Ads

দরিদ্র পরহেযগার ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে

জামান শামস 

সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব রহঃ প্রখ্যাত তাবেঈ ছিলেন। তাঁর দাদা ও পিতা উভয়ে ছাহাবী ছিলেন। তিনি ছাহাবীগণ থেকে বহু হাদীছ বর্ণনা করেছেন। বিশেষ করে তিনি ওছমান, আলী, যায়েদ বিন ছাবেত, আয়েশা ও উম্মে সালামা (রাঃ) থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তিনি সর্বদা তাফসীর ও হাদীছের দরসদানে ব্যস্ত থাকতেন।
তাঁর একজন পরমা সুন্দরী ও পরহেযগার মেয়ে ছিল। খলীফা আব্দুল মালেক বিন মারওয়ান তার ছেলে ওয়ালীদের সাথে বিবাহ দেওয়ার জন্য সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব রহঃ এর কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। তিনি জানতেন যে তার মেয়ে পরবর্তী খলীফার স্ত্রী হ’তে যাচ্ছে।কিন্তু ওয়ালীদের মধ্যে দ্বীনদারির অভাব লক্ষ্য করে তিনি খলীফার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন।
এর ফলে তাঁর ভয় ছিল জোর করে তাঁর মেয়েকে নিয়ে যাওয়া হ’তে পারে। কিন্তু তিনি আল্লাহর ভয়ের উপর কারো ভয়কে প্রাধান্য দিলেন না। পরে তিনি দ্বীনদারী দেখে হতদরিদ্র বিপত্নীক ছাত্র আবু ওয়াদার সাথে মেয়ের বিয়ে দিলেন যিনি কিছুদিন পূর্বে অসুস্থতাবস্থায় স্ত্রীকে হারিয়েছেন।
আবু ওয়াদা‘ কাছীর ইবনুল মুত্ত্বালিব নিজেই বলেন, আমি নিয়মিত মসজিদে নববীতে সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েবের দরসে উপস্থিত থাকতাম। আমার স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে আমি বেশ কিছুদিন ক্লাসে উপস্থিত থাকতে পারিনি। এই অবস্থা দেখে শায়খ ধারণা করলেন হয়ত আমার কোন বিপদ হয়েছে বা কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। উপস্থিত ছাত্রদেরকে তিনি আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, কেউ জবাব দিতে পারল না। দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকার পর আমি ক্লাসে ফিরলাম। শিক্ষক সাঈদ বিন মুসাইয়েব আমাকে অভ্যর্থনা করে অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাইলেন। বললাম, বেশ কিছুদিন যাবত আমার স্ত্রী অসুস্থ ছিল।
.
অসুস্থ অবস্থায় সে মারা গেছে। তার কাফন-দাফন ও জানাযা শেষ করে আজ ক্লাসে উপস্থিত হ’লাম। এত কিছু ঘটে গেছে, অথচ তুমি আগে কিছুই বলনি? আগে জানালে আমরা তোমার স্ত্রীর জানাযায় উপস্থিত হ’তাম। তোমাকে সান্ত্বনা দিতে আমরা তোমার বাড়িতে যেতাম। আমি বললাম, জাযাকাল্লাহ খায়রান! আমি উঠে চলে যেতে চাইলে তিনি ইশারা করে বসতে বললেন। লোকজন চলে যাওয়া পর্যন্ত বসেই রইলাম।
এরপর তিনি বললেন, হে আবু ওয়াদা‘! আচ্ছা, নতুন বিয়ের ব্যাপারে কি ভাবছ? আমি বললাম, আল্লাহ আপনার প্রতি দয়া করুন। কে এখন আমার সাথে তার মেয়ের বিবাহ দিবে? আমি এমন একজন যুবক যে ইয়াতীম অবস্থায় বড় হয়েছি ও দারিদ্র্যকে আলিঙ্গন করে জীবন-যাপন করছি। আর আমার নিকট দুই কিংবা তিন দিরহামের বেশী অর্থও নেই। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব (রহঃ) বললেন, তুমি কি এখন বিয়ে করতে চাচ্ছ? আমি চুপ করে রইলাম। কিছু একটা আঁচ করতে পেরে উস্তাদজী নিজেই বললেন, আমি আমার মেয়েকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই।
একথা শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। পরক্ষণেই বললাম, আমার অবস্থা জানার পরেও আপনি আমার সাথে আপনার মেয়েকে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন? হ্যাঁ, আমাদের নিকট যখন এমন কেউ আসে যার দ্বীনদারী এবং উত্তম চরিত্রে আমরা খুশি। আমরা তার সাথে মেয়ে বিয়ে দিয়ে দেই। তুমি আমার নিকটে পরহেযগারিতা এবং উত্তম চরিত্রে উপযুক্ত।
.
কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিয়েটা হয়ে গেলে। নানা কথা ভাবতে ভাবতে আমি বাড়িতে ফিরলাম। সেদিন আমি রোজাদার ছিলাম। কিন্তু সেকথা ভুলেই গিয়েছিলাম। নিজেকে ভৎর্সনা করছিলাম। মনে মনে বলছিলাম, হে আবু ওয়াদা‘, তুমি কি করলে? কার নিকট অর্থ ধার করবে? কার নিকট সম্পদ চাইবে? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে মাগরিবের সময় হয়ে গেল।
ফরয ছালাত আদায় করে ইফতারের কথা মনে পড়লো। ঘরে সামান্য খাবার ছিল। একটি রুটি আর তেল। এক বা দুই লোকমা মুখে না দিতেই কেউ যেন দরজায় করাঘাত করল। কে এলো এই সময়ে? জানতে চাইলাম। উত্তর এলো, সাঈদ। আল্লাহর কসম! ভাবছিলাম, কোন সাঈদ? কয়েকজন সাঈদের কথা মনে পড়ল। দরজা খুলে দেখি, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব (রহঃ)!
বললাম, হে আবু মুহাম্মাদ! আমাকে খবর দিলেই তো আমি আপনার নিকট হাযির হ’তাম। তিনি বললেন, এখন তো আমাকেই তোমার কাছে আসতে হবে। আমি বললাম, দয়া করে ভিতরে আসুন। তিনি বললেন, না। আমি এক বিশেষ কাজের জন্য এসেছি। আমি বললাম, আল্লাহ আপনার প্রতি দয়া করুন? বলুন কি জন্য এসেছেন? তিনি বললেন, ইসলামী শরী‘আত মোতাবেক আমার মেয়ে সকাল থেকে তোমার স্ত্রী হয়ে গেছে। আমি জানি তোমার দুঃখে সঙ্গ দেওয়ার মত কেউ নেই। তাই আমি অপসন্দ করলাম যে, তুমি এক স্থানে রাত্রি যাপন করবে আর তোমার স্ত্রী অন্যত্র রাত কাটাবে। সেজন্য আমি তাকে নিয়ে এসেছি। আমি বললাম, তাকে নিয়ে এসেছেন? আমারতো প্রস্ত্ততি নেই! হয়ত সেও প্রস্ত্তত ছিল না। তিনি বললেন, হ্যাঁ। তাকাতেই দেখলাম তার পিছনে একজন সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
.
