স্থুলকায়
সুমেরা জামান
আমি মাঝে মাঝেই খালাকে বলতাম, আপনার কিন্তু বিয়েটা করে ফেলা দরকার।
খালা বলতো নারে, আমাকে দেখে তোর মনে হয় আমার আর বিয়ে করার বয়স আছে? আর কে বিয়ে করতে আসবে আমার মত এমন স্থুলকায় মহিলাকে।
তবু বলতাম। না খালা। কত মোটা মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না! নানা তো সেই কবে মারা গেছেন। নানীও একদিন চলে যাবে। কি নিয়ে বেঁচে থাকবেন! একা হয়ে যাবেন। একসময় জীবনটাকে অর্থহীন মনে হবে।
খালা এক গাল হেসে বলতো,” কেন এমন মনে হবে! আমার দুই ভাইয়ের মেয়েদের কে নিয়ে আমার দিব্যি দিন চলে যাবে। ওদের স্কুলে নিয়ে যাব, সাঁতার, গান, নাচের ক্লাস! কতকাজ আছে। জানিস, আমি ঠিক করেছি আমার যত গহনা আছে সব মিতু আর নিতুকে দিয়ে দিব। ওদের বিয়ের সময়।”
তারপর ওদের বিয়ে হয়ে গেলে আপনি আবার একা খালা! এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে বিয়েতে মত দিন প্লিজ।
মায়ের কাছে শুনেছি, খুব সুন্দরী আমার এই খালাকে লুকিয়ে রাখা হতো, যখন বর পক্ষ বাড়িতে কোন মেয়ে দেখতে আসতো। যেন তাকে দেখে মূল কন্যাকে অপছন্দ করে না বসে।
অথচ তারই আর বিয়ে হলো না। শুধুমাত্র মুটিয়ে যাবার জন্য! এই হলো আমাদের সমাজের চোখে নারীর দৈহিক সৌন্দর্য্যের মুল্যমান!
অন্যদিকে
আল্লাহ তাঁর নিজের পরিকল্পনা হয়ত খালাকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন তাই তিনি সব সময় বলতেন ভাইয়ের বাচ্চাদের নিয়ে কেটে যাবে সময়।
সত্যই তাই হলো।
কিন্তু যা হলো তা কোন শত্রুরও যেন না হয় কোনদিন। বাস্তবতা কতো বেদনার হতে পারে তা না দেখলে বোঝার উপায় নেই।
হঠাৎ করেই আমার ছোট মামীটা মারা গেলেন হিমোগ্লোবিন কমে। সবাই থ্ হয়ে গেল। বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে।
ছোট দুইটা বাচ্চা। কে দেখবে তাদের!
ছোট বাচ্চাটা এতই ছোট যে তার মা মারা গেছে সেটাও সে বুঝতে পারছিলনা!
তখন সবার নজর খালার দিকে। একমাত্র ভরসার জায়গা নীলা খালা। যে বাচ্চা দুটোকে দেখে রাখবে। নানী অসুস্থ, বড় মামা বাহিরে থাকে পরিবার নিয়ে।
নীলা খালা নতুন করে নিজের বাপের বাড়িতে শুরু করলো সংসার জীবনের নতুন যুদ্ধ!
এতোদিন ছিল বাড়ির মেয়ে। যেখানে যেভাবে খুশি সময় কাটাতেন। কিন্তু এখন সব মেপেবুঝে করতে হয়। ভায়ের মেয়েদের দেখাশুনা নিজের সন্তানের চেয়েও বেশী জটিল।
নিজের মা চিৎকার করে বাচ্চা বকা দিলেও কেউ গায়ে মাখাবে না। কিন্তু মায়ের আসন বসে থাকা ফুপি একটা ধমক দিলেও লোকে ভাবে ফুপি বুঝি বিরক্ত!
মা মরা মেয়ে দুটোকে নিয়ে আমার নীলা খালা আর শিপু মামা বেশ কষ্টেই মানিয়ে গুছিয়ে নিলেন।
পাড়ার লোকেরা বলাবলি শুরু করলো।
এভাবে চলে নাকি! শিপুর একটা বিয়ে দিয়ে দাও।
মামা মামীকে খুব ভালবাসতেন। তিনি চুপ করে থাকেন। কোনকিছু বলতেন না।
অফিস করতেন, বাচ্চাদের নিয়ে বাহিরে বেড়াতে যেতেন মাঝে মাঝে মামীর কবরেও নিয়ে যেতেন।
বাচ্চাগুলো ফুপি আর বাবা ছাড়া কিছুই বুঝেনা।
আমার এই মামাটাও মামী চলে যাবার দেড় বছরের মাথাতে মারা গেলেন। তারপর নানী চলে গেলেন। চোখের সামনে নিজের ছেলে আর পুত্রবধুকে অসময়ে চলে যেতে দেখে।
একটা সাজানো সংসারের আলো নিভে গেল ঠিকই কিন্তু নতুন করে সব শুরু করলেন বিয়ের আসনে বসতে না পারা, মুটিয়ে যাওয়া আমার নীলা খালা!
এখন এই সংসারটা নীলা খালার। সব তাকে দেখে রাখতে হয়। মা না হয়েও আজ তিনি মা,বাবা না হয়েও বাবার সবকিছুই করতে হচ্ছে তাকেই ।
বাচ্চাগুলোর মুখের দিকে তাকালে আমার ভেতরটা দুমরে মুচরে উঠে। আর নীলা খালা দিব্যি সব মানিয়ে নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে আল্লাহর দেয়া আমানতের
খেদমত।
নীলা খালাকে নিয়ে আল্লাহ্ কত্তো বড় পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন তা এখন সমাজের লোক বেশ টের পাচ্ছে।
কেউ আর বলে না ” মোটা মেয়েকে কে বিয়ে করবে ! ”
আহারে জীবন!
হঠাৎ কত পরিবর্তন!
নিজের অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকালে আল্লাহ্ নিশ্চয় সম্মানিত করেন ।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা)
লেখকঃ সাহিত্যিক ও কলামিস্ট