Ads

কবিতায় একাগ্র-গদ্যে অকপট নোবেলজয়ী সাহিত্যিক হেরটা মুলার

প্রথম পর্ব

জুম্মি নাহদিয়া

পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকেই বিপুল সংখ্যক এথনিক জার্মান ইস্ট ইয়োরোপ থেকে জার্মানিতে অভিবাসন প্রক্রিয়া শুরু করে।কারণটা সেখানকার কমিউনিজমের তিক্ত অভিজ্ঞতা, চরম অর্থনৈতিক দৈন্য। তাছাড়াও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে হয়ত ঠিকঠাক বেঁচে থাকা দায় হয়ে দেখা দিচ্ছিল, আর তারা চাচ্ছিলই জার্মান কমিউনিটির ভেতর মিশে থাকতে। পুরোপুরি এক হয়ে যেতে।

এই অভিবাসনের স্রোত কিন্তু ১৯৮৯ তেও থামলো না। এমনকি নব্বই এর পরেও না। “সমজাতীয়তা” নামক শব্দটি ছিল জার্মানি প্রবেশের কার্যকরী পাসওয়ার্ড।

শুধুমাত্র নব্বইতেই চার লক্ষাধিক এথনিক জার্মান ইস্ট ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে জার্মান সীমান্তে আসে। এদের ভেতর এক লাখেরও বেশী মানুষ এসেছিল রোমানিয়া থেকে।

তবে দুঃখের ব্যপার হচ্ছে, যে অস্তিত্ব কিংবা পরিচয় পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তাদের কারো কারো স্বেচ্ছায় এমন বাস্তুচ্যুতি, সে পরিচয় আরও নির্মম রূপে আত্মপ্রকাশ করলো। স্বভূমে যারা ছিল সংখ্যালঘু জার্মান, সেই তারাই জার্মানি এসে হয়ে পড়লো ফ্রেমডে ডয়েচে (এলিয়েন জার্মান) কিংবা আউসযিডলার (প্রবাসী)।

নাৎসি আমলে যদিও ইস্ট ইয়োরোপের এথনিক জার্মানদের স্বেচ্ছায় কিংবা বাধ্যতামূলকভাবেও জার্মান সামরিক বাহিনীর হয়ে কাজ করতে হয়েছিল। আবার যুদ্ধ শেষ হবার পরেও যখন ইস্ট জার্মানি আর ওয়েস্ট জার্মানির ভেতর শীতল যুদ্ধ চলছিল, তখন ধনতান্ত্রিক ওয়েস্ট জার্মানি এই মার্ক্সিজম- লেলিনিজম এবং স্তালিনিজমে ক্লান্ত মানুষগুলোকে স্বদেশী হিসেবে বিবেচনায় এনেছিল, তাদের অধিকার সংরক্ষণে নিয়েছিল বেশ ভাল ভাল পদক্ষেপ তবে সেটা স্রেফ প্রতিদ্বন্দ্বী ইস্ট জার্মানিয় সমাজতন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখবার জন্যই। বোঝা গিয়েছিল এই দৃষ্টিভঙ্গী আরও কিছু পরে।

হাতুড়ি- শাবলে বার্লিন শহরের মাঝখানে গেঁড়ে ফেলা সেই কংক্রিটের দেয়ালটাকে ভেঙ্গে ফেলার পর দেখা গেল সেই সংরক্ষিত আদর যত্ন আর সেভাবে পাওয়া যাচ্ছেনা। জার্মানদেশে এই দলবদ্ধ স্বদেশত্যাগীদের পরিচয় এসে দাঁড়ালো নিছক “ইস্ট ইয়োরোপিয়ান”।

