Ads

দ্বিতীয় বিবাহ

ড. উম্মে বুশরা সুমনা

পরপর দুইজন আত্মীয়ার ফোন। দুইজনেরই একই কথা, ‘দেখছিস বলছিলাম না, এই দুই বিয়াই হলো সমস্যা……’বলতে বলতে এমন পর্যায়ে বলছিল যে, দুই বিয়ে খুবই ঘৃণার একটা কাজ।আমাদের সমাজে দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে অনেক কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য শোনা যায়, এমনকী তা হারামের পর্যায়ে নিয়ে যায়।

আবার অনেকেই এটাকে এমনভাবে বলে যেন এটা না করলে সুন্নাহ পালনই হচ্ছে না। এটা যেভাবে হোক করতেই হবে।বাসর রাতেই প্রথম বউকে মাসনার কথা বলে, শেষে আর সেই সংসারই টেকেনি এমন নজীরও আছে।দ্বিতীয় বিয়ে (মাসনা) নিয়ে আমাদের সমাজে বাড়াবাড়ি আর ছাড়াছাড়ি আছে।

এবার আমার জানা কিছু দুই বিয়ের ঘটনা বলি। আমি যতগুলো দুই বিয়ে দেখেছি প্রায় সবগুলোই ছিল পরকিয়া করার পর জায়েজ করা।দ্বিতীয় বিয়ে করা এক পুরুষের পক্ষের লোক হাসিমুখে আমাকে বলছিল, ‘তিনি তো খারাপ কাজ করে নাই। আরেকটা বিয়ে করেছে, এটা তো হালাল।’আমি ক্ষিপ্ত হয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, ‘ব্যভিচার করে বিয়ে করেছে। তারা যিনা করেছে। আগে যিনার শাস্তি দেওয়া হোক। তারপর আমি দ্বিতীয় বিয়ের মিষ্টি খাবো।‘

আমাদের সমাজে যেসব দ্বিতীয় বিয়ে ঘটে তার অনেকাংশে পরকিয়ার কারণে হয়।বিবাহিত পুরুষ যদি যিনা করে তবে তার শাস্তি গর্ত খুঁড়ে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা। গরু চুরি করে কোরবানি দেওয়া যেমন নিকৃষ্ট কাজ তেমনি পরকিয়া করে বিয়ে করাও নিকৃষ্ট কাজ।

আরেকটা বিষয়, এটাও বাঙ্গালিরা করতে পারে না (অল্প সংখ্যক মুমিন ব্যক্তি হয়তো পারেন), তা হলো ইনসাফ করা।মাসনা, সুলাসা, রুবায়া করার যে শর্ত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা জুড়ে দিয়েছেন সেটা কেউ দেখে না, তা হলো ইনসাফ করা। এটা সূরা নিসার ৩ নাম্বার আয়াতে এসেছে।

এর শানে নুজুল ছিল,‘একজন ইয়াতিম বালিকার একটি বাগান ছিলো। যে ব্যক্তি ইয়াতিম বালিকার তত্ত্বাবধায়ক হলো, তার ঐ বালিকার চেয়ে বাগানের প্রতি বেশি আকর্ষণ ছিল। একজন লোক ঐ বাগানের লোভে মেয়েকে বিয়ে করে। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ কুরআনে আয়াত নাযিল করেন। সূরা নিসার ৩ নাম্বার আয়াত হলো,

“আর যদি তোমরা আশঙ্কা করো যে, ইয়াতিমদের ব্যাপারে তোমরা সুবিচার করতে পারবে না, তাহলে তোমরা বিয়ে করো নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভালো লাগে; দুজন, তিনজন অথবা চারজনকে। আর যদি ভয় করো যে, তোমরা সুবিচার করতে পারবে না, তাহলে একটি অথবা তোমাদের ডান হাত যার মালিক হয়েছে। এটা অধিকতর নিকটবর্তী যে, তোমরা যুলুম করবে না।”

এই আয়াতের মাধ্যমে বিয়ের সংখ্যা চারে সীমাবদ্ধ করা হয়। এই আয়াত নাজিলের আগে থেকেই সমাজে বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল। এই আয়াতের মাধ্যমে মাসনা, সুলাসা, রুবায়া পর্যন্ত জায়েজ করা হয়। তাই এমন বিয়ে হারাম নয়।কিন্তু অনেকে দ্বিতীয় বিবাহের বিপক্ষে একটা আয়াত দেখান যেটা হলো, সূরা নিসার ১২৯ নাম্বার আয়াত। অথচ এর তাফসীর তারা পড়ে না বা জানেও না।

‘আর তোমরা যতই কামনা কর না কেন তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে সমান আচরণ করতে কখনো পারবে না। সুতরাং তোমরা (একজনের প্রতি) সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকে পড়ো না, যার ফলে তোমরা (অপরকে) ঝুলন্তের মত করে রাখবে। আর যদি তোমরা মীমাংসা করে নাও এবং তাকওয়া অবলম্বন কর তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’

এর তাফসীর হলোঃ

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যার দু’জন স্ত্রী আছে তারপর সে একজনের প্রতি বেশি ঝুঁকে গেল, কেয়ামতের দিন সে এমনভাবে আসবে যেন তার একপাশ বাঁকা হয়ে আছে। [আবু দাউদঃ ২১৩৩]

তবে আয়াতে যে আদল বা ইনসাফের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, “আর তোমরা যতই ইচ্ছে করো না কেন তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি আদল বা সার্বিক সমান ব্যবহার করতে কখনই পারবে না” সেটা হচ্ছে, ভালবাসা ও স্বাভাবিক মনের টান। কেননা, কোনো মানুষই দু’জনকে সবদিক থেকে সমান ভালবাসতে পারে না।

