Ads

বিয়ে ও বোঝাপড়া (পর্ব-৩):মায়ের সঙ্গে বোঝাপড়া

ইমরান হোসাইন নাঈম

আমার এক আত্মীয়া তার একমাত্র ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন। ছেলে তার বড়ই আদরের। বিয়ের আগ পর্যন্ত সে মায়ের হাতে খেত। একমাত্র ছেলে হলে যা হয় আরকি। ছেলের কোন আহ্লাদই অপূর্ণ রাখেন নি তিনি। ছেলেও ছিলো “মামা’স বয়”। অফিস থেকে বাসায় ফিরেই সে সোজা চলে যেত মায়ের ঘরে। মা না-খাইয়ে দিলে ছেলেও খেত না।

তো সেদিন এই আত্মীয়া আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন। কথায় কথায় তিনি বললেন: “বিয়ের আগে ছেলে অফিস থেকে ফিরেই আমার ঘরে আসত। আর এখন আগে যায় বৌয়ের কাছে।”

তার কণ্ঠ কেমন ম্লান ছিলো। তিনি যে ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছেন, সেটা বোঝাই যাচ্ছিল। নিশ্চয়ই তিনি মনে করছিলেন যে, তার ছেলেকে এই মেয়ে কেড়ে নিয়ে গেছে। অথবা এমন কিছুই।

আমাদের দেশের অধিকাংশ মা’ই এমন ধারণা করেন। বিয়ের আগে ছেলে কথায় কথায় মা মা করত। গোসলের সময় গামছা পাচ্ছে না তো, মা গামছা কই। এটা ওটা পাচ্ছে না তো, মা এইটা কই রাখছ। খিদা লাগছে তো, মা ভাত দেও। ইত্যাদি সব কিছুতেই ছেলে মা মা করত বিয়ের আগে। কিন্তু বিয়ের পরই ছেলের এই মা মা করা বন্ধ হয়ে যায়। এখন তার যে কোন কিছু লাগলেই ডাকে বৌকে। ছেলের সব কিছুই এখন বৌয়ের হাতে।

মায়েরা এইসব দেখে ভেতরে ভেতরে কষ্ট পান। তারা ভাবেন, এই মেয়ে তার ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে। তার ছেলে আর তার আঁচলে নেই। এখন সে এই মেয়ের আঁচলে চলে গেছে।

বিয়ের পর ছেলে যদি মায়ের সঙ্গে একটু গলা চড়িয়ে কথা বলে, মা তখন হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। হাপুস নয়নে কেদেকেটে তিনি বলেন: হায় হায় আমার সোনার টুকরা ছেলেটাকে এই মেয়ে জাদু করেছে। ছেলেটাকে বশ করেছে সে। ছেলে এখন আমারে ধমক দিয়া কথা কয়।

অথচ বিয়ের আগেও কিন্তু ছেলে মায়ের সঙ্গে গলা চড়িয়ে কথা বলত—যদিও এটা অনুচিত। তখন কিন্তু মায়ের এমনটা মনে হয় নাই যে, তার ছেলেকে কেউ বশ করেছে। কিন্তু বিয়ের পরই মায়েদের ভেতরে ছেলের বৌ নিয়ে মনটা কেমন কেমন করতে থাকে।

আমার এক বন্ধু নতুন বিয়ে করেছে।

কিন্তু বিয়ে করে সে যেন বিপদেই পড়েছে। সে চাকরি করত দূরে। তার বৌ থাকত বাপের বাড়ি। কিন্তু মাঝেসাঝে আমার বন্ধু তার বৌকে নিজের বাড়িতে রেখে কর্মস্থলে চলে আসত। আর তখনই তার বারোটা বেজে যেত।

বাড়ি থেকে তার মা ঘণ্টায় ঘণ্টায় বৌয়ের নামে নালিশ করত। আবার ওদিকে বৌ-ও তার অবস্থা বলত। তার বৌ অবশ্য নালিশ করত না। কিন্তু কেঁদেকেটে একাকার করে ফেলত।

ঘটনা হলো বন্ধুর মা প্রতি পদে পদে বৌয়ের ভুল ধরত। বৌ এইটা করল কেন! বৌ অমুককে সালাম দিল না কেন! তোর বৌ আমারে এত্ত বড় কথা কইছে! তোর বৌ পানিটা গরম করে নাই! হেনতেন কতো অভিযোগ।

তো একবার বন্ধু বাড়িতে ছিলো। সেই সময়ও তার মা অনলবর্ষী নালিশ বর্ষণ করতে লাগল ছেলের কাছে। ছেলে চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল৷ আর অন্যদিকে সে সামলাচ্ছিল বৌকে৷ যেন কোন অঘটন না ঘটে৷

কিন্তু বৌয়ের সামান্য ভুল নিয়েও তার মা বাড়ি মাথায় তুলতে থাকে। একপর্যায়ে বৌও দুয়েকটা কথা শুনিয়ে দেয়।

শুরু হয় যুদ্ধ!

