Ads

অন্তুকে ছাড়া আমি খুব অসহায়

এইচ বি রিতা

চলে যাবার আগের বছরেও অ‌ন্তু তার ফেসবুক স্টেটাসে বাবাকে লিখেছিল,”শুভ বাবা দিবস বাবা। সারাদিন রাত কঠোর পরিশ্রম করে পরিবারের জন্য তুমি যে সমস্ত ভালোবাসা এবং সমর্থন দিয়েছো, তার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তোমার কাছ থেকে আমার অনেক কিছু শেখার আছে। তোমার থেকে কঠোর পরিশ্রমী হতে শিখছি আমি, কারণ তোমার অনেক ধৈর্য ও উত্সর্গতা রযেছে যা আমি কখনও কল্পনা করতে পারি না। মনে রাখবে বাবা, সমস্ত কঠিন সময়গুলোতে সব সময় হাসি এবং শক্ত মনোবল নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আমি তোমাকে ভালোবাসি বাবা।”

ইংরেজিতে লিখা স্টেটাসটা ছিল এমন, “Happy Father’s Day! Thank you for all the love and support you give us for the family, continuously working hard day and night. I have a lot to learn from you and work as hard as you because you have a lot of patience & dedication more than I can imagine sometimes. Remember through all the challenges & tough times to keep smiling and keep moving forward. I love you.”

ইকবাল ইসলাম এর দুই সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে সায়েম শাহরিয়ার ‌অন্তু আজ আর নেই। অথচ গত বছরও বাবা দিবসে ফুল এবং প্রিয় উপহার হাতে সে ছিল বাবার পাশে। ২৯ সেপ্টেম্রব, ২০২০ সড়ক দুর্ঘটনায় চিরতরে বিদায় নিতে হয় ‌অন্তুকে।

বাবা তো বাবাই। পরিবারের মূলভিত্তি। বাবা যেন রোদে পোড়া থেকে জমিনটুকু বাঁচাতে মাথার উপর বিশাল গাছের ছায়াটুকু। বাবারা তো এমনই হন, নিজে পায়ে হেঁটে অফিস গিয়ে সন্তানকে স্কুলে যেতে রিকশা ভাড়া যোগান। পুরনো জুতো পড়ে বছরের পর বছর পার করেন, কিন্তু সন্তানের জন্য নতুন জুতো জোড়া চাই। সন্তানের কাঁধে হাত রেখে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। নিজের ব্যক্তিচিত্তের সকল স্বপ্ন ঝেড়ে ফেলে সন্তানের উজ্জল ভবিষ্যতে শরীর-মন ভেঙ্গে পরিশ্রম করেন।ভাঙা চশমায়র ফাঁকে দেখেন সন্তানের রঙিন ভবিষ্যত।

অথচ অ‌ন্তু ‘র বাবাকে ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হয়নি, ছেলেই বাবাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল। নিউজার্সি, নিউইয়র্কে পিতার ইনভেস্টমেন্ট বাড়িগুলোর সম্পূর্ণ দায়িত্ব কাঁধে নিতে যাচ্ছিল অন্তু। গ্রীষ্মের দিনে লং আইল্যান্ড বাড়ির বিশাল সুইমিং পুলটি অপেন করতে কি কি উপকরণ যোগান দিতে হয়, আজ তার বাবা সে সবের কিছুই জানেন না; এসবই ছিল ‌অন্তুর কাজ। ইকবাল ইসলাম ভেবেছিলেন, মেয়ে ছোট, ছেলেটাই তার শক্ত খুঁটি। ভেবেছিলেন সব ছেলের হাতে তুলে দিয়ে এবার বিশ্রাম নিবেন।

