Ads

দাম্পত্য জীবনে সন্দেহের সূত্রপাত হয় যেভাবে

আফরোজা হাসান

পরিচিত এক বোন বলছিলেন তিনি প্রায় রাতেই স্বামীকে নিয়ে উল্টা পাল্টা স্বপ্ন দেখেন। যেমন, কখনো দেখেন স্বামী তার মেয়ে কলিগের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কখনো দেখেন স্বামী আরেকটা বিয়ে করেছেন। এই ধরণেরই আরো অনেক স্বপ্ন দেখেন। খুবই চিন্তিত এটা নিয়ে তিনি। কি করবেন না করবেন ভেবে দিশেহারা। স্বপ্ন নিয়ে কয়েকদিন আগে একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম। সেখান থেকে জেনেছিলাম বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন যে, রাতের দেখা স্বপ্নের প্রভাব পড়তে পারে বাস্তবে জীবনেও। গবেষকরাও বলেছেন, অনেক সময় রাতের স্বপ্ন প্রভাবিত করে আমাদের আচার-আচরণকে। যারফলে দিনের বেলায় মেজাজ থাকতে পারে বিক্ষিপ্ত ও চিড়চিড়ে। সঙ্গী বা সঙ্গিনীর প্রতি বাড়িয়ে দিতে পারে সন্দেহ। আবার এমন দেখা যায় যে, দিনের বেলায় যা কিছু দেখি , শুনি বা ভাবি, রাতে ঘুমের মধ্যে সেসবই স্বপ্নে দেখি।

আমার জানা মতে পরিচিত সেই বোনটি টিভি সিরিয়ালের খুব ভক্ত। তাদের কয়েকজনের একটা গ্রুপ আছে যারা নিজ নিজ বাচ্চাদেরকে স্কুলে দিয়ে সিরিয়ালের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেন। আর বর্তমান টিভি সিরিয়াল গুলোতে যেহেতু পরকীয়ার ছড়াছড়ি। সুতরাং, স্বামীকে নিয়ে ঐ ধরনের স্বপ্ন দেখা মোটেই অস্বাভাবিক নয় উনার জন্য। উনাকে বুঝিয়ে বললাম যে আসলে আপনি সারাদিন যা দেখেন, ভাবেন সেটার প্রভাবই পড়ছে আপনার স্বপ্নে। মানুষ খুব সহজেই সেসব জিনিস দ্বারা প্রভাবিত হয় যা তার মনকে আন্দোলিত করে। ভালোবাসা, রাগ, ঘৃণা, সন্দেহ কিংবা বেদনা অনুভূতি যেটাই হোক না কেন মনকে যা স্পর্শ করবে তার রেশ রয়ে যাবে মনের কোণে। যার ফলে তা চেতন, অবচেতন, অচেতন সব মনেই নিজ নিজ জায়গা দখল করে নেয়। এবং খেলা করে সমস্ত সত্ত্বা জুড়েই।

আরেক বোন বলছিলেন তার সারাক্ষণই মনে হয় যে তার মেয়ে তাকে মিথ্যা বলছে। যেমন,মেয়ে পেট ব্যথার কথা বললে উনার মনে হয় স্কুলে না যাবার বাহানা এটা। হোমওয়ার্ক নেই বললেও বার বার তিনি ব্যাগ চেক করেন। মেয়ে স্কুল থেকে এসে কিছু বললে উনি ক্লাসের অন্যান্য বাচ্চাদের ফোন করে নিশ্চিত হন সঠিক কিনা ইত্যাদি। আমি জানতে চেয়েছিলাম আচ্ছা আপনি কি ছোটবেলায় নানা বাহানা করে স্কুল ফাঁকি দিতেন? হোমওয়ার্ক করতে ইচ্ছে হতো না বলে কি লুকিয়ে রাখতেন? স্কুলের ব্যাপারে মিথ্যা বলে কি বাবা-মার কাছ থেকে কিছু হাসিল করতেন? উনি বিস্ময় ও লজ্জা মেশানো কণ্ঠে বললেন, আপনি কিভাবে জানলেন আপু? হেসে জবাব দিয়েছিলাম, আন্দাজ করেছি কারণ আমি জানা আছে অন্যেকে যাচাই মানুষ নিজ অভিজ্ঞতার আলোকেই করে বেশির ভাগ সময়।