হেরটা মুলারকে জানতে গেলে রোমানিয়ার শাসন ব্যবস্থা সেই সঙ্গে এথনিক জার্মানদের এইসমস্ত এদেশ- ওদেশ করার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানাটা জরুরী। গুন্টার গ্রাসের দশ বছর পর ২০০৯ সালে জার্মান সাহিত্যে আবারো রাজমুকুট উঠলো জার্মান ভাষাভাষী এই লেখিকার হাত ধরে। যার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা জার্মানিতে নয়, পশ্চিম রোমানিয়ার একটি জার্মান প্রধান গ্রামে। সুইডিশ অ্যাকাডেমী হেরটা মুলারকে এমন এক নারী সাহিত্যিক হিসেবে বিশ্বের কাছে উপস্থাপন দেন যিনি তার একাগ্র কবিতায় এবং অকপট গদ্যে একটি অধিকারচ্যুত ভূদৃশ্য চিত্রিত করেছেন।

গ্রামের নাম নিচিডর্ফ। গ্রামটি রোমানিয়ার তৃতীয় জনবহুল শহর বানাতে অবস্থিত। এই বানাতের অনানুষ্ঠানিক রাজধানী আবার ছিল তিমিসোয়ারা। তিমিসোয়ারায় ক্রাশোভানি, স্লোভাক, হাঙ্গেরিয়ান কিংবা রোমানিয়ানদের পাশাপাশি ছিল প্রচুর এথনিক জার্মান।এলাকাগুলোর বিন্যাস ছিল জাতীয়তাভিত্তিক। যেমন নিচিডর্ফের মানুষের কথ্য ভাষা জার্মান, কাজকর্মের মাধ্যমও। স্কুলগুলো বিশুদ্ধ জার্মান ভাষায় পরিচালিত হত। রোমানিয়ান ভাষা ছিল মুলারের ভাষ্য অনুযায়ী শুধুই একটা রসায়ন কিংবা পদার্থের মতন পাঠ্য বিষয়।

তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, তিমিসোয়ারা যেহেতু শহর এলাকা সে কারণে পথে বেরুলে হাঙ্গেরিয়ান, জার্মান, রোমানিয়ান সহ সংশ্লিষ্ট সবগুলো ভাষাই শুনতে পাওয়া যাবে। মুলার নিজেও জার্মান উচ্চারণে রোমানিয়ান ভাষা বলে থাকেন প্রয়োজনমত।

হেরটা মুলার যে বছর জন্মান, ঠিক সে বছরেই জোসেফ স্তালিন দেহত্যাগ করেন, অর্থাৎ ১৯৫৩ তে। স্তালিন শাসনামলে সংঘটিত ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ছাড়াও ভিন্ন মতাদর্শের ওপর “গ্রেট পার্জ” নামের মহাশুদ্ধি অভিযানে, আর্টিকেল ৫৮ প্রবর্তন করে বিরোধীপক্ষ নির্মূলের মাধ্যমে, বাধ্যতামূলক শ্রমভিত্তিক কারাবাস অথবা “গুলাগ” প্রতিষ্ঠা করে কিংবা ধর্মবিশ্বাসের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে বিশ মিলিয়নেরও বেশী মানুষের মৃত্যুর নেপথ্যের কারিগর ছিলেন স্তালিন।

হেরটা মুলারের ভাষ্যমতে তার জন্মটা এমন এক সংকটের বছরে, যে বছর স্তালিনের দৈহিক মৃত্যু হয়েছিল ঠিক, কিন্তু তার আদর্শ- তার ধারণা আরও দীর্ঘায়ু হয়েছিল। যেগুলো আজও টিকে আছে অসংখ্য লোকের ভেতর, ধ্বংসাবশেষ হিসেবেও আছে। স্তালিনের পুরো তত্ত্ব হয়ত অতীতের মত স্পষ্ট দেখা যায়না তেমন তবে সে নকশার অনেক পাথর চারদিকে ছড়িয়ে আছে বলে তার বিশ্বাস।

