Ads

মুদ্রার ওপিঠে ছেলেরা যেভাবে নিষ্পেষিত হয় !

ফারজানা মাহবুবা

আমরা যারা ‘মেয়েদেরকে’ নিয়ে কথা বলি, মেয়েদের ইস্যুতে কথা বলি, তারা আপনাদেরকে মূলতঃ পয়সার এক সাইড দেখাই। যে সাইডে মেয়েরা কীভাবে ভিক্টিম হচ্ছে।কিন্তু একটু যদি পয়সাকে উল্টিয়ে দেখেন,তাহলে দেখবেন, মেয়েদের এই অবস্থাগুলোর কারণে ছেলেরাও কম সাফার করছে না! পয়সার উলটো পিঠেই স্পষ্ট দেখতে পাবেন আমাদের সমাজে মেয়েদেরকে যেভাবে জন্ম থেকে “শ্বশুড়বাড়ীই তোমার আসল ঠিকানা” বা “বউ আর মা হওয়াটাই তোমার অস্তিত্বের আল্টিমেট কারন”- এগুলো শিখিয়ে পড়িয়ে বড় করা হয়, এর অন্যতম ভিক্টিম কিন্তু আমাদের সমাজের ছেলেরাই।

কারণ বিয়ের পর আপনার আশেপাশেই এমন অনেক মেয়ে পাবেন যার নিজের এম্বিশানকে সে জামাই’র উপর এমনভাবে চাপাতে থাকে, এমনভাবে চাপাতে থাকে, এমনভাবে চাপাতে থাকে; ঠিক যেভাবে গাধার মালিকরা গাধার পিঠের উপর মালের পরে মাল চাপাতে থাকে। বেচারা গাধা তো গাধাই, পিঠ বাঁকা হয়ে গেলেও সেই বোঝা পিঠের উপর নিয়ে ঠিকই দাঁড়িয়ে থাকে। আমি ছেলেদেরকে গাধা বলছিনা, কিন্তু বিবাহিত জীবনের একটা পর্যায়ে গিয়ে ছেলেদেরকে গাধার ভূমিকা নেয়া ছাড়া আর উপায়-ও থাকেনা এমন বউ আর মা’র পাল্লায় পড়লে!

একদিকে মা’ তার ছেলেকে প্রচন্ড রকম স্টাবলিশড দেখতে চায় কারন আমাদের সমাজে একজন মা’র সাকসেস বিচার করা হয় তার ছেলে কী করে, কত টাকা কামায় তার উপর। আবার যদি অমন বউ’র পাল্লায় পড়ে, তাহলে তো কথাই নেই, অমুকের জামাই এত টাকা কামায় অমুক বছরে এতবার ঐ ঐ দেশে বেড়াতে যায় জামাই’র সাথে অমুকের জামাই বিয়ের এনিভার্সারীতে এবার স্বর্ণের দুইটা বালা কিনে দিয়েছে অমুকের জামাই পুরানো গাড়ী বিক্রি করে নতুন গাড়ী কিনেছে মোট কথা, অমুকের জামাই এতকিছু পারলে তুমি কি ঘোড়ার ডিম পাড়ো?!

আমার কাছে আমার জামাই’র দুইটা ক্রেডিট কার্ড আছে। মজার কথা হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের সংসারের প্রথম দিকে যখন নিজে কাজে ঢুকিনি, তখন ওর কার্ড দিয়েই এটা সেটা কিনতাম। তারপর নিজে যখন একসাথে কাজে আর পড়ালেখায় ঢুকলাম, এক একটা ঘন্টা কী পরিমাণ কষ্টের পর পার আওয়ার মাত্র চৌদ্দ/পনের ডলার পেতাম, এরপর থেকে কেনো যেন ওর কার্ড আমি কিছুতেই ওয়ালেট থেকেই বের করতে পারি না। লাষ্ট সাত/আট বছরে একবারও ইউজ করিনি। কার্ড এক্সপায়ার্ড হয়ে গিয়ে নতুন কার্ড আসে। সেই কার্ড আবার সযত্নে ওয়ালেটে রেখে দেই। কিন্তু ঐ কার্ড আর ইউজ করতে পারি না। জামাই’র সাথে সোজাসুজি টেবিলে বসে হিসাব নিকাশ করে সংসারে উইকলি কত খরচ তা ঠিক করে নিয়েছি, জামাই সে স্পেসিফিক টাকা দিয়ে দেয় আমাকে, আমি সে টাকায় সংসার চালাই।

