Ads

শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী নারীর ক্ষেত্রে ডিভোর্স কেন বেশী হয়?

শারমিন আকতার

যদি পুরুষদের কাউকে প্রশ্ন করা হয় এখন বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ কি? তারা বলবে মেয়েরা শিক্ষিত হওয়া, চাকুরী করা… । সব দোষ  কেন্দ্রীভূত হবে নারীর দিকে ! নারীর দিকে আঙ্গুল তুললেই কি সমাধান হবে? আমাদের এর অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে বের করতে হবে ।
গত ২২ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে ঢাকায় প্রতিদিনে তালাক হচ্ছে ৩৯ জনের । যে হারে বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে তার অধিকাংশই হচ্ছে শিক্ষিত মেয়ের পরিবারে । এমনকি চাকুরীজীবী স্বামী-স্ত্রীদের ক্ষেত্রে তালাকের ঘটনা বেশী ঘটছে । ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের তথ্য বলছে, তালাকের আবেদন বেশী হচ্ছে স্ত্রীর পক্ষ থেকে । উত্তর ও দক্ষিণে তালাকের আবেদনের প্রায় ৭০ শতাংশই স্ত্রীর পক্ষ থেকে আসছে । দুই সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন “আগে মেয়ের তালাক হলে সমাজে নানা আলোচনা হতো, পরিবার মেয়েকে আশ্রয় দিতে চাইতো না । এখন সামাজিক সচেতনতা বাড়ায় মেয়েকে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য পরিবারও মেয়েকে সমর্থন দিচ্ছে ।”

শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী হয়ে উঠলে একজন পুরুষ পরিবার ও সমাজের জন্য সম্পদ হয়ে উঠলে একজন নারী কীভাবে সমাজ ও পরিবারের জন্য ক্ষতিকর ও প্রতিবন্ধক হয়ে উঠে?
যেখানে কোরআনের প্রথম আয়াত “পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন । ”- সূরা আলাক। আমাদের প্রিয় রাসুল বলেছেন “প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য জ্ঞান অর্জন করা ফরজ ।”

বেগম রোকেয়া তার মতিচূর গ্রন্থে বলেন “ যে শিক্ষা অর্জন করে পুরুষ বেআদব হয় না সেই একই শিক্ষা অর্জন করে নারী কীভাবে বেয়াদব হতে পারে ।”
আমি এখানে বলতে চাই শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে আসলে বেয়াদব বা বেয়াড়া হওয়ার বিষয় না বরং শিক্ষিত নারীর পুরুষের প্রভুত্ব করার মানসিকতা মেনে না নেয়া, পুরুষের নারীকে একজন মানুষ হিসাবে মূল্যায়ন না করা ও নারীর স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ না তৈরি হওয়া বিবাহ বিচ্ছদের কারণ ।

শিক্ষিত নারীর বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ আলোচনার আগে আমরা দেখে নেই অশিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত বা আত্মনির্ভরশীল নয় এমন নারীর সংসার টেকে কেন? সেক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের মাত্রা কম কেন ? আমি আমার মায়ের সাথে একবার কথা বলে এর উত্তর পেয়েছিলাম। আমি ছোট বেলায় দেখতাম অকারণে প্রায়ই আব্বা আম্মার গায়ে হাত তুলতো; আম্মার কোন মত সে গ্রহণ করতো না …। দুই বছর আগে আমি একদিন আম্মাকে বললাম আম্মা তুমি কীভাবে আব্বার মতো মানুষের সাথে সংসার করলে? সে বাবা হিসাবে ভালো হলেও স্বামী হিসাবে ভালো ছিল না । এখন যদিও সে বেশ ভালো হয়ে গেছে । আম্মা তখন উত্তর দিয়েছিল । তোদের ছেড়ে কোথায় যাব? যাবার জায়গাতো নেই! ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছে ভাইয়ের ঘরে কি থাকতে পারবো সংসার ভেঙ্গে গেলে? তোদের চার-ভাই বোনের মুখের দিকে চেয়ে থেকে সব কষ্ট সহ্য করে গেছি । এখনকার মেয়েদের মতো যদি চাকুরী থাকতো তাহলে কি আর এতো কষ্ট করতাম? বিয়ের পর তো পড়াশুনাই করতে দিল না । ম্যাট্রিক পরীক্ষাও দিতে দিল না । আম্মার এই যে কথা এর মধ্যে কিন্তু উত্তর রয়ে গেছে। ভারতের “দিল ধারকানে দো” ছবিতে যখন ছেলে মেয়েরা বাবার একক প্রভুত্ব ও স্বেচ্ছাচারিতা মেনে নিতে চাইছিলো না তখন মা ছেলেকে প্রশ্ন করেছিল আমি তো চলছি, মেনে নিচ্ছি কীভাবে? তোমরা কেন পারছ না? ছেলে তখন মাকে উত্তর দিয়েছিল “তোমার যাবার জায়গা নেই তাই মেনে নিয়েছো?”
“এই যে যাবার জায়গা নেই ।” মাথার উপর ছাতা হয়ে আছে স্বামী । বিবাহ বিচ্ছেদ হলে তো তা থাকবে না । তাকে কে খাওয়াবে? কে পরাবে? বিয়ের পর মেয়েদের বাবা বাড়ি পর হয়ে যায়?তাই হাজার কষ্ট হলেও সংসার করে যায় অশিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত বা আত্মনির্ভরশীল নয় এমন নারী স্বামীর প্রভুত্ব ও অত্যাচার মেনে নিয়ে।