তবে শরীআত নির্ধারিত অধিকার যেমন, রাত্রী যাপন, সহবাস, খোরপোষ ইত্যাদির ব্যাপারে ‘আদল’ অবশ্যই করা যায় এবং করতে হবে। সেটা না করতে পারলে তাকে একটি বিয়েই করতে হবে। যার কথা এ সূরারই অন্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, ‘আর যদি তোমরা আদল বা সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে না পার, তবে একটি স্ত্রীতেই সীমাবদ্ধ থাক’।

সুতরাং মানসিক টান ও প্রবৃত্তিগত আবেগ কারও প্রতি বেশী থাকাটা আদল বা ইনসাফের বিপরীত নয়। কেননা তা মানব মনের ক্ষমতার বাইরে।

[তাবারী, (তাফসীরে জাকারিয়া)

এই তাফসীর থেকে ইনসাফ করার মানে বুঝা যায়। এটা কিন্তু খুব কঠিন নয়। ইনসাফ মানে দুইজন স্ত্রীকে সমানভাবে রাখা, সমান সুযোগ সুবিধা দেওয়া। একই রকম আবাস, একই রকম খাবার, পোশাক দেওয়া। আবার তাদের মাঝে সমান দিন ভাগ করে থাকা।

আমার এক বান্ধবীর দুই মা ছিল। দুই মা একই বাড়িতে থাকত। সে কোন মায়ের তাও আমি জানতাম না। তাদের বাড়িতে ঝগড়া বিবাদ শোনা যেত না। নিঃসন্দেহে সেই আংকেলের ইনসাফ করতে পেরেছিলেন ।

আবার বিপরীত ঘটনাও দেখেছি এবং এটাই বেশি হয়। যার জন্য প্রথম স্ত্রীরা দ্বিতীয় বিয়েটাকে অপছন্দ করে এমনকি ঘৃণাও করে।

এমন একটা ঘটনা, প্রথম বউ প্রেগন্যান্ট তাই স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে। ছোট বউ নিয়ে হানিমুনে ঘোরে, এখানে সেখানে বেড়াতে যায়। বড় বউ অসুখে কাতরায়, তাকে সময় দেওয়া দূরে থাক, টাকা পয়সাও ঠিকমতো দেয় না। ছোটজনকে নিয়ে আনন্দে ভাসে। বড়জন মরল কী বাঁচল খোঁজ রাখে না। এই ধরণের পুরুষ মুসলিম হতে পারে না, এদেরকে কিয়ামতের মাঠে খারাপ অবস্থায় উঠানো হবে।

আরেকটা ট্রেন্ড উঠেছে, গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে করা। এটা আরেকরকমের ফাজলামি। জাস্ট আল্লাহর দেওয়া নিয়ম নিয়ে ফাজলামি করে, এরা মুসলিম কিনা জানা নাই।

ব্যভিচার আর গোপন বিয়ের মধ্যে সামাজিক কোনো পার্থক্য থাকে না। আমাদের ধর্মে বিয়ের কিছু রুলস আছে, সাক্ষী থাকতে হবে, মেয়ের অভিভাবক ওলি (ওলি থাকা না থাকা নিয়ে কিছু মাজহাবে দ্বিমত আছে) থাকতে হবে, পাত্রকে অলিমা করতে হবে সেটা একটা খেজুর দিয়ে হলেও, এর উদ্দেশ্য হলো বিয়ে প্রচার করা। এমনকী বিয়েতে দফ বাজানোর অনুমতি দেওয়া হয়। এসব করা হয় যাতে বিয়ে গোপন না থাকে। আর গোপন বিয়েতে কখনোই ইনসাফ হয় না, কারণ এতে সেই স্ত্রী সামাজিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়।

আমার পরিচিত এক ডিভোর্সী মেয়েকে ইনবক্সে অনেক পুরুষই মাসনা হওয়ার আহবান জানায়। তারা সেই মেয়েকে গোপন বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তাদের উদ্দেশ্য হলো, বড় বউকে সামাজিক মর্যাদা দিয়ে ভালোভাবে রাখবে আর ছোটবউকে যতদিন গ্যাঞ্জাম না হয় ততদিন রাখবে। এদের মতো লোভী, বেইনসাফী, খারাপ লোক আর একটাও নাই।

যারা সত্যিকারের মুমিন, যদি মর্যাদা দিয়ে কোনো অসহায় বিধবা অথবা কুমারি মহিলাকে বিয়ে করে, ইনসাফ করে তাতে নাক ছিটকানো যাবে না। কারণ তিনি হারাম কাজ করে নাই।

পরকিয়া করে দ্বিতীয় বিয়ে করা লোকটা, অথবা গোপনে তামাশার বিয়ে করা লোকটাকে খারাপ বলতে গিয়ে যেন আমরা দ্বিতীয় বিবাহকেই খারাপ না বলি সেটা খেয়াল রাখতে হবে।

দ্বিতীয় বিবাহ হারাম নয়, হালাল। তবে এটা ফরজ নয়। নাক ছিটকিয়ে ঈমান হারাব না। আবার নিজে ইনসাফ না করতে পারলে তা অন্যকে উৎসাহ দেবেন না। যাদের ইনসাফ করার মতো মনোবল আছে, তারা করুক। এতে বাধা দেওয়ার কিছু নাই।

লেখকঃ সাহিত্যিক ও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক 

লেখকের আরও লেখা পড়ুন-

অপরাজিতা

আরও পড়ুন