খ্যাঁচ খ্যাঁচ যে করি না, তা না। মাঝে মাঝে থ্রেটস দেই, সপ্তাহের টাকা নেয়া বন্ধ করে দিবো, তখন তোমাকেই সংসার চালাতে হবে! এই স্পেসিফিক টাকার ভিতর একটা সংসারের কত হাভাইত্যা খরচ তখন বুঝবা! জামাই তখন হাত কচলায়ে তেল মারতে চেষ্টা করে। ‘ঐ টাকায় তুমি সংসার চালাতে না পারলে আমি পারবো?! কী যে বলো!’ আর আমি তেল খেয়ে থ্রেটস দেয়া ভুলে কোঁমড় বেঁধে ঠিকই সেই টাকায় আবার সংসার করতে নামি। কিন্তু সেই স্পেসিফিক টাকার বাইরে তার কার্ড থেকে একটা পয়সাও নিতে বাঁধে আমার। এই মানুষটা সেই সকাল সাতটায় বের হয় রাত আটটায় ফিরে। প্রতিটা দিন সে তের ঘন্টা খাটে এই সংসারের জন্য। কীভাবে তার হিসাবের টাকার বাইরে একটা টাকা ধরি? নিজেরই তো কষ্ট লাগে।

নিজেকে ভাল বলছি তা না। কিন্তু আমার আর কিছু থাকুক না থাকুক, অন্য অনেক দিকেই অনেক খারাপ হতে পারি, কিন্তু সিরিয়াসলি, সিরিয়াসলি বলছি, অন্য অনেক মেয়েদের তাদের জামাই নিয়ে যখন অদ্ভুত রকম কমপ্লেইন শুনি’বাড়ী কিনেছে, কিন্তু ভাংগা বাড়ী, কাউকে যে এই বাড়ীতে দাওয়াত দিবো তারই অবস্থা নাই!’

‘গাড়ী একটা একশ’ বছরের পুরানো, এই গাড়ীতে মানুষের বাসায় যেতেও তো ইজ্জতে বাঁধে!

”টেক্সি চালায়, কত করে বলি চাকরিতে ঢুকো, বাচ্চারা মানুষকে কীভাবে বলবে তাদের বাপ টেক্সি চালায়!’

‘ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সে এখন সিকিউরিটীর কাজ করে, অথচ ওর সাথে যারা পাশ করেছে তারা ঠিকই এখানে এসে কীভাবে কীভাবে নিজেদের লাইনেই ঢুকে গেসে! এখন কত বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার! সব আমার কপাল!’

আমি এ কমেন্টসগুলোর এগেইন্সট-এ কিচ্ছু বলতে পারি না। যেভাবে লিখতে পারি, সেভাবে যদি মুখে বলতে পারতাম, তাহলে এই বউগুলোকে ঠিক ঠিক বলতাম,

‘ভাবী আপনি নিজে একটা বাড়ী কেনো ছোট্ট একটা এক টূকরা জমি কিনে দেখান না অস্ট্রেলিয়াতে! কোনো আইডীয়া আছে আপনার এই দেশে যেখানে সোশাল সিষ্টেমই হলো মানুষ যা কামাবে তা উইকলি খরচ করে যেন ব্যাংকে এক পয়সা বাকী না থাকে, কারন ব্যাংকে পয়সা থাকলে তো এই পাবলিক নেক্সট উইক কাজে মোটিভেশান পাবে না! কাপিটালিষ্ট সোসাইটিতে লেবার কোথথেকে আসবে তখন? মানুষ এই দেশে খুব ভালভাবে থাকবে তখনই যখন খুব ভালভাবে গাধার মত কামলা খাটবে সারা সপ্তাহ। এর মধ্যেও, এই সিস্টেমের মধ্যে থেকেও যে আপনার জামাই ভাংগা হোক একটা বাড়ী কিনেছে, আপনি বাংলাদেশে কোন রাজার কোন রাজকন্যা যেন? যার আবার রাজপ্রাসাদ ছাড়া হয়না!’

ঠিক ঠিক বলতাম, ‘এই গাড়ীতে করে মানুষের বাসায় যেতে লজ্জা লাগে, তাওতো আপনার জামাই’র নিজের একটা গাড়ী আছে, পৃথিবীতে কত কোটি মানুষ আছে যাদের গাড়ী দূরের কথা, তিনবেলা পেট ভরে খাবার মত খাবার পায়না, তার কোনো আইডিয়া আছে আপনার মাথায়? কীভাবে থাকবে? আপনার মাথায় তো সব গাড়ী বাড়ী আর সোশাল স্ট্যাটাসের চিন্তায় ভরা!’

