Ads

ভালোবাসার তালা

তারিক হক

জার্মানিতে আজ চমৎকার রৌদ্র উঠেছে। গিয়েছিলাম রাইন নদীর পারে বেড়াতে। সেখানে একটি ছোট্ট ব্রিজ, তবে ভাঙ্গা। আপনি হয়তো বলবেন, জার্মানিতেও ভাঙ্গা ব্রিজ আছে, ভাঙ্গা ব্রিজতো বাংলাদেশের ঐতিহ্য। না, তা নয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছিল। নিজেরাই বম্বিং করে ব্রিজটি উড়িয়ে দিয়েছিল যাতে ব্রিটিশ বাহিনী সেই শহরে প্রবেশ না করতে পারে। জার্মানরা ওটাকে এখন ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে রেখে দিয়েছে।
ব্রিজের ধ্বংসাবশেসের উপরে ওরা সুন্দর করে তারের বেড়া লাগিয়ে দিয়েছে যাতে কেউ পড়ে না যায় বা আত্মহত্যা না করতে পারে। তারের বেড়ার গায়ে এখন অনেক অনেক তালা ঝুলে আছে। দুটো নাম, প্রেমিক-প্রেমিকার নাম অথবা স্বামী-স্ত্রীর নাম।
প্রেমিক প্রেমিকারা যখন প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খায়, অথবা নবদম্পতির ভালোবাসা যখন উথলে উঠে তখন রাধাকৃষ্ণ এখানে এসে একটি তালা লাগিয়ে যায়, আর চাবিটি নদীতে ফেলে দেয়।
মনে একটিই ইচ্ছা, আমাদের এ প্রেম যেন তালার মতই অটুট থাকে।

আমি কোনোদিনই রোমান্টিক ছিলাম না। জার্মান পত্রিকায় যখন পড়ি বা প্রতিবেশীদের কাছে যখন শুনি অহরহ বিবাহ বিচ্ছেদের কথা তখন আমার কাছে কেন যেন এই তালার ব্যাপারটি হাস্যকর মনে হয়।
তবুও আমি কৌতূহলবশত সবগুলি তালার তারিখ দেখতে শুরু করলাম । কোনোটি চল্লিশ বছরের পুরানো কোনোটি একদম ফ্রেশ।
ইতিমধ্যে আমার পাশে এক দম্পতি এসে দাঁড়ালেন। দুজনেরই বয়স হয়েছে। উনারা আমাকে “গুটেন টাগ“ ( Guten Tag ) বললেন, বাংলায় “তোমার দিনটি শুভ হোক“। আমিও উত্তর দিয়ে বললাম , খুব সুন্দর আজকের দিন তাই না। উনারা মুচকি হেসে বললেন , হ্যাঁ।
আমি প্রতিটি তালা দেখছি আর খুঁজছি কোনটি সব চেয়ে পুরানো। আমার কাণ্ড দেখে বৃদ্ধা বললেন, আপনি কি তালার উপর গবেষণা করছেন ?
আমি বললাম , না, তবে এগুলো আমার কাছে খুব ফালতু মনে হয়।
-কেন ?
-এই যে দেখুন না এখানে খুব লোক দেখিয়ে তালা লাগিয়ে যায়, দুদিন পরেই বিবাহ বিচ্ছেদ।
এবার ভদ্রলোক বললেন, “সবাই তো আর একরকম নয়।”
আমি বললাম, “তা ঠিক। তবে এতো বেশি বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে আমার তো মনে হয় না এখানকার তালার মালিক-মালেকিনা এখনো এক সঙ্গে আছেন।”
ভদ্রমহিলা বললেন, “হয়তো বা আছেন।”

হঠাৎ একটি বেশ পুরানো তালা পেলাম। উপরে শুধু দুটি নাম হাইকে আর ডিটার। কোন তারিখ নেই। মরিচা পড়ে গেছে শুধু “Made in Germany” বলে এখনো টিকে আছে। আমি তালাটি হাতে নিয়ে বললাম এই যে দেখুন তালাটি। “আপনারা কি মনে করেন এরা কি এখনো একসঙ্গে আছেন ?”
বৃদ্ধা বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে হাসলেন আর বৃদ্ধ বৃদ্ধার দিকে। দুজনের হাসি যেন কিছু বলতে চাচ্ছে।
অনেকটা কবির ভাষায়, হাঁসি বলে হাঁস, হাঁসা বলে হাঁসি এই নিয়ে হাঁসাহাঁসি করে হাসাহাসি ।

বৃদ্ধা আমার কানের কাছে এসে বললেন, “আমার নাম হাইকে আর আমার স্বামীর নাম ডিটার। আজকে আমাদের চল্লিশতম বিবাহ বার্ষিকী। তাই এখানে এসেছি।”
আমার মুখটি লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। ক্ষমা চেয়ে দম্পতিকে প্রাণ ভরা আশীর্বাদ দিলাম। গাড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় নিজেকে বললাম, “তারিক , আজকে তোমার উচিত শিক্ষা হয়েছে, বাঙালি হয়েছো ভালো কথা, তাই বলে বেশি পণ্ডিতি করো না।”

লেখকঃ জার্মানি প্রবাসী মোটিভেশনাল লেখক,ভেজেল, জার্মানি

লেখকের প্রকাশিত আরও লেখা পড়ুন-

বাঙালি মাহমুদ যেভাবে মিউলার!

আরও পড়ুন