নব বিবাহিত এক দম্পতির সাথে পরিচয় হয়েছিলো। সাজানো গোছানো ছোট্ট টুনাটুনির সংসার যেন একদম। কিন্তু মেয়েটির মনে শান্তি ছিল না একদমই। স্বামীর সাথে তার অফিসে গিয়ে মেয়ে কলিগদেরকে দেখার পর থেকে সারাক্ষণ মনে এই ভাবনা কাজ করতো বিয়ের পর তাকে দেশ থেকে প্রবাসে নিয়ে আসতে যে দশমাস লেগেছিল তখন অন্যকোন মেয়ের সাথে স্বামীর অবৈধ কোন সম্পর্ক তৈরি হয়নি তো? স্বামী অনৈতিক কিছু করেনি তো তার অবর্তমানে? তার স্বামী পবিত্র তো সম্পুর্ণ রূপে? আমি যেদিন ওর মনের ভাবনা জানতে পেরেছিলাম জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি কি এমন কিছু দেখেছো যাতে এমন ধারণার জন্ম হয়েছে তোমার মনে? জবাব দিলো, না। তবে আমার দাদী বলেছেন পুরুষ মানুষের পক্ষে নাকি কখনোই সম্ভব না স্ত্রীর সঙ্গ ছাড়া বেশিদিন থাকা। দাদার এমন অনেক ঘটনা দাদী বলেছেন আমাকে। তখন বুঝিয়ে বললাম অন্যের অভিজ্ঞতার দ্বারা নিজের সুখী ও সুন্দর জীবনকে নিজ হাতে নষ্ট করো না। তোমার দাদী-নানী, মা-খালা, চাচী-ফুপির অভিজ্ঞতা দিয়ে কেন তুমি তোমার স্বামীকে যাচাই করবে? এটা কি স্বামীর প্রতি অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে না? মেয়েটা বুঝেছিল এবং নিজেকে সংশোধন করেছিল।

ছোটবেলায় খাওয়ার ব্যাপারে আমি প্রচণ্ড পরিমাণে যন্ত্রণা করেছি মামণিকে। খাবার দিয়ে আমার সামনে থেকে সরলেই আমি সেই খাবার খাটের নীচে, সোফার পেছনে, ফোম উঁচু করে তার নীচে, কোমডে আরো কত জায়গায় যে লুকাতাম খাওয়ার ভয়ে। বাবার পাঞ্জাবীর পকেট, কাগজ-পত্র রাখার ব্রিফকেস পর্যন্ত পৌছে যেত আমার খাদ্যরা। আরো চার বছর আগে কোন কারণে নাকীবকে সামনে বসিয়ে না খাওয়ালে আমার মনের মধ্যে খুঁতখুঁত লাগতো যে খাবার খেয়েছে নাকি ফেলে দিয়েছে? আমি সত্যি সত্যি সোফার পেছনে, ওর খেলনা বাক্সের পিছনে খুঁজে দেখতাম খাবার ফেলেছে কিনা। এই কাজটা আমি করতাম আমার অবচেতন মনে বসে থাকা নিজ অভিজ্ঞতার মানদণ্ডে। আমি যেহেতু দুষ্টু কাজ করেছি, আমার ছেলেও করতে পারে এই ধারণার আলোকে। (আমার পুত্র অবশ্য তার মায়ের চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট ছিল। সে চারতলার বারান্দা দিয়ে খাবার নীচে ফেলে দিয়ে প্রমাণও ধুয়ে মুছে দিত)