কিন্তু না! ‌অন্তু নিজেই বিশ্রামে চলে গেল। আর তার বাবাকে সব কিছু নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে। পুত্র হারানের শোক তাকে অসহায় করে তুলছে। এতসব বাড়ি-সম্পদ কিছু‌ই আজ তার কাছে ‌অর্থবহ নয়। যা ছিল, যা আছে, সব থেকে তিনি গুটিয়ে নিচ্ছেন জীবন। ভাবছেন, ছেলেকে স্মরণে রাখতে পৃথিবীকে কিছু একটা দিয়ে যেতে হবে। ভারাক্রান্ত হ্নদয়ে তিনি বলেন, ‘ছেলে নাই। কে দেখবে এসব? নদীতে মাঝি নাই! নৌকা কে চালাবে? নৌকা বিক্রি করে দিতে হবে। মাঝি ছাড়া নৌকা ডুবে যাবে।’

আমেরিকাতে জন্মগ্রহণকারী অ‌ন্তু ছিল নিউইয়র্কে বাংলাদেশ স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন অব নিউইয়র্ক এর সদস্য। ফার্মিংডেল কলেজ থেকে কম্পিউটার সফটওয়ারে ২০১৮ সালে গ্র্যাজুয়েশন করেছিল। গ্র্যাজুয়েশনের পর অন্তু ইনফর ইন্টারন্যাশনাল (Infor International)নামে একটা কোম্পানীতে এক বছর চাকরী করার পর কুয়্যালকম(Qualcomm) নামে একটা বড় কোম্পানীতে অনেক ভালো একটি চাকরী পেয়ে যায়।

পাশাপাশি সে ‘VISIUNITE INC.’ নামে একটা সফ্টওয়ার ব্যবসাও আরম্ভ করেছিল। গত বছর অক্টোবর মাসে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি আইটি ফার্মে যোগদানের কথা ছিল তার। পরিবারকে একা রেখে ক্যালিফোর্নিয়া যেতেও ভাবছিল অ‌ন্তু। বলেছিল বাবাকে, ‘বাবা। আমি সেটল হলেই তোমাদেরও আমার কাছে নিয়ে আসবো।’

টেক প্রফেশনাল অন্তু ছিলেন একজন সঙ্গীতশিল্পী। আমেরিকায় বেড়ে ওঠা অ‌ন্তু ‘র নিবিড় যোগাযোগ ছিল বাংলা সংস্কৃতির সাথে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করা, কবিতা আবৃত্তি করা ছিল তার পছন্দ। অনেকেই অন্তুর এই অভাবনীয় মেধা, কৃতীত্ব ও সাফল্য দেখে অবাক হয়ে তার বাবাকে বলতেন,
‘ছেলেটা ‌অন্যরকম! ছেলেটা ‌অনেক দুর যাবে।’ নিউইয়র্কে বাংলাদেশী স্টুডেন্টদের উদ্যোগে আয়োজিত ব্লাড ডোনেশনসহ বিভিন্ন আত্মমানবতার সেবায় কাজ করতো অন্তু।

ছেলেটা ক্যালিফোর্নিয়া যাত্রায় লাগেজ গুছিয়েছিল, সে লাগেজে ছিল তার কোরআন, টুপি, জায়নামাজ। সেগুলো আজ এমনই আছে। নেই শুধু মানুষটা।

ইকবাল ইসলামের কাছে আজ বাবা দিবস অমূলক। কে দিবে আজ তাঁকে শুভেচ্ছা বানী, কে দিবে সকল দায়ীত্ব কাঁধে নিতে আরো একটা ভরসার বানী! আহত প্রাণে তিনি বলেন, ‘যার পিতা নেই, সন্তান নেই, তার কিসের বাবা দিবস!’

ওপিওয়ানের প্রথম লটারিতে ৮ জনের মধ্যে একজন ছিলেন ইকবাল ইসলাম। মাত্র ২০০ ডলার নগদ নিয়ে ১৯৯০ সালে আমেরিকা আসেন তিনি। সে সময় তিনটি নাম্বার দিয়ে ছোট ব্রিফকেস খোলার একটা ব্যবস্থা ছিল। অনেকেই অর্থ জরুরী কাগজপত্র সুরক্ষিত রাখতে সে সময় এই ব্রিফকসগুলো ব্যবহার করতেন। তিনিও করেছিলেন। আজ পিতার সেই ব্রিফকেস পরে আছে ছেলের টেবিলের পাশে। শুধু ছেলেটা নেই।