ঠিক ঠিক বলতাম, ‘টেক্সি চালাক, সিকিউরিটির কাজ করুক, কাজ তো করছে একটা! সেই টাকাতেই তো আজকে অমুক মনিপুরী শাড়ী, কালকে তমুক বালিহারী বালা, পরশু তমুক গুচি ব্যাগ এসব কিনে ফুটানী মারাচ্ছেন! টাকা যে আসমান থেকে আসে না, রক্ত পানি করে কামাতে হয় তার তো কোনো আইডিয়া নাই আপনার। জীবনে বাচ্চা হওয়ার আগ পর্যন্ত নিজে কয়টাকা কামিয়েছেন শুনি দেখি? জীবনে বাচ্চা হওয়ার আগ পর্যন্ত বা বিয়ের আগ পর্যন্ত নিজে একদম কোন ক্যারিয়ারটা করেছিলেন তা একটু শুনি? কোনোরকমে বি-এ পাশ করেছেন বিয়ে করার জন্য, এখন জামাইকে পেয়েছেন স্ত্রৈন টাইপ, তাই মানুষের সামনেই যা ইচ্ছা তা বলে পার পেয়ে যাচ্ছেন!’

আগে বুঝে পেতাম না, অনেক মেয়েই এমন কেনো! এখন বুঝি, একটা ছেলের মা আর বউ আর কোনোদিকে মিল না থাকলেও এই এক জায়গায় দু’জনের চরম মিল! একজন নিজের ছেলের মাথায় আরেকজন নিজের জামাই’র মাথায় কাঁঠাল ভেংগে খেতে চায়! মাঝখানে পড়ে চিড়ে চ্যাপ্টা হয় ছেলেটা। এক পর্যায়ে সে নিজেই নিজের ক্যাপাসিটিকে কোশ্চেন করে, তাইতো, অন্যরা তো বাড়ী গাড়ী ক্যারিয়ার সবই করে ফেললো, সে কেনো একলাই পিছনে পড়ে আছে?! বোকার মত আরো যে একশটা কারণ আছে সে এখন যেখানে সেখানে থাকার পিছনে, সে কারণগুলো সব ভুলে গিয়ে সে তখন একটাই কারন ভাবে- তার নিজের দোষ!

ভিক্টিমের সেলফ ব্লেইমিং। এই সেলফ ব্লেইমিং এর কারনেই ছেলেগুলো তখন সেলফ ডিগনিটি আর সেলফ রেসপেক্ট হারায়।
বউ তখন মানুষের সামনে তাকে যা তা বললেও, সে গন্ডারের মত ফূঁশফুঁশ করলেও না পারে বউকে কোনো লজিক্যাল উত্তর দিয়ে ঠান্ডা করাতে, না পারে নিজেকে ডিফেন্ড করতে!

পরিণাম? সে বউ একদম নতুন যার সাথে আজকে পরিচয় হয়েছে তাকেও বলে বেড়ায়, ওম্মা! তোমার জামাইকে দেখো আর আমার জামাইকে দেখো! একটা অকর্মার ঢেঁকি আল্লাহ জুটিয়েছে আমার কপালে!

হ্যা, এমন বউ প্রচুর আছে। কিন্তু এদের এই চরম ‘ডিসস্যাটিসফেকশান’ আকাশ থেকে উড়ে এসে এদের সাইকিতে জুড়ে বসেনি।
এই ডীসস্যাটিসফেকশান, এই চরম অতৃপ্তি তাদের মধ্যে আপনি-আমি-আমরাই তৈড়ী করে দেই।

নিজের মেয়ে থাকলে তাকে কনস্ট্যান্টলি বলুন ।নিজের বোন থাকলে তাকে প্রতিদিন মনে করিয়ে দিন ।সে নিজে কিছু চাইলে তার জন্য তাকে নিজেকেই যোগ্য হয়ে নিজের ইচ্ছা পূরন করতে হবে। তার নিজের এম্বিশান তাকেই ফূলফীল করতে হবে, অন্য আরেকজন না। তার ভবিষ্যত জামাই তার লাইফ-পার্টনার, তার চাকর না। জীবনের চলার পথে তার জামাই তার সাথে সাথে পাশে পাশে চলবে, সে তার জামাই’র কাঁধের উপর উঠে চলবে না। তার জামাই ঘোড়া বা গাঁধা বা উঁট না!

নিজের মেয়েকে, বোনকে, মেয়ে আত্মীয়াদেরকে যোগ্য হতে বলুন, যোগ্য হতে সাহায্য করুন। তাদেরকে মেয়ে থেকে মানুষ হতে ইনস্পায়ার্ড করুন। না হলে মেয়েরা যতদিন “শুধু” মেয়েই হয়ে থাকবে, ততদিন বউ’র হাতে এমন ছেলে ভিক্টিমেরও অভাব হবে না আশেপাশে।

 

লেখকঃ মোটিভেশনাল লেখক, সিডনী, অস্ট্রেলিয়া

আরও পড়ুন