তিনি তাকে লক্ষ্য করে বললেন, মা, তুমি আল্লাহর নাম ও বরকতে তোমার স্বামীর গৃহে প্রবেশ কর। যখন মেয়েটি বাড়িতে প্রবেশের ইচ্ছা করলো তখন সে লজ্জায় মাটিতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হ’ল। আমি তার সামনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। এরপর মেয়েকে বাড়িতে প্রবেশ করিয়ে নিজেই দরজা লাগিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
আমি দ্রুত রুটি ও তেলের নিকট গিয়ে তা আলো থেকে দূরে সরিয়ে রাখলাম। যাতে সে তা দেখতে না পায় এবং তা দ্বারা রাতের খাবার শেষ করতে পারি। এরপর ছাদের উপরে উঠে চিৎকার করে প্রতিবেশীদের আহবান করলাম। তারা এসে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? আমি বললাম, আজকে সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব মসজিদে আমার সাথে তার মেয়ের বিবাহ দিয়েছেন। তিনি হঠাৎ করেই আমার স্ত্রীকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছেন। আপনারা তাকে সঙ্গ দিয়ে আনন্দ দিন। আমার মাকেও ডাকলাম। তিনি আমার বাড়ি থেকে বেশ দূরে অবস্থান করতেন। একজন বৃদ্ধা বলল, তোমার ধ্বংস! তুমি কি বলছ, তা জান? সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব তোমার সাথে তার মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন? আবার নিজে এসে তোমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন? অথচ তিনি ওয়ালীদ বিন আব্দুল মালেকের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন? আমি বললাম, এই যে, হ্যাঁ সে আমার বাড়িতেই আছে। তারা অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে থাকল। এরপর প্রতিবেশীরা বাড়িতে আসল।
.
তারা আমাকে বিশ্বাসই করতে পারছিল না। তারা তাকে অভ্যর্থনা জানাল এবং বিভিন্নভাবে আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করল। সাঈদের কন্যাকে বিয়ে করেছি শুনে আমার মাও রাতের বেলায় চলে এলেন। আর এসেই হুকুম জারী করলেন, তোর জন্য আমার মুখ দেখা হারাম হয়ে যাবে যদি তিন দিনের আগে বউয়ের কাছে আসিস। সাঈদের কন্যা বলে কথা! ওকে একটু আদর-যত্ন করি। সাজিয়ে গুছিয়ে নেই। তারপর সাজগোজ শেষ হ’লে তিন দিন পর তুই ওকে দেখবি। সে মদীনার সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা।
.
তিন দিন শেষ হ’ল। বাসর ঘরে ঢুকে দেখি, মদীনার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটি খাটে বসা। দুই একদিন যাওয়ার পর এও বুঝলাম, শুধু রূপ লাবণ্যেই নয়, আল্লাহর কিতাব কুরআনের জ্ঞানে জগৎ সেরা, রাসূলের বহু হাদীছের হাফেযা, স্বামীর অধিকারের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ও ফিক্বহ-এর জ্ঞানেও সে অনন্যা। সর্বোপরি সে অনিন্দ্য সুন্দরী।
.
এভাবে দীর্ঘ একমাস চলে গেল। এর মধ্যে তার পিতা বা তার কোন আত্মীয় কিংবা আমার পরিবারের কেউ আমাকে দেখতে আসেনি। একদিন শায়খের দরসে গিয়ে উপস্থিত হ’লাম। সালাম দিলাম। তিনি সালামের উত্তর দিলেন। কিন্তু কোন কথা বললেন না। যখন মজলিস শেষ হ’ল তখন আমি ও তিনি ব্যতীত কেউ ছিল না। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আবু ওয়াদা‘! তোমার স্ত্রীর কী অবস্থা, সে কেমন আছে? বললাম, সে এমন অবস্থায় আছে, যে অবস্থাকে বন্ধু পসন্দ করে ও শত্রু ঘৃণা করে। তিনি বললেন, আল-হামদুলিল্লাহ। আমি যখন বাড়িতে ফিরে আসলাম, দেখলাম তিনি আমার পরিবারের সহযোগিতার জন্য অঢেল সম্পদ (কোন কোন বর্ণনা মতে বিশ হাযার দিরহাম) প্রেরণ করেছেন।
.
সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব (রহঃ)-এর কর্মকান্ড কতইনা বিস্ময়কর! তিনি দুনিয়াকে পরকালের বাহন হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তিনি নিজের ও পরিবারের জন্য পরকালকে ক্রয় করেছেন।
.
তথ্যসুত্র: ইবনুল জাওযী, আল-মুন্তাযাম ৬/৩২৫; ইবনু খাল্লিকান, ওয়াফয়াতুল আ‘ইয়ান ২/৩৭৭
লেখকঃ কলামিস্ট ও সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা

আরও পড়ুন