এখন আসা যাক শিক্ষিত মেয়ের বিবাহ বিচ্ছেদ কেন বেশী হচ্ছে । একজন অশিক্ষিত নারীর তুলনায় একজন শিক্ষিত নারীর আত্মমর্যাদাবোধ বেশী, সে পারিবারিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশীদার হতে অনেক বেশী আগ্রহী থাকে । সে চায় তার মতামত শোনা হোক, নানা ক্ষেত্রে তার মতকেও একটু গ্রহণ করা হক ।
কিন্তু পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী আমাদের ভাইরা যখন নারীর তথা স্ত্রীর সেই অধিকার খর্ব করেন, স্ত্রীর সাথে তার মতের অমিলকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেন না তখন পরিবারে তৈরি হয় অনাসৃষ্টি ।

এখানে শিক্ষিত নারীর মতামত প্রদানের আকুতি, তার আত্মমর্যাদাবোধ বৃদ্ধি অনেক ক্ষেত্রে পুরুষরা গুরুত্ব দিতে চান না । অশিক্ষিত নারীরা স্বামীকে দেবতার মতো ভাবলেও শিক্ষিত নারীরা কিন্তু স্বামীকে পেতে চায় বন্ধু হিসাবে ।একজন বন্ধু যেমন আর এক বন্ধুর মতামত গ্রহণ করে, যৌথভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সেরকম তার স্বামীও করুক এমনটায় চায় নিজের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হওয়া শিক্ষিত নারী । যে পরিবারে শিক্ষিত নারীর স্বাধীন মতের ব্যাপারটা গুরুত্বের সাথে দেখে কোন স্বামী সেই পরিবারে ভাঙ্গন ধরে না বরং সেই পরিবারের দাম্পত্য জীবনের কাঠামোটা বেশী মজবুত থাকে ।
অবশ্য কোনও কোনও ক্ষেত্রে কিছু কিছু নারীর স্বেচ্ছাচারিতা । বাইরে কাজ করতে গিয়ে ছেলে বন্ধুদের সাথে অন্তরঙ্গ হয়ে উঠাও অনেক ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায় । সামাজিক ও পারিবারিক প্রেক্ষাপটে পুরুষের মানসপট বুঝে না উঠার অক্ষমতাও অনেক ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের অবতারণা ঘটায় । যে পুরুষ ছোটবেলা থেকে তার অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত মাকে পারিবারিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সেভাবে অংশগ্রহণ করতে দেখেননি । সব সময় তার বাবাকে এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে দেখে দেখে বড় হয়েছে । দেখে এসেছে পরিবারের একক আধিপত্য তার বাবার সেই পুরুষ খুব সহজে শিক্ষিত স্ত্রীর সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ বা এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টা ভালোভাবে নিতে পারে না । আর তখনই দেখা যায় বিপত্তি !

এর সাথে আবার অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী স্ত্রী যদি অর্থ ইনকামের পর তার কিছুটা বাবার বাড়ি দেন । বা দিলেও কতোখানি দিবেন? স্বামীকে জানিয়ে দিলেন না না জানিয়ে দিলেন এ নিয়েও চলে মন কষাকষি । আমার এক কলিগ আপুর বিবাহ বিচ্ছেদই হয়েছে শুধু এজন্য যে সে তার ছোট ছোট ভাই বোনের পড়া-লেখার খরচ জোগাতে তার বেতনের বেশ খানিকটা পাঠিয়ে দেয় বাবা-মাকে । আমি আমার ছেলে কলিগদের অনেককেই বলতে শুনেছি “ স্বামী তাকে দয়া করে চাকুরী করতে দিয়েছিল । স্বামী ও তার পরিবার ছাড় দিয়েছিল বলে সে চাকুরী করতে পেরেছে তাই বেতন এককভাবে ভোগ করার অধিকার তার স্বামীর এবং সেই স্বামীর পরিবারের ।”
তাদের এরকম আরও নানা মন্তব্যে আমি অবাক হয়েছিলাম । দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত পুরুষ সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গী হলে অন্যদের কেমন হতে পারে? যে বাবা-মা একটা মেয়েকে ২০-২৫ বছর ধরে খেয়ে না খেয়ে লালন করলো সেই বাবা-মার প্রতি একটা স্বাবলম্বী মেয়ে সন্তানের কোন দায়-দায়িত্ব নেই? সবই শুধু পুরুষরা দায়িত্ব পালন করবে? আদৌ কি পুরুষরা সব সময় দায়িত্ব পালন করতে পারে? সেই ক্ষেত্রেও তো অনেক বাঁধা আসে ! যদিও সমাজ ও পরিবার থেকে পুরুষের সেই দায়িত্ব পালন করতে না পারার দাঁয়ও আসে নারীর উপর । নিজে আয় করে বাবা-মাকে দিলে নারীর দোষ, কিন্তু না দিলে খুব ভালো । স্বামীর আয় স্বামীর বাবা-মাকে দিতে দিলে ভালো, না দিলে খারাপ । কি অদ্ভুত বৈপরীত্য !

