Ads

সন্তান

সুস্মিতা মিলি

গাড়িটা একবারে কবরস্থানের সামনে এসে থামলো। পারিবারিক কবরস্থানটা শহর থেকে বেশ দূরে। ছায়া সুনিবিড় এক গাঁয়ে।
আড়াই বছরের ছেলে মায়ানকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে গাড়ি থেকে নামলো নাবিলা চৌধুরী পাশে তার স্বামী শোভন চৌধুরী।
তিনজনে আস্তে আস্তে কবরস্থানের একেবারে শেষদিকে গিয়ে দাড়ালো। পাশাপাশি দুটো কবর এখানে একটা বড় কবর আরেকটা ছোট। দুটো কবর একটা দেয়াল দিয়ে ঘের দেয়া। নাবিলার চোখে পানি। ছোট মায়ান মায়ের কান্নার কারন বুঝতে না পেরে কাঁদতে লাগলো। শোভন ছেলেকে সামলাতে লাগলো। নাবিলা বেশ কিছুক্ষণ বড় কবরটার পাশের দেয়ালটাতে ছুৃঁয়ে থাকলো। তারপর ছোট কবরের দেয়ালের গায়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো পরম ভালোবাসায়। এই ছোট কবরটাতে তার অদেখা বাবুটা শুয়ে আছে,আর বড় কবরটাতে আছে মায়ানের অদেখা মা শাহিদা যাকে নাবিলাও দেখেনি কখনো। ছেলেকে বুকে নিয়ে সে ভাবতে থাকে কোন কিছুই হারিয়ে যায় না, সবকিছু আবার ফিরে আসে নতুন রূপে। কবরস্থান থেকে ফিরে আসার সময় নাবিলা চলে গেলো আড়াই বছর আগের সেই দিনগুলোতে।

সেদিন নাবিলার শরীরটা একটু খারাপ লাগছিলো। সন্ধ্যার পর থেকেই কেমন যেন বমি বমি লাগছিলো। নাবিলা তাই অসময়ে একটু গোছল করে নিলো। ভেবেছিলো গোছল করলে শরীরটা ভালো লাগবে। নাহ্! একদম ভালো লাগছে না।
নাবিলার তখন আটমাস চলছে। শরীরটাও বেশ ভারি। একটা এন্টাসিড প্লাস মুখে দিয়ে মুখটা বিকৃত করে বসে আছে সে। এই জিনিসটাকে সে একদম পছন্দ করে না।

সেদিন বাসা ভর্তি ছিলো মেহমানে। শাশুড়ি আর শোভন নতুন অতিথির আগমন উপলক্ষে বিশাল পার্টি দিয়েছিলো। নাবিলার বাবার বাড়ী শ্বশুরবাড়ীর আত্মীয়স্বজন মিলিয়ে প্রচুর মেহমান এসেছিলো সেদিন। সবাই নানা রকম উপহার নিয়ে এসেছিলো।
সেদিন সবার হাতে অল্প অল্প এটাসেটা খেতে গিয়ে নাবিলার নাভিশ্বাস উঠে গেছে। তাইতো গ্যাস হয়ে খুব অশান্তি লাগছে। দুদিন হলো নাবিলা অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে,। ভেবেছিলো বেবি হওয়ার আগেই কয়টা দিন একটু রেস্ট নিয়ে নেবে।
নাবিলা এই বাড়ীর অতি আদরের বৌ। শোভনের দুজন ছোট বোন আছে। ওরাও ভাবিকে অনেক ভালোবাসে। এই আট মাসের প্রতিটা মুহূর্ত নাবিলার কাছে স্মরণীয়। সবাই অধীর আগ্রহে সেই দিনটার জন্য অপেক্ষা করছে যেদিন ছোট একটা বাবু এই বাসায় আসবে। হাসবে খেলবে।
শুভর বাবার অনেক ধরনের ব্যাবসা, লেখাপড়া শেষ করে শোভন তার বাবার সাথেই ব্যাবসা করে। আর নাবিলা বিয়ের আগে থেকেই একটা প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করতো।
রাতে কিছুতেই নাবিলার ঘুম আসছিলো না। সারাদিনের পরিশ্রমে শাশুড়ি সহ পরিবারের সবাই একটু আগে আগেই ঘুমিয়ে গেছে। শোভনও পাশেই অকাতরে ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ নাবিলার মনে হলো একটু ঠাণ্ডা স্প্রাইট খেলে মনে হয় ভালো লাগবে। ডুপ্লেক্স বাসার নিচতলায় ডাইনিং।
নাবিলা শোভনকে ডাক না দিয়ে নিজেই চললো। সিঁড়িতে মনে হয় কেক পরেছিলো। ভালো করে মুছা হয়নি। প্রথম ধাপে পা দিয়েই পিছলে গেলো পা, ধরার কোন অবলম্বন না পেয়ে গড়াতে গড়াতে একদম নিচে। প্রচণ্ড শব্দে সবাই এসে নাবিলাকে রক্তের নদীতে অজ্ঞান অবস্থায় পেলো। সাথে সাথেই হাসপাতালে নিয়ে গেলো।