স্তালিন প্রসঙ্গ যখন এলোই তখন আরেকটু পেছনে ফিরে তাকাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর রোমানিয়ার শেষ রাজা কিং মিখায়েল ১ কে বাধ্যতামূলক নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়ে ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক (USSR) জোরপূর্বক রোমানিয়ার অর্থনৈতিক- সামরিক ক্ষমতা নিয়ে নেয়। রোমানিয়ায় স্তালিনাইজেশন সেক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। রোমানিয়ার সর্বপ্রথম কমিউনিস্ট শাসক হিসেবে ১৯৪৭ সালে গেওর্গে গেওর্গি ডেয ক্ষমতায় আরোহণ করেন। কথিত আছে তার শাসনামলে সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচেয়ে অনুগত অংশে পরিণত হয় রোমানিয়া।

গেওর্গের মৃত্যুর পর মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে নিকোলাই চশেস্কুর। ১৯৬৫ সালে রোমানিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব নেন তিনি। শুরু হয় এক মহাদুঃশাসন।

হেরটা মুলারকে নিয়ে কথা বলতে গেলে চশেস্কুকে আসতেই হয়। মুলারের লেখার শুরুটাই ছিল কমিউনিজম এবং চশেস্কু শাসিত রোমানিয়ার চরম দুরাবস্থা থেকে নিজেকে প্রশমনের নিমিত্তে। সিক্রেট পুলিশের নির্যাতন- সন্ত্রাস, বিপর্যস্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা সেই সাথে ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতির অসহনীয় অভিজ্ঞতা তার লেখায় এসেছে বারবার।

এখানে উল্ল্যেখ করা জরুরী যে হেরটা মুলারের লেখার অধিকাংশ পটভূমিই কিন্তু তার শৈশব- কৈশোর সহ জীবনের ৩২ টি বছর অতিবাহিত করা রোমানিয়া। যেখানে চলছিল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীবিহীন সমাজতান্ত্রিক শাসন- একদম আগা গোঁড়া টোটালিটেরিয়ান সরকার ব্যবস্থা।

রোমানিয়াকে কমিউনিজম গ্রাস করে ফেলার আগে হেরটা মুলারের দাদা দাদী ছিলেন প্রচুর জমিজমার মালিক। কিছু নিজস্ব ব্যবসায়ও ছিল। তারা উদয়াস্ত কাজ করে যা উপার্জন করতেন তার সিংহভাগই নতুন জমি কেনার কাজে ব্যয় করতেন। তাদের জীবনে কোন ছুটিছাটা ছিল না, ছিল না কোন ভ্রমণ কিংবা আরাম আয়েশ।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় রোমানিয়া ছিল জার্মান মিত্র। যার কারণে আর দশটা রোমানিয়ান- জার্মানদের মতন হেরটা মুলারের বাবা ওয়াফেন এসএসে যোগ দিয়েছিলেন স্বেচ্ছায়। তবে মুলারের দাদাকে জোর করে অস্ট্রিয়ানদের সাথে যুদ্ধে পাঠানো হয় এবং তিনি সেখানে নিহত হন। যুদ্ধ শেষ হবার মাত্র অল্প কিছুকাল আগে রোমানিয়াকে পক্ষপাত বদলাতে হয়েছে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই ১৭ থেকে ৪৫ বছর পর্যন্ত সমস্ত রোমানিয়ান- জার্মানকেই স্তালিনের নির্দেশে বাধ্যতামূলকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রম শিবিরে পাঠানো হয়েছিল।

এবং ১৯৪৫ এর পর সোভিয়েত শাসনব্যবস্থা কায়েম হলে মুলারের দাদাদাদীর সমস্ত জমি চলে গেল যৌথ খামারের অধীনে। “পুনর্গঠন প্রক্রিয়া”র অংশ হিসেবে মুলারের মাকে হিটলারের কৃতকর্মের জন্য দেয়া হল যৌথ অপরাধের শাস্তি। পাঠানো হল সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক নিয়মে পরিচালিত শ্রমশিবিরে, পাঁচ বছরের জন্য।

