Ads

ম্যারিটাল রেইপঃ ইসলাম কী বলে?

।। সাজেদা হোমায়রা ।।

‘ম্যারিটাল রেইপ’ বা ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ নামে ইদানিং একটা টার্ম ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা ও বিতর্কও চলছে। হাজবেন্ডের যদি শারীরিক সম্পর্ক করবার তাড়না জাগে কিন্তু ওয়াইফ এতে রাজি না থাকে তবুও হাজবেন্ড তাকে জোর করে শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করে- এটাকেই বলা হচ্ছে ম্যারিটাল রেইপ।

ইসলামে বিয়ে একজন নারী ও একজন পুরুষের দৈহিক, মানসিক, সামাজিক চাহিদা পূরণের সিভিল কন্ট্রাক্ট। বিয়ের মাধ্যমে তারা একে অপরকে শারীরিকভাবে অন্তরঙ্গ হবার সম্মতি প্রদান করে। অর্থাৎ ইসলামে শারীরিক সম্পর্কের শরীয়াহসম্মত চুক্তি হলো বিয়ে। তার মানে হলো, শারীরিক সম্পর্ক সম্পাদনের জন্য হাজবেন্ড ও ওয়াইফ উভয়েরই সম্মতি থাকাটা জরুরি। একজনের সম্মতি আছে, অন্যজনের নেই- এমন হলে হবে না।

আমরা দেখি, লিবারেল ক্ষেত্রে শারীরিক সম্পর্কের ভিত্তি ‘সম্মতি’। অর্থাৎ দুইজন এডাল্ট মানুষের সম্মতি থাকলে ফিজিক্যাল ইন্টিমেসিতে কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু ইসলাম এই শারীরিক সম্পর্ককে উপকারী (শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে), সন্তান জন্মদান ও পরিবার গঠন হিসেবে দেখতে চায়। তাই ইসলামে বিয়ে ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক অনুমোদিত নয় তাতে সম্মতি থাকুক আর নাই থাকুক।

এখন কথা হচ্ছে, ইসলাম কি স্বামীকে স্ত্রীর ওপর এমন একচ্ছত্র আধিপত্য দেয় যে, স্বামী জোর করে তার স্ত্রীর জন্য শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিকর হয়, এমন কোনো উপায়ে তার চাহিদা মিটিয়ে নিতে পারবেন? এবং সেখানে স্ত্রীর কোনো আপত্তি থাকতে পারবে না কারণ তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ? না, বিষয়টা কখনোই এমন হবে না। ইসলামে বিয়ে এমন একটা জিনিস যেখানে স্বামী বা স্ত্রী কারোই একে অপরের কোনো ক্ষতি করার অধিকার নেই।

কুর’আনে বলা হয়েছে, “আর পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের ওপর অধিকার রয়েছে,তেমনিভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের ওপর।” (সুরা বাকারা, আয়াত ২২৮)

ইসলামে বিয়ের চুক্তির মাধ্যমেই স্বামী, স্ত্রী একে অপরকে শারীরিকভাবে উপভোগ করার অধিকার দিয়েছে। তাই স্ত্রীর দিক থেকে দায়িত্ব হলো, তার স্বামীর আহবানে সাড়া দেয়া যদি না তার কোনো শরীয়ত সম্মত ওজর থাকে। আর যদি কোনো ওজর থাকে, তাহলে স্বামীরও দায়িত্ব তাকে জোরপূর্বক ইন্টিমেসিতে বাধ্য না করা।

আরও পড়ুন-

ইসলামের নিকাহ দর্শন এবং পশ্চিমা চিন্তা প্রভাবিত বৈবাহিক ধর্ষণ

যদি এই বিষয়টি এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, একজনের কষ্ট হচ্ছে তারপরও সেটাকে উপেক্ষা করে আরেকজন তা আদায় করে নিচ্ছেন। তাহলে এটা জুলুমের পর্যায়েই চলে যায় এবং ইসলাম সেটাকে কোনোভাবেই অনুমতি দেয়নি। ইসলাম যে কোনো প্রকার জুলুমকেই হারাম করেছে। সুতরাং ইসলামে বিয়ে পরবর্তী এই জোরাজোরিকে ধর্ষণ বলা যায় না বরং তা হবে একজনের প্রতি আরেকজনের জুলুম।

ইসলাম একজন নারীর সাথে একজন পুরুষের বিয়ের মাধ্যমে পারস্পরিক জৈবিক চাহিদা মেটানোর অনুমোদন দিয়েছে, সুযোগ দিয়েছে, জায়েজ করেছে। এক্ষেত্রে একে অন্যকে কোঅপারেট করা, একে অন্যের প্রয়োজন পূরণ করার বিষয়টিকে ইসলাম আবশ্যক করেছে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার পারস্পরিক ভালোবাসা, আন্ডারস্ট্যান্ডিং, স্নেহ ও মমতার দাবিও এইটি।

