Ads

স্বামী-স্ত্রী তালাকের পরও ভালো বন্ধু হতে পারে কি?।। ২য় পর্ব

।। জামান শামস ।।

আমাদের সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের হার অনেক বেড়েছে। এর বহু সামাজিক ও মনস্তাত্বিক কারণ থাকতে পারে তবে স্বীকার করতে হবে যে স্বামী স্ত্রীতে সামান্য কারণে বনিবনা না হওয়া এবং তাতে ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগা অন্যতম একটি কারণ। বলা ভালো যে আমাদের ধৈর্য ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া এবং নারী ও পুরুষ উভয় তরফে পরষ্পর অকৃপণ ভালবাসার পরিবর্তে আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব,পরবর্তীতে অন্য তৃতীয় কোনজনকে অধিকতর আস্থাবান ভেবে পরকীয়ায় আসক্ত হওয়া এখন বিবাহ না টিকার অন্যতম প্রধান একটি কারণ।

তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ ইসলামের কাম্য নয়। বিবাহের মাধ্যমে যে দাম্পত্য সম্পর্কের সূচনা হয় তা অটুট থাকা এবং আজীবন স্থায়ীত্ব লাভ করা ইসলামে কাম্য। সুতরাং উত্তম স্বামী বা স্ত্রী কখনও বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করার চেষ্টা করবে না এবং বিবাহ-বিচ্ছেদের পরিস্থিতিও সৃষ্টি করবে না। কেননা বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হলে এর কুপ্রভাব শুধু স্বামী-স্ত্রীর উপর সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং গোটা পরিবারটিই তছনছ হয়ে যায়, সন্তান-সন্ততির জীবন পর্যন্ত বিপর্যস্ত ও বিষময় হয়ে পড়ে। কোন কোন সময় এই ঘটনার জের পরিবারের গন্ডি অতিক্রম করে বংশীয় কোন্দলে পরিণত হয় এবং সামাজিক জীবনে এর অত্যন্ত খারাপ প্রভাব পড়ে। এজন্য যে সকল কারণে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হয় সেগুলো দূর করার জন্য ইসলামী শরীয়ত বিভিন্ন বিধান দিয়েছে এবং এ বিষয়ে কুরআন-হাদীসে অনেক নির্দেশনা রয়েছে। প্রথমে বুঝিয়ে-শুনিয়ে সমাধান করতে বলা হয়েছে। এরপর স্ত্রীর সাথে শয্যা ত্যাগ, সতর্ক করা, শাসন করার পথ অবলম্বন করার আদেশ করা হয়েছে। এতটুকুতে মীমাংসা না হলে উভয় পক্ষে দুজন শালিস নিযুক্ত করে একটি চুড়ান্ত ফয়সালায় উপনীত হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। এগুলো হল দাম্পত্য জীবনে ইসলামী হেদায়েতের অনন্য বৈশিষ্ট্য। আফসোস! আমাদের যদি বোধোদয় হত এবং ইসলামী নির্দেশনাকে আদর্শ বানাতে পারতাম! সুতরাং আবেগের বশিভূত হয়ে নয়; বরং বুঝে-শুনে, চিন্তা-ফিকির করে যে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

আরও পড়ুন-

স্বামী-স্ত্রী তালাকের পরও ভালো বন্ধু হতে পারে কি?।। ১ম পর্ব

কুরআনুল কারীমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন,

وَ اِنِ امۡرَاَۃٌ خَافَتۡ مِنۡۢ بَعۡلِهَا نُشُوۡزًا اَوۡ اِعۡرَاضًا فَلَا جُنَاحَ عَلَیۡهِمَاۤ اَنۡ یُّصۡلِحَا بَیۡنَهُمَا صُلۡحًا ؕ وَ الصُّلۡحُ خَیۡرٌ ؕ وَ اُحۡضِرَتِ الۡاَنۡفُسُ الشُّحَّ ؕ وَ اِنۡ تُحۡسِنُوۡا وَ تَتَّقُوۡا فَاِنَّ اللّٰهَ كَانَ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرًا

যদি কোন নারী স্বীয় স্বামীর পক্ষ থেকে অসদাচরণ কিংবা উপেক্ষার আশংকা করে, তবে পরস্পর কোন মীমাংসা করে নিলে তাদের উভয়ের কোন গোনাহ নাই। মীমাংসা উত্তম। মনের সামনে লোভ বিদ্যমান আছে। যদি তোমরা উত্তম কাজ কর এবং খোদাভীরু হও, তবে, আল্লাহ তোমাদের সব কাজের খবর রাখেন। (সূরা আন-নিসা : ১২৮)।

বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে দাম্পত্যজীবন ও পারিবারিক জীবনের সূচনা হয়। ইসলামী শরীয়তে এই সম্পর্ক কায়েম করতে হলে যেমন সুনির্ধারিত কিছু বিধান রয়েছে তেমনি প্রয়োজনে এই সম্পর্ক ছিন্ন করতে হলেও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। হুট করে দু’জন দু’জনের সংগে সাক্ষাত করেই বিয়ে হয় না।এখানে প্রস্তাব দেয়া,প্রস্তাব গ্রহন, পারিবারিক পর্যায়ে আলাপন, সামাজিক পর্যায়ে জানান দেয়া,কন্যার মোহর স্থির করা এবং সাক্ষী সাবুদে তা প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। তেমনি বিচ্ছেদও ইচ্ছা মতো তালাক তালাক বললেই তালাক হয় না। তালাকের জন্যেও পর্যায়ক্রমিক নিয়ম রয়েছে। কুরআন-হাদীসে সেগুলোর বিস্তারিত গাইডলাইন রয়েছে। সম্ভবত ইসলামের মৌলিক ইবাদত সালাতের বিষয়েও এতো বিশদ বলা হয়নি।

আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষের দাম্পত্য জীবনের এমন একটি জটিল দিক সম্পর্কে পথনির্দেশ করেছেন, সুদীর্ঘ দাম্পত্য জীবনের বিভিন্ন সময়ের প্রত্যেকটি দম্পতিকেই যার সম্মুখীন হতে হয়। তা হলো স্বামী-স্ত্রীর পারস্পারিক মনোমালিন্য ও মন কষাকষি। আর এটি এমন একটি জটিল সমস্যা, যার সুষ্ঠু সমাধান যথাসময়ে না হলে শুধু স্বামী-স্ত্রীর জীবনই দুর্বিসহ হয় না, বরং অনেক ক্ষেত্রে এহেন পারিবারিক মনোমালিন্যই গোত্র ও বংশগত কলহ-বিবাদ তথা হানাহানি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। কুরআনুল কারীম নরনারীর যাবতীয় অনুভূতি ও প্রেরণার প্রতি লক্ষ্য রেখে উভয় শ্রেণীকে এমন এক সার্থক জীবন  ব্যবস্থা বাতলে দেয়ার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে, যার ফলে মানুষের পারিবারিক জীবন সুখময় হওয়া অবশ্যম্ভাবী। এর অনুসরণে পারস্পরিক তিক্ততা ও মর্মপীড়া, ভালবাসা ও প্রশান্তিতে রুপান্তরিত হয়ে যায়। আর যদি অনিবার্য কারণে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হয়, তবে তা করা হবে সম্মানজনক ও সৌজন্যমুলক পন্থায় যেন তার পেছনে শত্রুতা, বিদ্বেষ বা উৎপীড়নের মনোভাব না থাকে।

আরও পড়ুন-

স্বামী তার স্ত্রীকে কখন পাগলের মত ভালোবাসে?

সূরা-নিসা- এর ১২৮ তম আয়াতটি এমনই সমস্যা সম্পর্কিত, যাতে অনিচ্ছাকৃতভাবে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি হয়। নিজ নিজ হিসাবে উভয়ে নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও পারস্পরিক মনের মিল না হওয়ার কারণে উভয়ে নিজ নিজ ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা করে। যেমন, একজন সুদর্শন সুঠামদেহী স্বামীর স্ত্রী স্বাস্থ্যহীনা, অধিক বয়স্কা অথবা সুশ্রী না হওয়ার কারণে তার প্রতি স্বামীর মন আকৃষ্ট হচ্ছে না। আর এর প্রতিকার করাও স্ত্রীর সাধ্যাতীত। এমতাবস্থায় স্ত্রীকেও দোষারোপ করা যায় না, অন্যদিকে স্বামীকেও নিরপরাধ সাব্যস্ত করা যায়। এহেন পরিস্থিতিতে কুরআনের সাধারণ নীতি- অর্থাৎ, উক্ত স্ত্রীকে বহাল রাখতে চাইলে তার যাবতীয় ন্যায্য অধিকার ও চাহিদা পুরণ করে রাখতে হবে। আর তা যদি সম্ভব না হয়, তবে কল্যাণকর ও সৌজন্যমুলক পন্থায় তাকে বিদায় করবে এমতাবস্থায় স্ত্রীও যদি বিবাহ বিচ্ছেদে সম্মত হয়, তবে ভদ্রতা ও শালীনতার সাথেই বিচ্ছেদ সম্পন্ন হবে। পক্ষান্তরে স্ত্রী যদি তার সন্তানের খাতিরে অথবা নিজের অন্য কোন আশ্রয় না থাকার কারণে, বিবাহ বিচ্ছেদে অসম্মত হয়, তবে তার জন্য সঠিক পন্থা এই যে, নিজের প্রাপ্য মোহর বা খোর-পোষের ন্যায্য দাবী আংশিক বা পুরোপুরি প্রত্যাহার করে স্বামীকে বিবাহ বন্ধন অটুট রাখার জন্য সম্মত করাবে। দায়দায়িত্ব ও ব্যয় ভার লাঘব হওয়ার কারণে স্বামীও হয়তো এসমস্ত অধিকার থেকে মুক্ত হতে পেরে এ প্রস্তাব অনুমোদন করবে। এভাবে সমঝোতা হয়ে যেতে পারে।

