Ads

ডেলিভারি আমার আর জ্ঞান হারালেন তিনি!

শাহীন আক্তার স্বাতী

জাপানে সাধারণত সন্তান ভুমিষ্ট হবার সময় স্ত্রীর সাথে স্বামীকেও লেবার রুমে এ্যালাউ করে। জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে স্ত্রীর পাশে থেকে সাহস যোগানো এবং সন্তান জন্মদানে একজন নারীর অবর্ণনীয় কষ্ট উপলব্ধির জন্যই স্ত্রীর সাথে স্বামীও লেবার রুমে প্রবেশের অনুমতি পায়।

আমার প্রথম সন্তান সাদ যখন পৃথিবীতে আসার জন্য পায়তারা করছে তখন আমার সাথে আমার হাজবেন্ডকেও লেবার রুমে প্রবেশ করানো হলো। লেবার রুমে আসার আগে অ্যাপ্রন, মাস্ক এবং মাথায় টুপি পড়ানো হলো তাকে। আমার অবস্থা তখন শোচনীয়। এমন অবস্থায় মেয়েদের যেমনটা হয়। লেবার রুমে কয়েকজন নার্স ছিলো। মিডওয়াইফ সাকুরা সান তখন খুব যত্নে আমার সন্তানকে পৃথিবীতে আনার চেষ্টা করছে। আমি যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অনবরত চিৎকার করেই যাচ্ছি। আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার হাজবেন্ড একবার পাখা দিয়ে বাতাস করে, আরেকবার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর থতমত খেয়ে চিন্তা করে কি ভয়ানক জগতে পা রাখলো।

আমার গলা শুকিয় কাঠ হয়ে যাচ্ছিলো। একটু পরপর পানি খেতে চাচ্ছিলাম। আমাকে ও পানি খাওয়ায় আর আমি অক্সিজেন মাস্কটা খুলে বমি করি। একটা পর্যায়ে আমি আর গর্ভে থাকা সাদ দুজনই দূর্বল হয়ে পড়ি। ধকলটা আর সইতে পারছিলামনা। রীতিমত মৃত্যুর প্রহর গোনা শুরু করেছি। হাজবেন্ডের কাছে বিদায় নিলাম। বললাম, “আমি বোধ হয় আর বাঁচবোনা। বাবুকে দেখো।”দেখি তিনি ঘামছেন এবং একটু একটু কাঁপছেন। এবার আমার নিজের চিন্তা বাদ দিয়ে হাজবেন্ডকে নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু হলো। জিজ্ঞেস করলাম, সব ঠিক আছে কিনা। ফ্যাকাশে মুখ করে বললো, ঠিক আছে। আমার সন্দেহ হচ্ছিলো। আমার বেহাল অবস্থা দেখে সে একটু বেশি ঘাবড়ে গেছে। এরপর আমার অবস্থা আরোও একটু বেশি খারাপের দিকে মোড় নিলো। মিডওয়াইফ তার দায়িত্ব ডাক্তারের হাতে ন্যাস্ত করলেন। এবার ডাক্তার, নার্সের যুদ্ধ শুরু হলো আমাকে নিয়ে। ঐ মুহুর্তের কথা আর মনে করতে চাই না।

এমন পর্যায়ে সাধারণত নারীরা জ্ঞান হারায় কিন্তু আমি সজ্ঞানেই ছিলাম। আমাকে হতবাক করে দিয়ে আমার হাজবেন্ড ধপাস!!!! সাদ ভুমিষ্ট হবার মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগে আমাকে বললো, “আমি একটু পানি খেয়ে আসি।” দুকদম না যেতেই তিনি জ্ঞান হারালেন! দুজন নার্স তাকে ধরাধরি করে পাশের রুমের বেডে নিয়ে শোয়ালেন। ততক্ষণে আমার সুপুত্র পৃথিবীতে ল্যান্ড করে ফেলেছেন। আমি নিজের চিন্তা বাদ দিয়ে পুত্রের বাবার কি অবস্থা জানার জন্য অস্থির হয়ে উঠলাম। আমাকে সাহস যোগাতে গিয়ে তার এমন করুণ পরিণতি হবে জানলে তাকে ভেতরে আসতে বাঁধা দিতাম। অত:পর আধা ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে তিনি আবার লেবার রুমে এলেন। ছেলেকে কোলে নিয়ে কানের কাছে মুখ এনে আযান দিলেন। একটি যুদ্ধের রাতের সমাপ্তি হলো সাদের আগমনের বার্তা দিয়ে। সন্তানের মুখ দেখে সমস্ত কষ্ট মুহুর্তেই মিলিয়ে গেলো।

মা হওয়া ভীষণ কষ্টের! এই কষ্টের যাত্রাপথের অভিজ্ঞতাও বিচিত্র। লেবার রুমে জীবন মরণ যুদ্ধের মাঝে আমার হাজবেন্ডের জ্ঞান হারাবার ঘটনা মনে পড়লে এখনও আমার হাসি পায়। মেয়ে হবার সময় নাকি তার মাথা ঘুরাচ্ছিলো। আমাকে দু মিনিট আগে বলেছে, “ পানি খাবো।” আমিও তাড়াতাড়ি তাকে বাইরে চলে যেতে বলেছি। তা না হলে মেয়ের জন্ম নেবার সময়ও হয়তো তিনি “ধপাস!” সন্তান ভুমিষ্ট হবার তীব্র যন্ত্রণা চোখে দেখেই পুরুষরা এত ঘাবড়ে যান আর যিনি জন্ম দেন তিনি কি কষ্টই না ভোগ করেন। এজন্যই মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত বলা হয়। মায়ের ঋণ কখনও শোধ দেয়া যায়না। মা হবার সময় আমার মাকেও মর্মে মর্মে অনুভব করেছি। প্রতিটি মা ই আসলে এক একজন যোদ্ধা আর বাবারা সেই যুদ্ধের একজন অংশীদার ।

লেখকঃ জাপান প্রবাসী লেখক 

আরও পড়ুন