বন্ধু বেশ নরম মনের মানুষ। সহজে কারও সাতেপাঁচে যায় না। মা-বৌয়ের এই সব দেখে তার ধৈর্য আর বাঁধ মানল না।

এক দিন রাতে সে মায়ের ঘরে গিয়ে বসল। মাকে সে বুঝিয়ে বলতে লাগল যে, মা! তুমি যদি কথায় কথায় ওর ভুল ধরতে থাক তাইলে কেমনে হবে! মানুষ মাত্রই তো ভুল। তুমি যদি ওরে একটুও ছাড় না দেও, তাইলে চলবে কীভাবে! তোমার মেয়ের সঙ্গে কি তুমি এমন করতা! বৌ নিয়া যদি তোমার এতোই ঝামেলা হইব, তাইলে আমারে বিয়া করাইলা ক্যান!

এই বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে দিল আমার বন্ধু। বেচারা নরম দিলের মানুষ। দুই নারীর দেয়া মানসিক চাপের কষ্ট তার চোখ থেকে গলে গলে পড়তে লাগল।

বন্ধুর মা কিছুটা ঠিক হন ছেলের কান্না দেখে ৷

মনে পড়ল আরেক জনের কথা। বিয়ের আগে সে বেশ কয়েক বছর চাকরি করেছে। সেই সময় বাড়িতে একটা টাকাও তাকে দিতে হয় নাই। বাড়িতে প্রয়োজনও ছিলো না।

সেই লোক বিয়ে করল। তার সংসার হলো। বেতনের টাকা এখন আর জমা হয় না। বরং মাসের টাকা মাসেই যাওয়া শুরু করেছে।

ওদিকে তার মা-ও যেন কেমন হয়ে গেলেন। একদিন তিনি অভিযোগ করে বললেন: তুই তো বাড়িতে একটা টাকাও দিস না। সব টাকা বৌয়ের পিছে খরচ করস।

পরের মেয়ের পিছনে ছেলে টাকা খরচ করছে, এমন চিন্তাই হয়ত তার মায়ের মাথায় বাসা বেঁধেছিল। আরও অজস্র মায়েদেরে মাথায়ই এমন ভূত চাপে। তারা ছেলের বৌকে সংসারের একজন হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন না। মনে করেন পরের মেয়ে।

তাই বলি, বিয়ের আগে ছেলেদের উচিত মায়ের সঙ্গে কিছু বোঝাপড়া করা।

মাকে বোঝানো যে, ঘরে যে বৌ আসবে; সে এই ঘরেরই একজস সদস্য হবে। আবার সে-ও একজন মানুষ। তার ভুল হবেই। কিন্তু সেই ভুলকে শুদ্ধ করার নিয়ত রাখতে হবে। প্রতিটা পদে তার ভুল ধরা যাবে না। বৌকে নিজের মেয়ের মতো মনে করতে হবে। আমরা বাড়িতে বৌ নিয়ে আসছি। সে এসে নিজ দায়িত্বেই ঘরের কাজ করবে। আমরা কাজের বুয়া আনছি না যে, সে কোন কাজে ভুল করলেই তাকে জরিমানা করা হবে। বা সারাক্ষণ তাকে ধমকের ওপর রাখতে হবে। তার ভুল থেকেই সে শিক্ষা নেবে৷

অনুরূপ বোনদের সঙ্গেও কিছু বোঝাপড়া করা উচিত। ভাবি আর ননদের দ্বন্দও কম নয়। সুতরাং ভাবিকে সারাদিন অর্ডার দিতে থাকা বোনদের আগেই সতর্ক করে দেয়া উচিত।

আপনার বোন তার ভাবির সঙ্গে কেমন আচরণ করবে, সেটা আগে থেকেই বোঝা যাবে না। তাই তার সঙ্গে সাদামাটাভাবে আলাপ করা যায়। প্রয়োজনে এটাও বলা যায় যে, ধর তোর বিয়ে হলো। তুই শ্বশুড়বাড়ি গেলি। তখন তোর সঙ্গে যদি এমন আচরণ করা হয়, তখন তোর কেমন লাগবে!

এভাবে বললে তাদের চিন্তায় পরিবর্তন আসবে— সময় কম বা বেশি যা-ই লাগুক না কেন।

আপনি মানুন আর না-ই বা মানুন, বিয়ের আগে মা-বোনদের সঙ্গে এই আলাপগুলো করে নেয়া উচিত। আপনি মায়ের সঙ্গে এমন আলাপ করতে গেলে তিনি বলতে পারেন: বিয়ের আগেই দেখি বৌয়ের পক্ষে কথা বলা শুরু করছ। বোনরাও মায়ের সঙ্গে সাঁই দেবে।

কথা তাই খুব বুদ্ধি খাটিয়ে বলা উচিত— যেন ভুল বোঝাবুঝি না হয়৷

বিয়ের পর, মাকে ম্যানেজ করার চে’ বিয়ের আগেই কি তাকে বোঝানো ভালো হবে না? এমন বোঝাপড়া কি আগে করা যায় না?

আমার বন্ধুর মতো সবাই হয়ত মায়ের সামনে হাউমাউ করে কাঁদতে পারবে না। তখন অন্যদের মতো কাঁদতে হবে আড়ালে-আবডালে৷

চলবে……. ইনশাআল্লাহ ৷

বিয়ে ও বোঝাপড়া সিরিজের আগের পর্ব দ্বিতীয় পর্ব-মায়ের সাথে বোঝাপড়া

লেখকঃ শিক্ষক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন