।। জামান শামস ।।
ইসলাম চায় নারী ও পুরুষের মধ্যে একবার যে আত্মীয়তার সূচনা হয় তাকে আরো মজবুত করা, পরিবারে তাদের এ দাম্পত্য সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করা। এজন্যে কয়েকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১ . প্রেম ভালবাসা
বিয়ের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল নারী পুরুষের মধ্যে বিয়ের মাধ্যমে এক দুর্দমনীয় ভালবাসা প্রেম ও দরদ সৃষ্টি করা। বিয়ের প্রকৃত বন্ধন হচ্ছে প্রেম প্রীতি ও ভালবাসার বন্ধন। এ বন্ধন শিথিল হলে পারিবারিক শৃংখলার আর কিছুই অক্ষত থাকে না। বিবাহ পরবর্তী ভালবাসা বিবাহপূর্ব যৌবনের সর্বপ্লাবী জোয়ারে আনে নিয়ন্ত্রণ। তাই বিয়ে শুধু নৈতিক চরিত্রকেই পবিত্র রাখে না, শুধু বংশ রক্ষার জন্য সন্তানের জন্ম দিয়েই খালাশ হয় না বরং তার চেয়েও বেশী অবদান রাখে স্বামী স্ত্রী নামক এক জোড়া নর-নারীর মধ্যে অম্লান ও অকৃত্রিম এক ভালবাসার বন্ধন রচনা করতে। এজন্যেই কুরআনে স্বামী-স্ত্রীর একজনকে অপরজনের পোষাক (সুরা বাকারা) ও তাদের মধ্যে প্রণয় প্রীতিকে আল্লাহর করুণা (সুরা রুম) বলা হয়েছে। আয়াতদ্বয়ের রেফারেন্স পূর্বের পর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
২. ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা
মেয়েদের অল্পতে রেগে যাওয়া, অভিমানে ক্ষুব্ধ হওয়া, স্বভাবগত চঞ্চলতায় অস্থিরতা প্রকাশ করা তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সামান্য বিষয়ে অনেক সময় তারা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েন। আল্লাহ পাক মেয়েদের এ ধরনের স্বভাবের কথা খেয়াল রেখে স্বামীদের নির্দেশ দিয়েছেন তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সাথে উত্তম ব্যবহার কর (সুরা নেসা)। কোনও একটি বিশেষ দোষ হয়তো স্ত্রীর মধ্যে দেখা দিতে পারে কিন্তু তার জন্য স্বামীর অন্তরে ঘৃণার আগুন জ্বলে উঠা, স্ত্রীর সহিত নির্মম আচরণ করা কোন ভাবেই সংগত নয়। ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পানি দিয়ে সকল জিদ, রাগ ক্ষোভ প্রশমন করা উচিত। হতে পারে স্ত্রীর মধ্যে সহস্র ভালগুণের সমাহার থাকতে পারে কেননা কোন নারীই সমগ্রভাবে ঘৃণার বস্তু নয়। কোন একটি বা দুটি খারাপ দোষ থাকলে অস্থির ও দিশেহারা হওয়া উচিত নয়। লজ্জার কিছু নেই,আমার স্ত্রীর মধ্যেও এমন অনেক মন্দ পেয়েছি যা তার ভালো গুণগুলোর তুলনায় অনেক কম এবং ভালোগুলোর দিকেই তাকিয়েছি।
৩. ক্ষমাশীলতা
সব পুরুষই জানেন তার মা তাকে গর্ভে ধারণ করেছেন, দীর্ঘ সময় তাকে পেটে বয়ে নিয়ে সংসারের সব কাজ সামাল দিয়েছেন এবং খুব কষ্ট সহ্য করে লালন পালন করেছেন। মায়ের এই দৃশ্যটা তার নিজ স্ত্রীর ক্ষেত্রে অনুধাবন করলে তার অন্তরে দয়া জেগে উঠা স্বাভাবিক। নয় মাস দীর্ঘ একটা সময় তারই ঔরসজাত সন্তানদের এই মহিলা গর্ভে কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে ধারণ করেছেন । ত্রিশ মাস দুধ পান করিয়েছেন,পেশাব পায়খানার উপর শুয়েছেন। হয়তো তিনিও একজন চাকুরীজীবী। রান্না-বান্না,ঘর-দোর পরিচ্ছন্ন রাখা-এসবের কোনটা থেকেই তার ছুটি মিলেনি।তাই স্ত্রীর দোষ তালাশ করা, নানা ছুতায় তার মা বাবাকে খোটা দেয়া ও শাসন ত্রাসে সর্বদা ভীত সন্ত্রস্ত্র রাখা উচিৎ নয়। শুধু স্বামী স্ত্রী এক ছাদের নিচে বসবাস করলেই তাকে সুখী দাম্পত্য জীবন বলা যায় না। এখানে আছে দায়িত্ববোধ, পারস্পরিক সাহচর্য ও সহযোগীতা। আপনি পুরুষ হলে ভেবে দেখুন,সংসারের কোন কাজে আপনি আপনার স্ত্রীকে কতদিন সহযোগীতা করেছেন ?