ঠিক ঐ সময়ে নাবিলার মতই অধীর আগ্রহে মা হওয়ার অপেক্ষা করছিলো শাহিদা। পিতৃহীন শাহিদা একটা গার্মেন্টসে চাকরি করতো। স্বামী জহিরুল ঢাকা শহরে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করে। এক বস্তিতেই বসবাস করার কারনে দুজনের মাঝে প্রেম হয়ে যায়। তারপর বিয়ে করে গড়ে তুলে সুখের সংসার। বাচ্চা পেটে আসার পরই শাহিদা চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। দু’চোখে সারাক্ষণ স্বপ্ন বুনে চলে অনাগত সন্তানকে নিয়ে। তার খুব ইচ্ছা একটা ছেলের মা হওয়ার। জহিরুলকে সে সবসময় বলে
——তোমার মতো একটা পোলা চাই আমার। যে তার মায়ের পাশাপাশি বৌরেও প্রাণভইরা ভালোবাসবো।
—-আমার তোর মতন ভালো একটা মাইয়া দরকার। জহিরুল বলে। তবে পোলা মাইয়া যাই হোক লেহাপড়া করায়া অফিসার বানামু।

—–আমার পোলা হইলে তোমার ইহানের ইঞ্জিনিয়ার স্যারের মতন ইঞ্জিনিয়ার বানামু,বাপ রাজমিস্ত্রি আর পোলা বিল্ডিং এর ইঞ্জিনিয়ার হি হি হি হাসতে হাসতে শাহিদা বলে। আর সেই হাসি মুগ্ধ হয়ে দেখে জহিরুল।

—-আমার বাচ্চা যহন অইব তহন তুমি কাছে থাকবা। আমডা দুইজনে একলগে ওরে দেহুম। খবরদার তুমি কিন্তু একলা একলা পোলারে দেকবানা।শাহিদা আবেগ নিয়ে বলে।
——আচ্ছা যা তোরে ছাড়া আমি বাচ্চার মুকটা একলা দেহুম না, তরলাইগা বইয়া তাহুম। এরফরে একলগে চানমুক দেহুম।
জহিরুল বুঝতে পারেনা, শাহিদার মধ্যে এমন কি আছে যে তাকে ছেড়ে কিছুক্ষণ থাকলেই বুকের ভেতরটা কেমন হুহু করে উঠে।
ইদানিং শাহিদা খুব দুঃস্বপ্ন দেখে। যেদিন খারাপ স্বপ্ন দেখে সেদিন শাহিদার মনটা খুব খারাপ থাকে। জহিরুলও একদিন শাহিদাকে নিয়ে খারাপ স্বপ্ন দেখলো তাই তার মনটাও খুব খারাপ।