আসলে হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে গঠিত হয় আমাদের ভাবনার জগত। পরিস্থিতির আলোকে না আমরা বেশির ভাগ সময়ই ধারণা করি আমাদের মনে জমে থাকা অভিজ্ঞতার আলোকে। হতে পারে সেই অভিজ্ঞতাটা নিজের বা অন্যের থেকে শোনা কিংবা নাটক-সিনেমাতে দেখা। গল্প উপন্যাস থেকে পড়ে অর্জিত অভিজ্ঞতাও অনেক সময় প্রভাবিত করে আমাদের চিন্তাকে। সেই আলোকে আমরা ধারণা করতে শুরু করি চারপাশের মানুষদের সম্পর্কে। আবার কখনো একজনের গুণাবলী দিয়ে যাচাই করি আরেকজনকে। নিজের ধারণার সাথে কারো স্বভাব মিলে গেলে হাসি তৃপ্তির হাসি। গর্ব করে বলি আমি মানুষকে দেখে, কথা বলেই তার সম্পর্কে অনেক কিছু বুঝে ফেলি। মানুষকে বোঝার ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা অনেক। কথায় বলে যে, ঝড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে। আসলেই ব্যাপারটা তাই। প্রতিটা মানুষ আলাদা হলেও তাদের অনুভূতির প্রকাশ কিন্তু মোটামুটি একই। যেমন কষ্ট পেলে মানুষ কান্না করে, প্রিয়জন আঘাত দিলে বিমর্ষ হয়, ব্যর্থতা এলে হতাশ হয় ইত্যাদি। আর এটা দেখেই কেউ কেউ ভেবে নেয় মানুষকে বুঝতে তার কোন তুলনা নেই।

তবে মনের কোন জমে থাকা এইসব ধারণা প্রায়ই সন্দেহে রূপ নিয়ে নষ্ট করে দেউ অনেক সুন্দর সম্পর্ক। এমন অযৌক্তিক অভিজ্ঞতারা মনে ঝরিয়ে যায় সংশয়ের অঝোর শ্রাবণ। সন্দেহ তখন মনকে করে দেয় বিক্ষিপ্ত, এলোমেলো। আর সন্দেহ যেখানে থাকে, শত ভালোবাসা থাকলেও সেখানে সম্পর্ককে মুখোমুখি হতে হয় নানান জটিলতার। অনেক সময় বলা হয় যে সন্দেহ ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। অনেকে বলে সন্দেহের উৎস ভালোবাসার সাগরেই। কিন্তু সন্দেহের উৎস আসলে কি? অবিশ্বাস+আস্থাহীনতা+অনিশ্চয়তা+দ্বিধাদ্বন্দ্ব+উদ্বেগ+দুশ্চিন্তা+আশঙ্কা+ব্যাকুলতা,+সংশয়+অপ্রত্যয়+অনুমান+ খুঁতখুঁত+ভয়। আর এই সবগুলোই থাকে অভিজ্ঞতার রঙে রাঙানো। যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় বিভিন্ন মাধ্যমে। যা ধারণার রূপে সুপ্ত থাকে মনে কোণে এবং যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে সন্দেহে।

তবে এটা ঠিক যে সন্দেহ মানুষের একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য। সন্দেহবিহীন কোন মানুষ খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। যেহেতু আমাদের চিন্তার জগত টইটুম্বুর নানান ধরণের অভিজ্ঞতা দিয়ে তাই কোন ঘটনা বা ব্যক্তিকে সেই আলোকে যাচাই করবে এটাই স্বাভাবিক। তাই কোন কারণে বা কারো প্রতি মনে সন্দেহ হানা দিলে ঘাবড়ে যাবার বা হতাশ হয়ে যাবার কিছু নেই। তবে ভালোমত যাচাই করে দেখতে হবে এর পেছনে আসলে মনের কোন অনুভূতি কাজ করছে এবং কিসের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে এই সন্দেহ। সন্দেহকে যদি আমরা যাচাই করে না দেখি, মনের মধ্যে খুব সহজেই জায়গা করে নিতে দেই তাহলে তা জীবনকে করে তুলবে জটিল থেকে জটিলতর।