স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া-কলহ বা সন্ধি সমঝোতার মধ্যে অহেতুক কোন তৃতীয় ব্যক্তি নাক গলাবে না। বরং তাদের নিজেদেরকে সমঝোতায় উপনীত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। কারণ, তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতির ফলে স্বামী-স্ত্রীর দোষ-ত্রুটি অন্য লোকের গোচরীভূত হয়, যা তাদের উভয়ের জন্যই লজ্জাজনক ও স্বার্থের পরিপন্থী। তদুপরি তৃতীয় পক্ষের কারণে সন্ধি-সমঝোতা দুষ্কর হয়ে পড়াও বিচিত্র নয়। আলোচ্য আয়াতের শেষের অংশে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর যদি তোমরা কল্যাণ সাধন কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে অবশ্যই আল্লাহ তাআলা তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত রয়েছেন।’ এখানে বুঝানো হয়েছে যে, অনিবার্য করণ বশত: স্বামীর অন্তরে যদি স্ত্রীর প্রতি কোন আকর্ষণ না থাকে এবং তার ন্যায্য অধিকার পুরণ করা অসম্ভব মনে করে তাকে বিদায় করতে চায়, তবে আইনের দৃষ্টিতে স্বামীকে সে অধিকার দেয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় স্ত্রীর পক্ষ থেকে কিছুটা স্বার্থ পরিত্যাগ করে সমঝোতা করাও জাযেয।

আরও পড়ুন-

দাম্পত্য জীবনে ফাঁটল ধরে যে কারণে

কিন্তু এতদসত্তেও স্বামী যদি সংযম ও খোদাভীতির পরিচয় দেয়, স্ত্রীর সাথে সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহার করে, মনের মিল না হওয়া সত্তেও তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ না করে বরং তার যাবতীয় অধিকার ও প্রয়োজন পুরণ করে, তবে তার এই ত্যাগ ও উদারতা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ওয়াকিফহাল রয়েছেন। অতএব, তিনি এহেন ধৈর্য, উদারতা, সহনশীলতা ও মহানুভবতার এমন প্রতিদান দেবেন, যা কেউ কল্পনাও করতে পারে না। এখানে ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত রয়েছেন’ বলেই ক্ষান্ত করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিদান কি দেবেন, তা উল্লেখ করা হয়নি। কারণ, এর প্রতিদান হবে কল্পনার ঊর্ধ্বে, ধারণার অতীত। মোটকথা, কুরআনুল কারীম উভয়পক্ষকে একদিকে স্বীয় অভাব-অভিযোগ দুর করা ও ন্যায্য অধিকার লাভ করার আইনতঃ অধিকার দিয়েছে। অপর দিকে ত্যাগ, ধৈর্য, সংযম ও উন্নত চরিত্র আয়ত্ব করার উপদেশ দিয়েছে। এখানে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে,

বিবাহবিচ্ছেদ হতে যথাসাধ্য বিরত থাকা কর্তব্য এবং উভয়ের পক্ষেই কিছু কিছু ত্যাগ স্বীকার করে সমঝোতায় আসা বাঞ্ছনীয়।

চলবে…

লেখকঃ কলাম লেখক এবং সাবেক এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে  লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ  লেখা, গল্প  ও কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

ফেসবুকে লেখক জামান শামস

আরও পড়ুন