Ads

প্রথম ও শেষ চিঠি!

সুমেরা জামান

প্রিয় জামান,

আসছে আষাঢ়ের সদ্য ফোটা কদমের সৌরভ দিলাম তোমায়। এ তোমাকে লেখা আমার প্রথম ও শেষ চিঠি। এই মুঠোফোনের যুগে চিঠিতো এক বিষ্ময়!!

আমার সাথে দেখা হবার প্রথম সেই দিনটা মনে আছে তোমার??  জানো তোমার উপস্থিতি আমার হৃদপিন্ডের কম্পন শত সহস্রগুন বাড়িয়ে তুলেছিল অজানা এক আশংকায়। অচেনা এক ঝড় আমার ভেতরে অনাসৃষ্টি কান্ড বাধিয়ে দিয়েছিল।

আলাপচারিতার এক অবসরে কফিতে চুমক দিয়ে বলে বসলে আমাকে ছাড়া নাকি তোমার চলবেনা। সেকি তাড়া তোমার। কনে দেখার পর থেকে এক একটি দিন নাকি তোমার একযুগের সমান।

এরপর প্রচন্ড শীতে কুয়াশার চাদরে  মুড়ে, পুষ্পবৃন্ত হতে ঝড়ে পরা একটি পাপড়ি রহমানুর রহিম নিজে তোমার কাছে তুলে দিলেন।

নদীর জলের মত কল কল শব্দে কবুল বলে আমি তোমার হলাম। মনে আছে তোমার, প্রথম সেই স্পর্শ?? কবুল শব্দটি দুটি কলবকে স্পর্শ করে সীমাহীন  এক তরঙ্গধ্বনিতে রূপ নিয়েছিল।

সেই ধ্বনি আমাকে ব্যাকুল করে তুলেছিল। ঝিরঝির শব্দে আমি বৃষ্টির ধারার মত তোমার রক্তের সাথে মিশে যেতে থাকলাম। আমি আর আমার নেই।
আমার প্রতিটি লোহিত কনিকা থেকে একটিই শব্দ ধাবমান জামান, জামান।

রাতের জোসনা সাক্ষী, সাক্ষী রাতের নিরবতা এক সুন্দর আর শুভ্র সকালের স্বপ্ন দেখেছিলাম  আমরা । ভেবেছিলাম একটি লাল সুর্য  যার রক্তিম আভা আমাদের আলোকিত করবে, পথ দেখাবে।

কিন্তু একি এতো শুধু গনগনে হয়ে জ্বলছে, তাপ বিলোচ্ছে, আমার সমস্ত শরীর ঘেমে যাচ্ছে, আমি ডুবে যাচ্ছি সেই লবন জলে । তলিয়ে যাচ্ছি অবিশ্বাসের এক মহাসমুদ্রে।

সুহা আমাদের একমাত্র সন্তান, ওর কথা আজ কানে গুন গুন করে বাজছে, আম্মি ডাকটা,ওর হাসির শব্দটা যেন সারাটাক্ষণ শুনতে পাই। ট্রাকটা আমাকে ধাক্কা দিল, আমার কোল থেকে সুহা ছিটকে পড়ল, মা বলে চিৎকার করলো, আমারই চোখের সামনে থেতলে গেল ওর পুরো শরীর!!!!
আমি সেদিন শুধু আমার সুহাকে তুলতে পারিনি গো, ওকে আর স্পর্শও করতে পারিনি। বুকে ব্যথা হচ্ছে জানো!

আজ ওকে স্পর্শ করার জন্য তোলপাড় করছে বুকের ভেতর মা তো আমি তাইনা বলো?? আচ্ছা তোমার এমন হয়না?  ও বেঁচে থাকলে আজ  স্কুলে পড়ত। ফেরার পথে চকলেটের বায়না করতো হয়তোবা।

সেদিন ট্রাক শুধু আমাদের পিষে দেয়নি, দিয়েছে আমার স্বপ্ন, সঙ্গী, সংসার আর মা হবার তীব্র পিপাসাকেও। সুহাকে হারিয়ে তোমাকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে দেখি, তুমি আর আমার নেই, অন্যের।
জীবন ফিরে পেয়েছি বটে তবে হারিয়ে ফেলেছি জীবনসঙ্গীকে।

আমার সব বিশ্বাস বিস্বাদ করে নতুন জীবনের সন্ধানে তোমার ছুটে চলায় আসুক ধুমকেতুর গতি।তোমার নতুন সঙ্গী, ভাললাগার মানুষটি তোমার মনোজগতে সুভ্রতা ছড়াক। অনুরোধ শুধু তার অসময়ে তাকেও ছেড়ে যেওনা। আগলে রেখো ভালবাসার ভালোটা দিয়ে।
হয়তো তুমি বাবাই হবে কিন্তু আমি কোনদিন কারো আম্মি হতে পারবো না।

তোমার মনে আছে সেই দুটো গানের লাইন?  আমি অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে রাখলে তুমি গাইতে “”এ বুক ভাংতে চাও ভাংতে পারো শুধু ওগো পর হয়ো না ”
আমি কেঁদে ফেলতাম তার পর দুজনই গেয়ে উঠতাম ” সকল তিক্ততা কি ওগো ভুলে গিয়ে, সেই প্রেম খুজে পাবো না “!!!

এসব ভাবতেই আজ আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। আমাদের সাজানো পুষ্প পল্লবে ঢাকা এই সংসারে প্রতারণার পোঁড়া গন্ধ। কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে  বেলকনি থেকে বুকের বাম সীমানা অবধি। যেখানে হৃদয় থাকে। ঘুটঘুটে কালো অন্ধকারে বিশ্বাসকে সনাক্ত করা যাচ্ছেনা। বিশ্বাস হারিয়ে নিঃস্ব আমি।

আমার অক্ষমতা আর তোমার প্রতারণায় ভেঙ্গে যাওয়া বিশ্বাসের টুকরো গুলো সাথে নিয়েই হাসপাতাল থেকে চেপে বসলাম হুইল চেয়ারে। চিরচেনা শহর ছেড়ে বহু দুরে। হৃদপিন্ডের ভেতর সেই ঝড় প্রথম পরিচয়ের।

ভালো থেকো সাবধানে পথ চলো।

ইতি
সুহার আম্মু

আরও পড়ুন