আরও পড়ুন-
৪.স্ত্রীকে বিব্রত অবস্থায় না ফেলা
স্ত্রীরা ঘর সংসার সামলাতে গিয়ে প্রায় সময় আগোছালো থাকে। মাথার কেশ এলোমেলো, চেহারা মলিন, পোষাক পরিচ্ছদও থাকে অপরিচ্ছন্ন। বাইরে থেকে স্বামী এসে যদি স্ত্রীকে এরূপ অবস্থায় দেখে তবে নিরাশা ও নিরানন্দের বেদনায় মুষড়ে পড়ে, স্ত্রীকে কাছে টেনে নিতে ইতস্তত করে কিংবা এড়িয়ে চলে। এতে দুজনের মধ্যে দুরত্বের জন্ম নেয়। বিশেষতঃ যারা প্রবাস জীবন থেকে বাড়ী ফিরে স্ত্রীদের সাজসজ্জা অবস্থায় পায় না তারা হতাশ হয়ে পড়ে। এজন্যে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তোমাদের কেউ দীর্ঘদিন বাড়ীতে অনুপস্থিত থাকলে খবর না দিয়ে হঠাৎ করে পৌঁছে স্ত্রীকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেল না অথবা পৌঁছে তাদের কিছুটা অবসর দাও যাতে সে প্রয়োজনীয় সাজসজ্জা সেরে নিতে পারে। (বুখারী)। বাড়ীর অন্যদের সামনে স্ত্রীর দোষ বর্ণনা করবেন না,এমনকি সন্তাদের সম্মুখেও না। আত্মীয় স্বজনদের সামনে তার ভালো গুণগুলোর প্রসংশা করুন,মন্দগুলো শুধু তাকেই বলুন।
৫. স্ত্রীদের উপর জুলুম না করা
“পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের উপর নানাভাবে কষ্টদান, উৎপীড়নের উদ্দেশ্যে আটকে রেখো না।” (সুরা বাকারা) এছাড়া অসংখ্য হাদীসে স্ত্রীদের উপর চাপ প্রয়োগ, শারিরীক নির্যাতন করতে নিষেধ করা হয়েছে। তুচ্ছ কারণে স্ত্রীর প্রতি দুর্ব্যবহার করা, তাচ্ছিল্যের সাথে ডাকাডাকি করা, অপরের সম্মুখে হেয় প্রতিপন্ন করা খুবই অন্যায় কাজ। ছেলে-মেয়েদের সামনে তাদের মাকে গালি গালাজ করা এবং চড়, কিল ঘুষি দেয়া সহ নানাবিধ শারিরীক অত্যাচার করা নিঃসন্দেহে বড় জুলুম। যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে পেটানো, ঘর থেকে বের করে দেয়া, রক্তাক্ত করা এবং হত্যা করা কবীরা গুনাহের শামিল। এসব মানুষ পশুর চেয়েও অধম।
৬. পরস্পরের মধ্যে উপহার বিনিময়
স্বামী স্ত্রী পরস্পরে প্রেম ভালবাসার স্থায়িত্ব ও গভীরতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে পরস্পরের মধ্যে উপহার বিনিময় খুবই উত্তম কাজ। বিশেষ বিশেষ দিনে যেমন ঈদ উৎসব, জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষ্য করে এরূপ উপহার বিনিময় হতে পারে। উপহার সামগ্রীর মধ্যে পরস্পরের রুচি ও পছন্দ প্রধান্য পাবে। স্ত্রী যদি শাড়ী গয়নাতে খুশী হয়, তবে স্বামী তার সামর্থমত তাই দিতে পারে। হাদীসে বলা আছে তোমরা পরস্পরের মধ্যে হাদীয়া তোহফা আদান প্রদান করব্ কেননা তা হিংসা -দ্বেষ দূর করে। (তিরমিযী) এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যে স্ত্রীর আবদার রক্ষা করতে গিয়ে যেন আবার স্বামীকে হারাম উপায় অবলম্বনে বাধ্য না হতে হয় কিংবা উপহার প্রদানে কোনরূপ অহংকার বা রিয়া না থাকে।
