Ads

সম্পর্কহীন সম্পর্ক

খলিলুর রহমান

আমাদের জীবনেরর সব কিছু পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক হয় না। তবে যাপিত জীবনে কত-শত স্বপ্ন আমরা মনের গহনে পুষে রেখে পথ চলি! জানা হয় না। জানানোও হয় না। আমাদের চর্মচক্ষুর বাইরের জগতের মতো হৃদয়ের গভীরে আছে আরেক জগত। সে জগতের অস্তিত্ব সবাই উপলব্ধি করে ঠিক, কিন্তু খুব সহজে প্রকাশ করতে পারে না। হয়ত কখনো সখনো কোনো কবি, গল্পকার কিংবা ঔপন্যাসিক আমাদের দেয় সে সুবিশাল মনোজগতের সন্ধান । পৃথিবীতে যতগুলো সম্পর্ক আছে তার মধ্যে সবচেয়ে গভীরতম সম্পর্ক গুলোর একটি হলো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। এই সম্পর্ক যদি গভীর ও গাঢ় হয় তাহলে এই নশ্বর পৃথিবীও মনে হবে স্বর্গরাজ্য। সুখ বইবে জীবনের সর্বময়। স্বপ্নময় দিন গত হবে অতিসহজে। জীবন কখনো তৃষ্ণাতুর হবে না। জীবন কখনো কষ্টকর মনে হবে না।

স্বামী-স্ত্রী দুজন দুজনার হলেই শান্তির বাতাস বহে জীবনের আকাশে। অর্থবিত্ত আর ঐশ্বর্য কিন্তু সাংসারিক জীবনের মূল চাবিকাঠি নয়। চাবিকাঠি হলো দুজনের বনিবনা, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা। একজন আরেকজনের পৃথিবী হওয়া। স্বামীর ভেতর স্ত্রী তার নিজের পৃথিবী খুঁজে নেয়া, স্ত্রীর ভেতর স্বামী তার নিজের পৃথিবী খুঁজে নেয়া। একজন ছাড়া অন্যজন দিশাহারা হওয়া।

হাজার বছরের জীবনযাত্রায় পৃথিবী এর প্রমাণ দেখেছে বহুবার; লক্ষকোটি টাকার সংসারও দুজনের অনলে পুড়ে ছাই হয়েছে, আবার শূন্যপাতার পথের ধারের সংসারও হয়েছে স্বর্গময়।

স্বামী স্ত্রী সম্পর্কটি খুবই মধুর এবং নাজুক। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কও জীর্ণ হয়, পুরাতন হয়, নিরস হয়। কঁচি সবুজ পাতায় সময়ের সাথে-সাথে যেমন হলদে ভাব চলে আসে – তেমনি দাম্পত্য সম্পর্কেও আসে ক্লান্তি, আসে অবসাদ। তাই সম্পর্কের যত্ন নিতে হয় প্রতিনিয়ত।

সম্পর্কের উপাদান প্রয়োগে একে নিত্য নতুন রুপদান করতে হয়। এক বুক ভালোবাসা রেখেও কারো-কারো হৃদয়ের হাহাকার কাটে না। একই ছাদের নিচে থেকেও দুই জোড়া শালিক ভোগে চরম একাকীত্বে। কেন এমন হয়? কী করে উথালপাথাল করা আকুতিগুলো সময়ের সাথে সাথে হোঁচট খায়? কেন এত কাছাকাছি থাকার পরেও একজন অপরজনকে বুঝতে পারে না? মনোজগতে কেমন করে এতটা দূরত্ব তৈরি হয়?

এই সবকিছুর মূলে ও গোড়ে দুজনার সৌজন্য আচার আচরণ, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, ভালবাসা, বিশ্বাসই পারে দুজনার জীবনকে শান্তিময় করতে। তবে আমাদের সমাজে সাহেব-বেগমদের মধ্যে এ সব গুনাবলীর উপস্থিতি শূন্যের কোঠায়। তাইতো দাম্পত্য কলহে সংসার ভাঙনের করুন সুর সর্বত্র শোনা যায়। অামাদের চারপাশে সংসার জগতে স্বামী-স্ত্রীর অমিল, অবিশ্বাস, একে অপরে অশ্রদ্ধা, মনোমালিন্য প্রকট অাকার ধারন করেছে। অতিরিক্ত মোবাইল অাসক্তি, ভারতীয় টিভি সিরিয়াল, ফেসবুকে অচেনা অজানা লোকের সাথে প্রেমও অনেকাংশে সংসারে অশান্তির জন্য দায়ী।

মাঝে মাঝে স্বামী-স্ত্রীর ছোট খাটো সমস্যাগুলো এক সময় এত প্রবল হয় যার পরিনতি বিচ্ছেদে শেষ হয়। আমার কাছে এই বিচ্ছেদটা খুব কষ্টকর। কারন দুজন নর নারী যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তখন শুধু তারাই একটি বন্ধনে আবদ্ধ হয় না তাদের সাথে আরো দুটি পরিবারের সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। এই সম্পর্কটি যখন ভেঙ্গে যায় তখন শুধু দুটি নর-নারীর সম্পর্কের বিচ্ছেদ হয় না তার সাথে সাথে দুটি পরিবারেরও বিচ্ছেদ হয়।