ফিজিক্যালি আল্লাহ ছেলেদের এবং মেয়েদের আলাদা করে বানিয়েছেন। ছেলেদের ফিজিক্যাল ডিমান্ড ফুলফিলের প্রসেস মেয়েদের তুলনায় ডিরেক্ট। মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা সম্পূর্ন আলাদা। মেয়েদের অনেক বেশি ইমোশনাল এটাচমেন্ট লাগে। ইমোশনাল এ্যাটাচমেন্ট ছাড়া সরাসরি ফিজিক্যাল ইনভলভমেন্টের কথা অনেক মেয়েই মেনে নিতে পারে না। প্রোপার ইমোশনাল এ্যাটাচমেন্টের অভাবে অনেকে মেয়েরা ইন্টিমেসির ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড থাকেন না। আবার অনেক মেয়েরা হাজব্যান্ডের ডিমান্ড ফলো করাটাকে একটা রিলিজিয়াস ডিউটি হিসেবে পালন করে। যতই টায়ার্ড বা স্ট্রেসড থাকুক না কেন, তাদের মাঝে ইমোশনাল এ্যাটাচমেন্ট থাকুক বা না থাকুক।

এ দু’টি অবস্থার কোনোটিই কাম্য নয়।

বরং ইমোশনাল এ্যাটাচমেন্ট গড়ে তোলার দিকে যত্নবান হওয়াই বেশি প্রয়োজন।

আমাদের সমাজে হাজবেন্ড বিছানায় ডাকলে সাড়া না দিলে ফেরেশতারা অভিশাপ দেবে, এই বিষয়ে যতটা কথা হয়, তার সিকিভাগও কি আলোচনাও হয় ওয়াইফের ইমোশনাল নিড ফুলফিল করা নিয়ে হাজব্যান্ডের যে দায়িত্ব আছে তা নিয়ে?

আমরা সীরাহ থেকে দেখি রাসূল সা. প্রয়োজন ভেদে উনার ওয়াইফদের ইমোশনাল নিড ফুলফিল করাকে কীভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

বুখারীর একটি বর্ণনায় এসেছে, ৭ম হিজরিতে খায়বার যুদ্ধের পর মুসলিম বাহিনী মদিনায় ফেরার পথে এক জায়গায় যাত্রা বিরতি করেন। সেখানে আল্লাহর রাসু্ল সা. এর সাথে উম্মুল মুমেনিন সাফিয়্যা রা. বিয়ে হয়। তখন আনসার মহিলারা তাঁকে বাসর রাতের জন্য সাজিয়ে ও সুগন্ধি লাগিয়ে দিলেন। তারা তাঁবুর মত ঘর বানালেন। রাসুল সে ঘরে প্রবেশ করলে সাফিয়্যা দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্ভাষণ করেন ও অন্য মহিলারা বের হয়ে যান। এরপর রাসূল সা. বিয়ের পূর্ণতার জন্য সাফিয়্যা রা. কে আহবান করলেন, সাফিয়্যা রা. উত্তর দিলেন, ‘এই রাতে নয়।’ অর্থাৎ সাফিয়্যা রা. সম্মতি দেন নি। উম্মে সিনান বলেন পরের দিন যখন কৌতুহলবশত তারা সাফিয়্যা রা.কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাসুল সা.কে কেমন দেখলে?’ সাফিয়্যা বললেন, “আল্লাহর রাসুল সা. আমার সাথে খুবই হাসিখুশি ছিলেন ও সারারাত আমরা অনেক গল্প করেছি।’

আল্লাহর রাসুল সা. সাফিয়্যা রা. এর কথায় সম্মান রেখে পরের রাতে যখন তাঁকে আবার আহবান করলেন তখন তিনি রাজি হলেন। রাসূল সা. এভাবেই স্ত্রীদের ইমোশনকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-

দাম্পত্য জীবনে সম্মতির শিষ্টাচার ও ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ বিতর্কঃ এক ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

আল্লাহ যেহেতু নারী পুরুষ উভয়কেই যৌন আকাঙ্ক্ষা দিয়ে পাঠিয়েছেন, স্বামীর যেমন ন্যায়সঙ্গতভাবে স্ত্রীর কাছ থেকে যৌন চাহিদা পূর্ণ করা অধিকার আছে, স্ত্রীরও একই অধিকার আছে স্বামীর ওপর।

সংসারের অন্য সকল বিষয়ের মতই এ বিষয়ে নারী পুরুষ একে অপরের সহযোগী হবেন। পরিপূরক হবেন। সম্পূর্ণ বিষয়টি অবশ্যই উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমেই হতে হবে। কল্যাণকর ও সুখী দাম্পত্য জীবন গড়তে ভদ্রতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়াটা খুব জরুরি, যেভাবে শিখিয়েছে ইসলাম!

লেখকঃ লেখক, গবেষক, একাডেমিশিয়ান এবং ফাতিহা ইন্সটিটিউটের “গ্লোরিয়াস ফিমেল” প্রোজেক্টের প্রোজেক্ট ডিরেক্টর

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল, আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেইজ মহীয়সী/Mohioshi-তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হ্যাঁ, মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইল-

[email protected] ও [email protected] -এ; মনে রাখবেন, “ধন দৌলত খরচ করলে কমে যায়, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়”। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনি জ্ঞান দান করেন।” (সহিহ বুখারী- ৭১, ৩১১৬, ৩৬৪১, ৭৩১২, ৭৪৬০; মুসলিম- ১০৩৭; ইবনে মাজাহ- ২২১) ।

মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম; আজই আপনি যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে।  আসুন, ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি। আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমীন।

আরও পড়ুন