Ads

দেন মােহর -ইজ্জতের প্রশ্ন ?

নুরুল ইসলাম খলিফা

আমার বাসার গৃহকর্মী পারুল জানেনা তার বিয়ের মোহরানা কত । তিন সন্তানের এই মা এটাও জানেনা যে এটি মেয়েদের একটি পাওনা এবং স্বামীকে এই টাকা পরিশোধ করতে হয় । অথচ ইজাব কবুলের অন্যতম শর্তই ছিল মেয়েকে বলতে হবে এত টাকা মোহরানা ধার্য করে অমুকের সাথে তোমাকে বিয়ে দিচ্ছি । কিন্তু পারুল জানেনা তার বিয়ের মাহর কত ।এটাইতো আমাদের সমাজের সাধারণ চিত্র । ক’দিন আগে আমার গিন্নি বলছিলেন , আমাদের এক আত্মীয়ের মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব ভেঙে গেছে শুধু দেন মাহরের পরিমান নিয়ে মতপার্থক্যের কারনে । অর্থাৎ মেয়ে পক্ষ এত টাকার কম মাহর হলে বিয়ে দিবে না ; ছেলে পক্ষ এত টাকা মাহর দিতে পারবে না । অথচ উভয়পক্ষেরই ছেলে মেয়ে পসন্দ হয়েছিল । ঘটনাটা শুনে মনটা ব্যাথাতুর হওয়া উঠলো । শরীয়াতের এমন চমৎকার একটি বিধান সম্পর্কে একদিকে সীমাহীন অজ্ঞতা , অন্যদিকে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি সত্যিই দু:খজনক । অনেকদিন আগের একটা স্মৃতি মনে পড়লো । স্মৃতি পুরানো , যারা আগে পড়েছেন তারা না হলেও যারা পড়েননি তাদের কোনো কাজে লাগতেও পারে ।

১৯৭৩ সালের ৪ এপ্রিল দুপুর দু’টা । বাড়িটির বৈঠকখানা তথা কাছারী ঘরে ঘরোয়া পরিবেশে বিয়ের অনু্ষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে । বরের আসনে সাড়ে উনিশ বছরের এক সদ্য কৈশোরোত্তীর্ন যুবক । তার শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ফল প্রার্থী । কনে নবম শ্রেণীর ছাত্রী । বরের বাবা , কনের বাবা , কনের বড় দুই ভাই সহ কয়েকজন নিকটাত্মীয় উপস্থিত । বিয়ে পড়ানোর জন্য এলাকায় অত্যন্ত পরহেজগার-মোত্তাকী হিসেবে পরিচিত একজন হাফেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষক উপস্থিত ।

সব কিছু নির্বিঘ্নে চলছিল । হঠাৎ সামান্য ছন্দ পতন । না , বাল্য বিবাহের অভিযোগে পুলিশ এসে বিয়ে পন্ড করে দেয় নি । বিষয়টা বিয়ের দেন মাহর । বিয়ের অনুষ্ঠানে এটা নিয়ে খানিকটা বাক বিতন্ডা না হলে বিয়ের মজা থাকলো কোথায় ? কনে পক্ষের প্রানান্তকর চেষ্টা সর্বোচ্চ মাহর ধার্য করা ; বর পক্ষের কথা এত টাকা হতে পারে না । কনের বড় চাচা হাজী তোফায়েল সাহেব বেশ আবেগ প্রবন । শরীফ বাড়ির মেয়েদের মাহর একটু বেশিই হয় ; বাড়ির একটা ইজ্জত আছেনা ? বরের বাবার কথা, সে তো এখনও আয় রোজগারই করছে না । সুতরাং বেশি মাহর বেঁধে লাভ কি ? বাদানুবাদ চলছে ; শান্ত পানিতে কিছুটা ঢেউয়ের দোলা ।

হাত তুললো কিশোর বর । অনুষ্ঠানে হঠাৎই নীরবতা । ” দেখুন মাহর হচ্ছে শরীয়তের বিধান , যা পরিশোধ করা ওয়াজিব । সুতরাং দেন মােহর বরের আয় রোজগার এবং আর্থিক সামর্থ অনুযায়ী হওয়া উচিৎ । তা হলে বরের পক্ষে তা পরিশোধ করা সহজ হয় আর শরীয়তের বিধানটি মেনে চলা যায় “- বরের বক্তব্য । দু’য়েকজন মুরব্বী বলে উঠলেন , ‘ আরে কে কবে মাহরের টাকা পরিশোধ করেছে ? পরিশোধ করার কথা বলে দেন মােহর কমানো আর কি ।’ এগিয়ে আসলেন কনের বড় ভাই । প্রকৃত পক্ষে তিনিই কনে পক্ষের সব চেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন । এতক্ষন মুরব্বীদের কথা শুনছিলেন । বরের কথা শুনার পর তিনি বললেন , ” সেটাই হোক । বরই বলুক সে কত মাহর দিতে চায় । সেটাই আমরা মেনে নেব ।”

