Ads

সংসার

জাকারিয়া জ্যাক

হাসান সাহেবের ঘুম আসছে না। ঘুম না আসার জন্য কয়েকটা কারণ আছে। তা হল, ফ্যানের ঘরঘর শব্দ, আর কেমন একটা বোটকা গন্ধ। মিস্ত্রী আনিয়ে ফ্যান ঠিক করা হয়েছিল কিন্তু একসপ্তাহ যেতে না যেতেই আগের মতই অবস্থা। আর গন্ধটা আসছে হাসান সাহেবের স্ত্রী আমেনার গা থেকে। আমেনা দিনদিন স্থূলাকার হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের সময় আমেনার ওজন ছিল মাত্র পঁয়তাল্লিশ কেজি আর এখন একশ কেজির কাছাকাছি। আর যাইহোক একটা হাতির পাশে ঘুমানো যায় না। আর সেই প্রথম থেকেই আমেনার শোয়া ঠিক নেই। শাড়ি হাটুর উপরে উঠে যায়। মাঝেমাঝে তো গাবদা দাপনা বের হয়ে যায়। নিজের স্ত্রী হলে কী হবে, দেখতে খুবই কুশ্রী লাগে। আর আমেনার নিঃশ্বাস নেওয়ার শব্দটাও খুবই অদ্ভুত। মনে হয় তার নাকের মধ্য দিয়ে গরুর গাড়ি যাতায়াত করছে। নাক ডাকার শব্দে মাথার শিরা দাপাদাপি করে। সারাদিন কাজ করায় আমেনার গা থেকে এক ধরণের বোটকা ঘামের গন্ধ আসে। মাঝেমাঝে এই গন্ধে পেট উল্টিয়ে বমি আসে। কেন যে সে রাতে সাবানডলা দিয়ে গোসল করে না?

হাসান খাট থেকে নামল। চা খেতে ইচ্ছা করছে। রান্নাঘরে গিয়ে কেটলি নিতে গিয়ে পড়ে গেল। শব্দ শুনে আমেনা উঠে এল।
-কী হয়েছে? এতরাতে রান্নাঘরে কী কর?
-চা খেতে ইচ্ছে করছে। ঘুম আসছে না তো, তাই।
-তুমি বস, আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি।
হাসান বারান্দায় এসে ইজিচেয়ারে বসল। সিগারেট ধরিয়ে টানতে শুরু করল। খকখক করে কাশি শুরু হয়ে গেল। এই বয়সে কোনকিছুই ভাল লাগে না। হয়তো চা খেতে গিয়ে দেখা যাবে চিনি বেশি হয়ে গেছে। ঘর কাপিয়ে কিছুক্ষণ কেশে গলা পরিষ্কার করে সিগারেট শেষ করল। তখনি আমেনা দুইকাপ চা নিয়ে এসেছে। একটা কাঠের চেয়ার টেনে হাসানের পাশে বসল।
-দেখ, চিনি ঠিকমতো হয়েছে কী না।
-হুম।
-তুমি এখনো চা মুখে দাওনি, না দিয়েই বুঝলে চিনি ঠিক হয়েছে? চা মুখে দাও, তারপর বল।
হাসান বাধ্য স্বামীর মত চায়ে চুমুক দিল। আসলে চাটা খুব ভাল হয়েছে।
-বিস্কুট আছে, এনে দিব? তুমি তো আবার চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে খেতে পছন্দ কর।
-দাও।
আমেনা বিস্কুট এনে দিল। হাসান বিস্কুট চায়ে ভিজিয়ে খাচ্ছে। আর আমেনা শুধু চা খাচ্ছে। আমেনার চা খাওয়াটা খুব বিশ্রী। এমন শব্দ করে কেউ চা খায়?
হাসান কিছু বলছে না। চা শেষ করে কাপটা ধরে আছে।
-কাপটা রাখ, হাতে ধরে আছ কেন?
-এমনি।
-তোমার ঘুম হয় না কেন?
-আমি কিভাবে বলব?
-তুমিই বলবা। কারণ ঘুমটা তোমার হয় না।
-ফ্যানের শব্দে আর….
-আর কী?
-কিছু না।
-তুমি কি বুঝতে পারছ আমাদের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে?
হাসান জবাব দিল না। চুপ করে আছে।
-একটা জিনিস জান? বিয়ের প্রথম দিকে স্বামীস্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব থাকে কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে দূরত্ব কমে যায়। কিন্তু আমাদের প্রথম থেকে কোন দূরত্ব ছিল না। এখন অনেকটা দূরত্ব। মাঝেমাঝে মনে হয়, তুমি আমাকে চেনই না।
-না, এরকম কিছু না।
-তোমার কি মনে হয় আমি কিছুই বুঝি না?
-এতরাতে এসব কথা বলছ কেন?
-চিৎকার কর না। পাশের ঘরে তোমার ছেলে আর ছেলের বউ আছে। তারা যদি জানে আমরা মাঝরাতে এই শেষবেলায় এসে ঝগড়া করছি এটা কি ভাল দেখাবে?
-তুমি বোঝ না। তুমি শুধু তোমার সংসার বোঝ, আর কিছুই না।
-তুমি তো সংসারও ঠিকমতো বোঝ না। নিজের হাতে আমি এই সংসার সাজিয়েছি।
-আমি সংসার বুঝি না?
-না। তুমি শুধু বোঝ তোমার পেশা। আর বাজারঘাট। এখন তো শুধুই বাজারে গিয়ে চায়ের দোকানে দিন কাটে তোমার। রিটায়ার্ড করার পর তুমি আরও বেশি বিরক্তিকর হয়ে গেছ।