শাহিদার নয়মাস শেষ হয়ে গেছে। ডাক্তার আপার দেওয়া ডেট পার হইয়া গেছে চারদিন আগেই। শাহিদার ইচ্ছা ডাক্তার আপার কাছে যাবে। কেন তার বাচ্চা হতে দেড়ি হচ্ছে,কোন সমস্যা নেইতো বাবুটার!কিন্ত শাশুড়ি বললেন,
—- অত উতলা হইলে চলব? কোনদিন শুনছিস পেটের বাচ্চা পেটে থাকতে! সময় অইলে আপনাআপনিই বাচ্চা হইব।
কিন্তু শাহিদার সময় কাটেনা। তাই রাতেই জহিরুলকে বললো আগামীকাল যে ভাবেই হোক ডাক্তার আপার কাছে যাবে। জহিরুল বললো দুপুরে খেয়ে শাহিদা যেন জহিরুলের কাজের জায়গায় চলে যায়, সে ছুটি নিয়ে শাহিদাকে ডাক্তার দেখাবে। পরদিন বিকালে কথানুযায়ী শাহিদা চলে গেলো জহিরুলের কাজের জায়গায়। বিরাট নির্মাণাধীন বিল্ডিং। জহিরুল শাহিদাকে দেখে ওপর থেকে দ্রুত নামতে থাকে।
শাহিদা অবাক হয়ে দেখে আর ভাবে মানুষের কাছে কত টাকা থাকলে এমন একটা বিল্ডিং বানাতে পারে।পরক্ষণেই মনে মনে দোয়া করে সে নিজে বিল্ডিংয়ে না থাকলেও তার সন্তান যেন এমন বড় একটা বিল্ডিংয়ে থাকতে পারে।
হঠাৎ উপর থেকে একটা অর্ধেক ভাঙা ইট এসে শাহিদার মাথায় পরে, তাৎক্ষণিক শাহিদা জ্ঞান হারিয়ে সেখানে পরে যায়। হতভম্ব জহিরুল এসে দেখে শাহিদার মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত পরছে। কয়েকজন দৌড়ে এসেছে। সবাই মিলে ধরাধরি করে একটা সিএনজিতে তুলে কাছেই একটা বড় বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলো।

না শাহিদার জ্ঞান আর ফেরেনি। ডাক্তারদের সকল প্রচেষ্টা,আর জহিরুলের দোয়া ব্যার্থ করে তিনদিন পর সে পরপারে পারি জমায়। কিন্তু ডাক্তারের আন্তরিক প্রচেষ্টাতে শাহিদার পেটের বাচ্চাটা বেঁচে যায়।
এদিকে একই হাসপাতেলে দুদিন ধরে নাবিলা চিকিৎসাধীন। নাবিলাকে বাঁচানো গেলেও তার পেটের বাচ্চাকে অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি। ওর একটা ছেলে হয়েছিলো। জন্মের পরদিন ছেলেটা মারা যায়।
নাবিলাকে বাচ্চার মৃত্যুর কথা না বলা হলেও সে বার বার বাচ্চার কথা বলে চিৎকার করে জ্ঞান হারাচ্ছিলো। তার প্রেশারও খুব হাই। সকলের খুব দিশেহারা অবস্থা।
এমন সময় নাবিলার শাশুড়ি জহিরুলকে দেখে। তিনি দেখতে পেলেন এক গরীব লোক তার স্ত্রীকে হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে ছুটাছুটি করছে। হাসপাতাল থেকে স্ত্রীর লাশ নিলেও বাচ্চাটাকে সে নিতে চায়না, এমনকি বাচ্চাটার চেহারাও দেখবে না সে।
তিনি দ্রুত কথাটা শোভনকে কথাটা জানালেন। বললেন নাবিলাকে বাঁচাতে হলে এখন একটা বাচ্চার খুব প্রয়োজন।
ওরা জহিরুলের বাচ্চাটাকে নিতে চাইলে জহিরুল বিনা দ্বিধায় বাচ্চাটাকে ওদেরকে দিয়ে দিলো।
ফুটফুটে ছেলে হয়েছে শাহিদার। কথাছিলো দুজনে একসাথে সন্তানের মুখ দেখবে।
শাহিদা তার ছেলেকে দেখেনি তাই জহিরুলও তাকে দেখবেনা। একটা তোয়ালেতে জড়িয়ে শাশুড়ি যখন মায়ানকে নাবিলার কোলে দিলো, নাবিলা ওকে বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।
এদিকে শোভন তার বাচ্চাকে নিয়ে চললো জহিরুলের সাথে তার গ্রামে। সেখানে শাহিদার পাশেই তার বাবুটাকে শুইয়ে দিয়ে এলো, যেন পরপারেও সে মায়ের বুকের উষ্ণতায় থাকে,,,।

সুস্মিতা মিলি – সাহিত্যিক।

আরও পড়ুন