আরও পড়ুন-
৭. স্বামী স্ত্রী পরস্পর পরস্পরের ছায়াস্বরূপ
একে অপরের দুঃখের সাথী হওয়া, বিপদে আপদে রোগে শোকে একে অপরের প্রতি অকৃত্রিম সহানুভূতি প্রদর্শন করা। একজনের অসুস্থতায় আরেকজন সঙ্গ দেয়া, খেদমত করা এবং সেবা-শুশ্রুষা দেয়া বড় রকমের এহসান । স্ত্রী সবচেয়ে বেশী দুঃখ পায় যখন দেখে তার কোন বিপদ উপস্থিত হয়, অথচ স্বামীর মন তাতে সামান্যও উদ্বেলিত হয় না ।উপরন্ত খরচের ভয়ে সে দূরে দূরে অবস্থান করে । কিংবা অন্য ফুলের বাগানে ভ্রমরের মত ঘুরে বেড়ায়। সন্তানেরা চিকিৎসার অভাবে শষ্যাশায়ী, পয়সার অভাবে স্কুলে যেতে পারে না অথচ বাবা অন্য কোথাও নুতন সংসার গড়তে তৎপর । এরূপ আচরণ স্পষ্টতঃই জুলুমের পর্যায়ভুক্ত।
পরিবারের শৃংখলা ও দাম্পত্য সুখ-শান্তি নিশ্চিত করতে ইসলাম স্বামী স্ত্রী উভয়ের অধিকার ও কর্তব্যে সামঞ্জস্য বিধান করেছে। এক্ষেত্রে শুধু পুরুষের একারই দায়িত্ব নয় স্ত্রীরও কিছু কর্তব্য স্বামীর অধিকার রক্ষায় স্থির করা আছে। সংসারে স্বামী হচ্ছেন সকলের কর্তা, জাহাজের ক্যাপ্টেন। বাহিরের সব ধরনের ধকল, সমস্যা তাকেই মোকাবেলা করতে হয়। রুটি রুজির জন্য সকাল থেকে সন্ধা অবধি প্রানান্তকর খাটুনির জোয়াল স্বামীকেই বইতে হয় দিনান্তে স্বামী বেচারা থাকেন কর্মক্লান্ত পরিশ্রান্ত । যতক্ষণ তিনি ঘরে থাকেন ততক্ষণ স্ত্রীর উচিত স্বামীর খেদমত আঞ্জাম দেয়া, তিনি পছন্দ করেন সেরূপ খাবার পরিবেশন করা, তার পোষাক পরিচ্ছদ তৈরী রাখা। স্বামীর অনুমতি ব্যতীত গমনাগমন, খরচপাতি করা এমনকি নফল কোন ইবাদাত করাও উচিৎ নয়। স্বামীর আত্মীয় স্বজন বিশেষতঃ বৃদ্ধ পিতামাতার খোঁজ খবর নেয়া, সাধ্যমত সেবা-শুশ্রুষা করা; এমনকি তাদের সন্তুষ্টিমত আচরণ করাও স্ত্রীর দায়িত্ব। স্বামীর ইজ্জত সম্মান নীচু হয় এমন কাজ করা, তার গতিবিধিতে অহেতুক সন্দেহ করা এবং তার অগোচরে মিথ্যা গীবত করা স্ত্রীর জন্য খুবই গুনাহের কাজ। স্বামীকে অতটুকু সম্মান করা স্ত্রীর কর্তব্য যে তাকে মনে রাখতে হবে যে আল্লাহ যদি মানুষের জন্য মানুষকে সেজদা করার অনুমতি দিতেন তবে দুনিয়ার স্ত্রীদের তাদের নিজ নিজ স্বামীকে সেজদা করতে হুকুম করতেন।
চলবে…
লেখকঃ কলাম লেখক এবং সাবেক এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে- [email protected] ও [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে । আসুন ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।
ফেসবুকে লেখক জামান শামস