একটা বিষয় খেয়াল করে দেখবেন । এক সময় মেয়েদেরকে একেবারেই শিক্ষিত করা হতো না । একই পরিবারে বেড়ে উঠা একটা ছেলে এমএ পাশ করলেও ঐ পরিবারের মেয়েটা ম্যাট্রিক পাশ ছিল কি না সন্দেহ । সময়ের ব্যবধানে মানুষ শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে শিখেছে । ছেলে-মেয়ে উভয়কে শিক্ষিত করে গড়ে তুলছে ।
এখন শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে নিম্নবিত্ত ছেলে-মেয়েতে বৈষম্য করলেও উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারে ছেলে-মেয়েতে তেমন বৈষম্য করে না । যে মেধাবী তাকে শিক্ষিত করানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চলে বাবা-মায়ের ।

এখন মেয়েদের স্বাবলম্বী হবার লড়াইয়ের সময় । এখন মেয়েদের শিক্ষা অর্জনের জন্য কিছু বলতে হয় না ।শিক্ষাটার গুরুত্ব বুঝে শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে একজন ছেলে চায় না তার স্ত্রী চাকুরী বা ব্যবসা করুক । সে নিজের পায়ে দাড়িয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠুক । তারা চায় স্ত্রী শুধু তার সংসার ও সন্তান নিয়ে ব্যস্ত থাকুক । সৃষ্টিকর্তা নারী-পুরুষে কাজের বিভাজন গড়ে দিয়েছেন । পুরুষ কাইয়ুম (পরিবারের দায়িত্বশীল) হয়ে আয় রোজগার করে পরিবারের ভরণপোষণ করবে আর নারী সংসার ও পরিবার সামলাবে । এটাই হয়তো সৃষ্টিকর্তার দায়িত্ববণ্টন । ইকোনমিক্সের  “শ্রম বিভাজনের” ত্থিওরিতে নাকি কিছুটা এরকম ইঙ্গিত পাওয়া যায় ।
কিন্তু অর্থ ইনকামের কারণে অধিকাংশ পুরুষের অন্যায় আধিপত্য এবং স্ত্রীর প্রতি করা অবিচার আর শিক্ষিত মেয়েদের মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে । যেহেতু শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্যই পুরুষরা সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী, তাই তারাও অর্থ আয়ে আগ্রহী হয়ে উঠছে ।

একটা কথা হলফ করে বলতে পারি যদি পুরুষরা স্ত্রীর সাথে সেরকম আচরণ করতো যেরকম আচরণ করেছেন আমাদের রাসুল তখন কোন স্ত্রী অর্থ আয় করতে গিয়ে নিজের উপর অধিক দায় চাপিয়ে নিতো না । ঘরে- বাইরে দুই দিকে সামলাতে গিয়ে একজন চাকুরীজীবী বা ব্যবসায়ী নারীকে কতোটা কষ্ট করতে হয় তা সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন ।
আমাদের সমাজে ভাইদের আচরণের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করলে দেখবেন ভাই চায় তার বোন চাকুরী করুক যেন তার স্বামী তার সাথে অন্যায় করলে সে কিছু করে খেতে পারে কিন্তু সেই ভাই কিন্তু তার বউকে চাকুরী করতে দিতে চায় না । কারণ স্ত্রী চাকুরী করলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ করতে চাইবে যা অনেক ক্ষেত্রে মেনে নেয়া যায় না । কেউ চাকুরী করতে দিলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণের অধিকার দিতে চায় না । স্ত্রীর মতামত গ্রহণ করতে চায় না ।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি বিবাহ বিচ্ছেদের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে  এক্ষেত্রে শিক্ষিত পুরুষ ও নারী উভয়ের দায়িত্ব রয়েছে । পুরুষের দায়িত্ব হল নারীকে স্বাধীন সত্ত্বা হিসাবে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা । তার বহু বছর আগে জীবন যাপন করা নিজের মায়ের মতো তার স্ত্রীও সারাক্ষণ স্বামীর একক আধিপত্য ও সিদ্ধান্ত মেনে নিবে এমন প্রত্যাশা না করে যৌথভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ গ্রহণ করা । একের সাথে অন্যের যে মতের অমিল সেটাকে সহজভাবে গ্রহণ করা ।
অন্যদিকে নারীর দায়িত্ব হচ্ছে অর্থ আয় করে বলে স্বেচ্ছাচারিতার পথে না যাওয়া । যৌথভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে স্বামীকে সুকৌশলে উদ্বুদ্ধ করা । পুরুষের মানসিক অবস্থা বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও মতামত প্রদানে অংশগ্রহণ করা ।

লেখকঃ সাহিত্যিক ও সম্পাদক, মহীয়সী

আরও পড়ুন