সবার দৃষ্টি বরের দিকে । তাজ্জব হলেন প্রায় সবাই । বিয়ের আসরে বর নাকে রুমাল দিয়ে চুপ করে বসে থাকবে -এটাই ছিল সে সময়ের নিয়ম বা প্রথা । অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব নিলেন কনের বড় ভাই । বললেন হ্যাঁ , বল তুমি কত মাহর দিতে পারবা ? বর খানিকটা অপ্রস্তুত । এক দিকে তার সামর্থ অন্য দিকে তার হবু জীবন সাথীর অধিকারের প্রশ্ন । তার পরও ভাবলো কয়েক সেকেন্ড । শরীয়তের বাধ্য বাধকতার কথা মনে করে বললো ,” এখন দেন মােহর তিন হাজার টাকা লিখেন । পরে পারলে আমি বেশি দিব , সেটা আমাদের নিজেদের বুঝা পরার মধ্যেই হবে । ” মুরব্বীরা বিশেষ করে কনের বড় চাচা হতাশ হলেন এবং মুখ ভার করে বললেন , ” আরে ! পরে তুমি কত দিবা সেটা দেখবে কে ? এখন কত লেখা হলো সেটা সবাই জানলো এবং সেটাই সামাজিক বিষয় । ” বর বললো ,” মাফ করবেন ! এটা শুধুই সামাজিক বিষয় নয় , এটি আল্লাহর একটি বিধানও বটে । ”

কনের বড় ভাই বললেন , আলহামদুলিল্লাহ ! তার কথায় আমরা সম্মত । কথার মধ্যে যুক্তি এবং বিশ্বাস দুটোই আছে । অতএব , হাফেজ সাহেব আপনি বিয়ে পড়ানো শুরু করুন ।” অবশেষে বিয়ে হয়ে গেল । বরের বাবা দোয়া করলেন । উপস্থিত মেহমানদের কাছে , অনুরোধ করলেন , ” আপনারা দোয়া করবেন , ওরা যেন দাম্পত্য জীবনে সুখী হয় । ”

পাঠক সম্ভবত : বুঝতেই পারছেন , সে দিনের সেই কিশোর বর কে ? এপ্রিল ঘনিয়ে এলেই স্মৃতির জানালা খুলে যায় , সে দিনের সে সুখস্মৃতি আমাকে শিহরিত করে যায় । ভাল লাগে অনেক কম বয়সেও একটি রসম বা প্রথাকে হটিয়ে ইসলামের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি উচ্চকিত রাখতে পেরেছিলাম । পরবর্তীতে অজুফাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে , তিনহাজার টাকার মাহরে বিয়ে হওয়ায় সে নিজেকে খুব বঞ্চিত মনে করেছিল কিনা । তার জবাব ছিল , কোনো টাকার অঙ্কের সাথে তো আমার বিয়ে হয়নি , বিয়ে হয়েছে রক্ত মাংসের একজন মানুষের সাথে। কাজেই বঞ্চিত হওয়ার প্রশ্ন কেন আসবে ? একজন অর্ধশিক্ষিত বেকার যুবকের হাতে হাত রাখতে নির্দ্ধিধায় এগিয়ে আসার সে কথা আমি সারা জীবনে মনে রেখেছি । তিন হাজার টাকার অঙ্ক পুষিয়ে দিতে সর্বদাই আমি সচেতন ছিলাম । এইতো সে দিনও দোহা বিমান বন্দরে বসে তাকে বললাম , ‘ কিছু কিনলে কিনতে পারো । ‘ বললো , ‘ ছোট একটা অলংকার দেখবো ? ‘ কৌতুক করে বললাম , তুমি তিন হাজার টাকার মাহরে আমার সাথে বিয়েতে রাজি হয়েছিলে , সে কথা আমি ভুলে যাইনি । আমার ক্রেডিট কার্ড সচল আছে , অতএব ছোট কেন ,বড় দেখলেও আপত্তি নেই ।’

মূলত : দেন মােহর এর বিষয়টির শরয়ী গুরুত্ব বুঝানোর জন্যই আমি বিষয়টির অবতারনা করেছি । আমাদের সমাজ এ বিষয়টিকে নিতান্তই একটি খেল তামাশা , সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি হিসেবে দেখে । এটা যে একটি ইবাদত এবং নারীর আর্থিক অধিকার যা স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত তা খুব কম মানুষই বিবেচনা করে । ফলে বিয়ে পরবর্তী পারিবারিক জীবনে আল্লাহর রহমত ও বরকত আসে না । মাহরের ক্ষেত্রে তাই আমাদের সাবধান হতে হবে । সাধ্যমত মাহর নির্ধারন করতে হবে , আবার তা গুরুত্ব দিয়ে আদায় করে দিতে হবে । একবারে না পারলে ধীরে ধীরে পরিশোধ করতে হবে । বরের সামর্থের কথা যেমন বিবেচনা করতে হবে , তেমনি কনের সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থানের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে । সবচেয়ে বড় কথা মাহর পরিশোধের নিয়তেই বাঁধতে হবে ।

আমি ছয়টি ছেলে মেয়ের বিয়ে সম্পন্ন করতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ ! মেয়েদের ক্ষেত্রে যেমন জামাইদেরকে স্বাধীনতা দিয়েছি মাহরের গুরুত্ব ও নারীর অধিকারের আলোকে মাহর নির্ধারন করার ; তেমনি ছেলেদেরকেও বলেছি সাধ্যমত সর্বোচ্চ পরিমান মোহর দিতে এবং কনে পক্ষও তাতে খুশী ছিল ।

লেখক: কলাম লেখক ও প্রাক্তন ব‍্যাংকার

আরও পড়ুন-

এ বঞ্চনার অবসান কবে হবে ?

আরও পড়ুন