স্ত্রীর মুখে এমন কঠিন কথা শুনে হাসান খুব অবাক হচ্ছে।
-আমি আগে বিরক্তিকর ছিলাম?
-হ্যাঁ। তুমি তোমার শিক্ষকতা পেশার জন্য সবাইকে তোমার স্টুডেন্ট মনে কর। শিক্ষকদের কাছে স্টুডেন্ট অবুঝ। আর স্টুডেন্টের কাছে শিক্ষক বিরক্তিকর একটা জিনিস।
-আমি তোমার সংসারের…..
-আমার কথাগুলো শেষ করতে দাও। অনেকদিন থেকে ভাবছি বলব কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না। আজ বলি। নিজেকে হালকা করি।
-ওকে বল।
-তুমি কি জান তোমার বেতন দিয়ে সংসার ঠিকমতো চলত না। তোমার ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, তাদের পোশাকআশাক, মেহমান এলে অতিরিক্ত খরচ কোথা থেকে আসত? জান না। একটা স্ত্রী পারে এইসব ম্যানেজ করতে। আমি তোমার সংসারে গাধারখাটুনি খাটলাম। আজ তুমি আমাকে দেখতে পার না। আমি মোটা হয়ে গেছি। গা থেকে গন্ধ আসে। তোমার মনে তো এসব ঘোরে, তাই না?
-তুমি কিভাবে বুঝলে?
-আগেই বললাম। আমি বুঝতে পারি। তুমি আমাকে বোকা টাইপের স্ত্রী ভাব। আসলে আমাকে বোকা হয়ে থাকতে হয়। কারণ বোকার কোন শত্রু নাই। আর বোকা না হলে সংসার টিকতো না। অন্তত তোমার সাথে। কারণ বোকার সাথে বোকার মত হয়ে অভিনয় করতে হয়।
-আমি বোকা?
-শুধু বোকা না, তুমি মহাবোকা।
হাসানের হাত কাঁপছে। সে সিগারেট ধরাতে গেল। কিন্তু হাত কাঁপার জন্য ঠিকমত দেশলাই জ্বালাতে পারল না। আমেনা দেশলাইটা নিয়ে সিগারেট ধরিয়ে দিল।
-তুমি যে এই বিশ্রী জিনিসটা খাও। কখনো ভেবে দেখেছ, আমি এইটা পছন্দ করি কি না? সিগারেট খেয়ে যখন আমার পাশে আসো, আমার পেট উল্টিয়ে বমি আসে। আমি তা সহ্য করি। আমার কোনকিছু তুমি সহ্য কর না। কেন?
-আমি আসলে….
-কী? থেমে গেলে কেন? আসলে তুমি নিজেও এর উত্তর জান না। একটা জিনিস মনে কর তো, আমাদের বিয়ের পর থেকে তুমি আমার পছন্দের কী কাজ করেছ?
হাসান কিছুক্ষণ ভেবে মনে করতে পারল না যে সে আমেনার পছন্দের কী করেছে।
-মনে পড়ে? কারণ তুমি জানই না যে আমার পছন্দ কী।
-একটা সংসার, একটা সম্পর্ক টিকে থাকে স্যাক্রিফাইজ আর কম্প্রোমাইজ এর জন্য। আমি আমার পুরো জীবনটাই তোমার জন্য স্যাক্রিফাইজ করলাম কিন্তু তুমি…..
-তুমি কী স্যাক্রিফাইজ করেছ?
আমেনার চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে রাগে আর ক্ষোভে।
-আমার যখন বিয়ে হয়, তখন আমি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করি। আমার ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া শেষ করা। একটা চাকরি করা। কিন্তু তুমি কী বললে? লেখাপড়া করে কী হবে? তুমি একজন শিক্ষক হয়ে এই কথা বল। ছি!
হাসান কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে ভাবল তার জীবনের অতীত। সে উপলব্ধি করতে পারছে আসলে জীবনে সে কখনো আমেনাকে বুঝতে পারেনি। নিজের মত করে চলেছে। এই সংসার, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, তাদের বিয়ে সবকিছু তো আমেনাই করেছে? সে নিজে কিছুই করেনি।