কখনো কখনো এই বিচ্ছেদের কষ্ট এড়াবার জন্য একটি সম্পর্কহীন সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। কারন একটি বিবাহিত যুগলের সম্পর্কের মুল মন্ত্র হচ্ছে ভালবাসা এবং বিশ্বাস, সেই ভালবাসা এবং বিশ্বাস যখন পালিয়ে যায় তখন এই ভালবাসাহীন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা ভীষন কঠিন হয়ে পরে সেই ভালবাসাহীন যুগলের মধ্যে।

অনেক সময় অনেক স্বামী এবং স্ত্রী সমাজ, সন্তান এবং পরিবারের কথা চিন্তা করে সম্পর্কহীন সম্পর্কে জীবন কাটিয়ে দেয় নিজেদের সন্তানের কথা চিন্তা করে।

যারা সবাইকে খুশী ও সন্তানদের কথা মাথায় রেখে এই সম্পর্কহীন সম্পর্কে জীবনকে উৎসর্গ করেন তাদের প্রতি দুই পরিবারের সকলের শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা থাকে। কারণ মানুষের জীবন একটি এবং অতি ক্ষনস্থায়ী। সেই ক্ষনস্থায়ী জীবনকে যারা একমাত্র বাচ্চাদের অনাগত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সম্পর্কহীন সম্পর্কে বেঁধে রাখে তাদের স্যালুট জানাতেই হয়।

মোদ্দাকথা হচ্ছে……….সুখময় সংসারকে জান্নাতের সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। অশান্ত ও কলহ-বিবাদে জড়ানো পরিবারের তুলনা শুধু জাহান্নামের সঙ্গে চলে।

পারিবারিক জীবনে সুখ, শান্তি ও কল্যাণ পেতে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক আন্তরিকতা ও ভালোবাসার পাশাপাশি প্রিয় নবী (সা.)-এর নির্দেশিত পথ ও পদ্ধতি অবলম্বনের কোনো বিকল্প নেই। সংসারের সুখের জন্য স্বামী-স্ত্রী দু’জনের পালনীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় ফলো করলে ভংগুর সম্পর্ককে অারো শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব…..

স্বামীর দায়িত্ব:-
জীবন সংগিনীর উদ্দেশ্যে মনের ভালবাসা মুখে প্রকাশ করা
স্ত্রীর সামনে নিজেকে পরিপাটি রাখা
স্ত্রীর প্রতি সব সময় আন্তরিক থাকা
স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করা
স্ত্রীর মনোরঞ্জন করা
স্ত্রীর কাজে সহযোগিতা করা
পরিবারের সঙ্গে অধিক সময় কাটানো
সঙ্গিনীর সংগে পরামর্শ করে সকল কাজ করা
পরিবারে সুখ শান্তির জন্য অাল্লাহর কাছে দোয়া করা
মাঝে মাঝে স্ত্রীর জন্য গিফট কিনে নিয়ে আসা

স্ত্রীর দায়িত্ব:-
সব সময় স্বামীকে সম্মানের চোখে দেখা
স্বামীর অাদেশ পালন করা
স্বামীকে কষ্ট না দেয়া
স্বামীর প্রতি সর্বদা সন্তষ্ট থাকা
স্বামীর জন্য সাজগোজ করা
স্বামীর দোষত্রুটি গোপন রাখা
স্বামীর আত্মীয় স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক রাখা
বিপদের সময় স্বামীর পাশে দাঁড়ানোা
স্বামীর কৃতজ্ঞতা স্কীকার করা
সামর্থ্য অনুযায়ী কোন কিছুর অাবদার করা
অযথা সন্দেহ পরিত্যাগ করা
স্বামীর সম্পদের হেফাজত করা
সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা

সুখী দাম্পত্য জীবন গঠনে স্বামী-স্ত্রীকে তাদের পারস্পরিক দায়িত্ব ও অধিকারগুলোর প্রতি যথাযথ ভূমিকা পালন করা জরুরি।

পরিশেষে….দাম্পত্য জীবনকে সুখ-শান্তি ও আনন্দময় করে তুলতে হাদিসে রাসুলের অনুকরণ ও অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই। আসুন আমাদের দাম্পত্য জীবনে রাসুল (সা:) এর দাম্পত্য জীবনের মতো করেই রাঙিয়ে নিই। গড়ে তুলি আদর্শ সমাজ। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন। আমিন।

লেখকঃ কলাম লেখক ও ব্যাংকার

লেখকের প্রকাশিত আরও লেখা-

জোরুজালেমে রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে হযরত ওমর (রা:) এর অনুভুতি

নারীর শব্দহীন কান্না

 

আরও পড়ুন