অ‌ন্তু ‘র রুমটি এখনো তালাবদ্ধ। সেখানে কাউকে ডুকতে দেননা ‌অন্তুর বাবা-মা।। ‌রুমটিতে এখনো সংস্কৃতিমনা অন্তুর ব্যবহ্নত তবলা -হারমোনিয়াম, কিবোর্ড সব পরে আছে অক্ষতভাবে। তার সব কাগজ -পত্র, খাতা কলম, আগের জায়গায় আছে। তারা শুধু নামাজ-কোরআন পড়তে এবং প্রার্থনা করতে সে রুম ব্যবহার করেন।

নারীর বুক ফাঁটা চিৎকার দেখে আমি অভ্যস্ত। কিন্তু পুরুষ মানুষের কান্না আমি কখনোই নিতে পারি না। কেননা, আমি জানি, আমি দেখেছি কতটা বাঁধ ভেঙ্গে গেলে, কতটা অধৈর্য্য হলে পরে একজন পুরুষ এমন করে কান্না করেন।কান্না জড়িত কণ্ঠে ইকবাল ইসলাম যখন বলেন, ছেলেটাকে ছাড়া আমি একদম অসহায়, আমি শূন্য, তখন সত্যিই ভিতরটা কেঁপে উঠে। চোখ ভিজে উঠে।

তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না আমি কখনো অ‌ন্তুর মাকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিতে পারব। সে খুব কান্না করে। ছেলেকে পেটে ধরেছে, গা ছোঁয়ে বড় করেছে, কেমন করে তার দিন কাটে ছেলেকে ছাড়া তা আমি দেখি। ‌অ‌ন্তু সর্বত্র। রান্না ঘরে, খাবার টেবিলে, গাড়িতে, বাথরুমে, আমার পাশে, মা-বোনের পাশে সর্বত্র তার ছায়া আমরা অনুভব করি। আঁধারের মাঝেও যেন মনে হয়, এই তো সে উঁকি দিল! এখনো মনে হয় ‌অন্তু ফিরে আসবে! কেমন করে তাকে ছাড়া বাঁচি?’

আমরা জানি, গত দের বছরেও আমরা দেখেছি এ শহরের কত তরুণদের চলে যেতে হয়েছে। পুরো বিশ্বজুড়ে মহামারীতে হাজার-লাখ মা-বাবারা তাদের সন্তান হারিয়েছেন।
এ তো সহজ কথা নয়! ‘আল্লাহ্ ভরসা’ বলে ঢুক গিলে হজম করে নেবার মত শোক নয়! এ ক্ষত শোকাবার কোন মলম নেই।পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ! এও কি সহ্য হয়! যদি সহ্য করতেই হয় তবে এই মায়াটুকু সৃষ্টিকর্তা না দিলেই পারতেন।

এই শহরের পিতারা আজ ঘুমান না। পৃথিবীর অসংখ্য পিতারা আজ ঘুমাতে পারেন না। শহর কাঁদে! রাতের আঁধার কাঁদে! পিতারা কাঁদেন! মাঝ রাতে জ্বানালার পাশে বসে আঁধারের সাথে হয় তাদের বোঝাপরা! জ্বানালায় বাহিরে উঁকি দিয়ে তাঁরা আশায় থাকেন, ‘এই বুঝি ছেলে আমার ফিরে এলো।’ মিথ্যা আশ্বাসে পিতারা আজও সন্তানকে খোঁজেন।

এই পিতাদের জন্য বাবা দিবস শোকের না সুখের, তা আমরা জানি। তবু সকল বাবাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সন্মানার্থে বলতে হয়, শুভ বাবা দিবস। পৃথিবীর সকল বাবারা ভাল থাকুন। সন্তান বুকে নিয়ে থাকুন।

লেখকঃ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন-

তবু বলতে হয় “হ্যাপী ফাদার্স ডে”

আরও পড়ুন