চোখ খুলে আমেনার হাত ধরে নিজের কোলের উপর রাখল। বলল, আসলে আমি কখনো তোমাকে বুঝতে পারিনি। এটা আমার ব্যর্থতা। কিন্তু তুমি তো আমাকে বলতে পারতে, হাসান এইটা কর, ওইটা কর না। কেন বলনি? আজ আমাদের এই শেষবেলায় এসে কেন বলছ? আগে বলনি কেন?
আমেনা কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগল, কারণ আমি আশা করেছিলাম তুমি বুঝতে পারবে। কিন্তু তুমি বোঝ নি।
-আমাকে ক্ষমা করে দাও। বাকি কয়টা দিন না হয় বুঝে নিব।
-ছি! তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছ কেন?
-কারণ আমি অপরাধী।
-আচ্ছা বল তো, আজ একটা বিশেষ দিন।
-মনে করতে পারছি না।
-তুমি এটা কিভাবে ভুলে যাও?
-আজ….. আজ…..
-না, মনে করতে পারছি না। বল, আজ কী বিশেষ দিন?
-আমাদের বিবাহবার্ষিকী।
-তাই? আজ আগস্টের আটাশ তারিখ? ভুলেই গেছি।
-এ আর নতুন কী?
হাসান আমেনার হাত জড়িয়ে ধরে রোমান্টিক গলায় বলছে, শুভ বিবাহবার্ষিকী।
-এই ছাড় তো, এই মাঝরাতে তোমার ভালবাসা উতলিয়ে পড়ছে!

বারান্দার লাইট জ্বলে উঠল। হাসানদের ছেলে আর ছেলের বৌ একটা প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এগিয়ে এসে বলল, আব্বু, তোমরা এই মাঝরাতে যা শুরু করছ। ভাবলাম সারপ্রাইজটা সকালে দিব। তা আর হল না। হ্যাপি ম্যারিজ এ্যানিভার্সারি। আব্বু, মাঝরাতে তোমার রোমান্টিক কণ্ঠটা সত্যিই দারুণ লাগছে। আর মা, তুমি তো বিশাল ভাষণ দিতে পার। যাক, তাহলে এখন আর বোকার অভিনয় করতে হবে না। হাহাহা। আর শোন, আগামীকাল তোমরা ঘুরতে যাবে। ঠিক আছে?
হাসান আর আমেনা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। একসাথে দুজন বলে উঠল, ঠিক আছে।
বলেই দুজনের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল।

লেখকঃ কবি ও সাহিত্যিক

 

আরও পড়ুন