দিয়েছিলাম, তুমি কতো বাঙ্গালি পিটিয়েছো বলো, ইলা মিত্রের ওপর কতো অত্যাচার করেছো ? দাদা নিশ্চুপ থাকতেন। এসব বিষয়ে কথা বলতেন না। দাদা একশিরা আর হার্নিয়া রোগে মারাত্মক আক্রান্ত ছিলেন।

এজন্য হাঁটতে অসুবিধে হতো। শরীর টেনে টেনে চলতেন। রাতে বাগান পাহারা দিয়ে দিনে ছেলের পানবিড়ি দোকানে বসতেন। গভীর রাত হলে ছেলের দোকান ঝাঁড়ু দিয়ে আবার আম বাগানে চলে যেতেন। কোন কোন দিন আম্মার কাছে রাতের খানা খেতেন। চাইতেন না। আমরা পড়তে বসলে লন্ঠন হাতে করে এসে চুপ করে আমাদের পাশে বসতেন। আম্মা একসময় খানা এগিয়ে দিতেন। কোন কোন দিন আমরা মাছের টুকরাটি লুকিয়ে দিলে দাদা ওটা ছাড়াই ভাত শেষ করে উঠে যেতেন। এখন মনে হলে অনুতপ্ত হই। উনি এলে আমরা শান্তি অনুভব করতাম এটি মনে করে যে, আব্বা-আম্মা দাদার উপস্থিতিতে আমাদের পেটাতে পারবেন না।ভটকা বিড়ি দাদার শরীরে ছিলো অসীম শক্তি। বুকে ছিলো এক সমুদ্র ভালোবাসা। বুড়িকে হারিয়েছিলেন বহু আগে কিন্তু দ্বিতীয় দ্বার আর পরিগ্রহ করেন নি। অনেকগুলো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে মায়ের মতো করে বড় করেছিলেন। এখন বুঝি সেনাজীবনের নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা জীবনে কিভাবে ওই অর্ধ শিক্ষিত মানুষটি কাজে লাগিয়েছিলেন।

রোজা শেষে ঈদের বেচাকেনা করতে দাদার ছেলের দোকান লাগাতে একদিন বেশ বিলম্ব হয়ে গিয়েছিলো। গভীর রাতে দাদা ছেলের দোকান ঝাড়ু দিয়ে বাগান চলে গিয়েছিলেন। দাদার মাচা টি ছিলো একটি গভীর পুকুরের একদম পাশে। ছেলের বৌ সেদিন খানা দেয়নি। এজন্য কিছু চিড়া ভিজিয়ে গুড় দিয়ে খেয়ে মাচায় শুয়ে মুখে বিড়ি গুঁজেছিলেন আয়েশ করে। ছেলের দোকান ঝাড়ু দেয়ার সময় কুড়িয়ে পাওয়া বিড়ি । কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস। দড়াম করে ফুটে যায় দাদার ঠোঁটে মরিচ ভটকা। আতশ বাজির এ নির্মম জ্বালায় আর আতঙ্কে দাদা পড়ে যান গভীর পুকুরে । পানিতে পড়ে যাওয়াটাই মনে হয় ভালো হয়েছিলো। দু ঠোঁটেরই বেশ কিছু অংশ উড়ে গিয়েছিলো। বিস্ময়কর বিষয়,দাদাকে পুকুর থেকে উঠে আসতে সাহায্য করেছিলো এক মহৎ প্রাণ যুবতি! দাদা এ বিষয়ে কোনদিন মুখ খোলেন নি। আমরা জানতে পারিনি কে ঐ যুবতি ? এলাকায় দাদার নাম হয়ে গেলো ভটকা বিড়ি। ক্ষেপতেনও খুব। আমরা বলতাম দাদা তুমি আসলেই বীর! মানুষ আতশবাজিতে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় আর তুমি কিনা মুখে ফোটাও!

লেখক: কবি,অনুবাদক ও সহ-সম্পাদক,মহীয়সী।

ভটকা বিড়ি গল্পের লেখকের প্রকাশিত আরও লেখা –

সন্তানদের বন্ধু বানাবেন যেভাবে (পর্ব-১)

আরও পড়ুন