এই অদ্ভুত শাস্তি প্রক্রিয়া আঁচ করতে পেরে হেরটা মুলারের ১৭ বছর বয়সী মা আত্মগোপনের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তার পরিবারকে তখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা হুমকী ধামকী দিয়ে বিপর্যস্ত করে ফেলছিল। স্বেচ্ছায় তিনি ধরা দেন তারপর। এক নির্মাণ এলাকার কয়লা খনিতে কাজের জন্য তাকে পাঠানো হয়েছিল সে সময়।

পুরো শ্রমশিবির ছিল সামরিক বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। বন্দীরা কয়লা খনিতে কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য ছিল। তাদের ক্ষুধার্ত রাখা হত। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের প্রশ্ন সেখানে অবান্তর ছিল। তীব্র ক্ষুধায় অগণিত বন্দী মারা গিয়েছিল।

ভাগ্যের জোরে তার মা বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন ১৯৫০ সালে নিচিডর্ফ গ্রামে। তবে সেই দুঃসহ স্মৃতির ছায়া থেকে অকপটে বেরিয়ে পড়া সম্ভব হয়নি যার কারণে ফিরে আসার তিন বছর পরে জন্মানো মুলারের শৈশবেও তার ছাপ পড়ে যায়।

পুরো গ্রাম জুড়ে কিন্তু একই রকমের অবস্থা ছিল। রোমানিয়ায় বসবাসরত অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর মতই জার্মান সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে একই রকমের চাপ, দারিদ্র আর উৎপীড়ন।

হেরটা মুলার সেই শিশু অবস্থাতেই আবিস্কার করলেন যে তিনি পুরো পরিস্থিতি কেবল নিজের শরীরে ধারণ করে যাচ্ছেন। আশেপাশে যা কিছু ঘটছে সেগুলো প্রকাশ করার মত উপযুক্ত শব্দমালা তার জানা নেই। ধারণা নেই কি ছিল যুদ্ধ, কেন ছিল, রাজনীতি কিভাবে হয়- পরিণামে কেন কাউকে কাউকে ভুগতে হয় তিনি ধারণা করতে পারছেন না কিছুই। পরবর্তীতে তার লেখায় সে কারণে উঠে এসেছে শিশুর চোখে তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক রোমানিয়া, রোমানিয়ান বহু জাতিগত এবং সংস্কৃতিগত জীবনাচার পালনকারী মানুষের পাশাপাশি বসবাস। টুকটাক সামাজিক দ্বন্দ্ব- পারিবারিকও।

অথচ মজার ব্যপার হচ্ছে হেরটা মুলার এই যে সাহিত্যের ভেতর নিজের পুরোটা সত্ত্বা নিয়ে নিবিষ্ট ছিলেন তিনি নিজেই সেটা বুঝতে পারেন নি। দারিদ্র এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার ভেতর শৈশব কেটে গিয়েছিল তার। কোন রকমের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাবিহীন বাড়িতে একটা রূপকথার বইও ছিল না। অথচ হৃদয়ে বয়ে বেড়ানো যন্ত্রণা দূরে ঠেলতে তিনি সাহিত্যের সাথে যোগাযোগ করলেন এক সময়।

যোগাযোগটা হয়ে যাবার পর তিনি অদ্ভুতভাবে উপলব্ধি করলেন যে আসলে সেই ছোটবেলা থেকেই তিনি মনের ভেতর জানার তীব্র তৃষ্ণা নিয়ে ভীষণ রকমের নিজস্ব এক সাহিত্য জগতেই বসবাস করছিলেন। সে জগতের জানালা দিয়ে হৃদয় বের করে মনে মনে সম্পর্ক তৈরি করে যেতেন প্রকৃতি অথবা তার দৃষ্টি সীমার ভেতরের কিংবা বাইরের পৃথিবীর সাথে।

অথচ তিনি একদমই জানতেন না সাহিত্য আসলে কি- সাহিত্য কাকে বলে!

লেখকঃ সাহিত্যিক ও প্রবাসী বাংলাদেশী, জার্মানি

 

আরও পড়ুন