নিজের ধারণাকে মূল্য দিতে গিয়ে বেশির ভাগ সময়ই আমরা একথা ভুলে যাই যে, কাউকে সন্দেহ করা মানে তাকে অবিশ্বাস করা, তার প্রতি ভরসার দোদুল্যমনতা। অথচ বিশ্বাস ও ভরসা ভালবাসার মূল ভিত্তি। ভিত্তিই যদি নড়বড়ে হয় তাহলে যে কোন ভালবাসার বাঁধন ছিঁড়ে যাওয়া কেবলমাত্র সময়ের ব্যাপার। বলা হয় সম্পর্ক গড়া অনেক সহজ। সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলা তারচেয়েও সহজ। কঠিন হচ্ছে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা। আসলেই কিন্তু তাই। অনেক সময় দেখা যায় সন্দেহ-সংশয় বা অবিশ্বাসের ছোট্ট একটা চিড় ধসিয়ে দেয় সম্পর্কের বিশাল দেয়ালকে। অনেক সুন্দর ও পবিত্র সম্পর্ক ঢাকা পড়ে যায় সন্দেহের কুৎসিত কালিমায়। ছড়িয়ে যায় সম্পর্কের মোতিগুলো কারণ সন্দেহ আঘাত হানে বিশ্বাসের সুতোয়। কঠিন এই পৃথিবীর চলার পথকে সন্দেহ করে তোলে কন্টকাকীর্ণ। সন্দেহের ফলে অবনতি ঘটে আপনজনদের সাথে বন্ধনের। হযরত আলী (রা.) বলেছেন, “সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তি, বন্ধু ও প্রিয়জনের সঙ্গেও শান্তিতে থাকতে পারে না।”

রাসূল(সা.) বলেছেন-“ এক মুসলমানের জীবন, রক্ত ও সম্পদ অন্য মুসলমানের কাছে পবিত্র। এক মুসলমানকে অন্য মুসলমান সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা করা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।” পবিত্র কোরআনেও আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে অনুমান ও কুচিন্তাকে পাপ ও মন্দকাজ হিসেবে অভিহিত করেছে এবং মুসলমানদের পরস্পরের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করা সম্পর্কে সতর্ক করেছে। আল্লাহ বলেছেন- “হে বিশ্বাসীগণ ! [ যতদূর সম্ভব ] সন্দেহ সংশয় থেকে দূরে থাক । কারণ কোন কোন ক্ষেত্রে সন্দেহ পাপের কারণ হয়। এবং একে অপরের উপরে গোয়েন্দাগিরি করো না, একে অপরের অসাক্ষাতে নিন্দা করো না।(সূরা হুজরাত-১২)

আমাদের সবার তাই চেষ্টা থাকা উচিত নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে ধারণা-সংশয় ও সন্দেহ করা থেকে দূরে থাকার। কারণ এসবের দ্বারা আমরা নিজেরাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পর্কগুলোতে জমতে দেই দুরুত্বের আস্তর। কাউকে যদি যাচাই করতেই হয় সেটা যেন করি তাকে দিয়েই। অন্যের রঙে না রাঙাই থাকে। হলুদ আর সবুজকে মিলালে দুটি রঙই হারিয়ে ফেলে নিজ নিজ স্বকীয়তা। রুপান্তরিত হয় নতুন এক রঙে। দুজন মানুষকে মিলাতেও গেলেও কিন্তু এমনটাই হয়। এই ভুল না করি আমরা। ফিকে হতে না দেই সম্পর্কের বন্ধনগুলোকে। বুলিয়ে দেই তাতে ভালোবাসার তুলিতে বিশ্বাসের রঙ……

লেখকঃ সাহিত্যিক ও প্রবাসী বাঙ্গালী, মাদ্রিদ, স্পেন

 

আরও পড়ুন