Ads

“মা” দেখতে কেমন?

মনসুর আলম

“মা” দেখতে কেমন হয় এটি আমি জানিনা। আমি শুধু জানতে এসেছি মায়ের যত্ন আমার পাওনা ছিলো কি না?

এখানে নিরাপত্তা একটি প্রধান ইস্যু। রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় সারাক্ষণ অস্থিরতার মধ্যে থাকতে হয়। আমরা এশিয়ানরা সাধারণত স্থানীয় কাউকে লিফট দেইনা যদিনা খুব পরিচিত হয়। ওরা অবশ্য আমাদেরকে লিফট দিতে খুবই আগ্রহী যেহেতু আমাদের তরফ থেকে ওদের জন্য নিরাপত্তার কোন হুমকি নেই। স্থানীয় লোকজন যখন লিফট চেয়ে হাত তুলে আমরা তখন স্বার্থপরের মতো মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে চলে যাই। মাঝেমাঝে খুবই খারাপ লাগে, বিবেকের সাথে যুদ্ধ করতে হয় কিন্তু, উপায় নেই। বেঁচে থাকতে হলে এইটুকু স্বার্থপরতা দেখাতে হবে নাহলে গাড়ি, টাকা পয়সা সব কেড়ে নিয়ে এমনকি পৈতিৃক প্রাণটাও নিয়ে চলে যাবে।

ডিপার্টমেন্ট অফ্ এডুকেশন এর LTSM সেকশনের একটি প্রজেক্টের সাথে জড়িত ছিলাম গত কয়েকবছর। কাজের কারণেই আমাকে প্রতিদিন ট্রাভেল করতে হতো। আমার ওয়্যারহাউজ, রিজিওনাল অফিস ১৫০ কিলোমিটার দূরে। প্রতিদিন সকালবেলা এই ১৫০ কিঃমিঃ ড্রাইভ করে যাই আবার বিকালবেলা ফেরত আসি, মিটিং/ ওয়ার্কশপ থাকলে আরো দূরে যেতে হয়। প্রতিদিন যেতে আসতে অসংখ্য মানুষ লিফটের জন্য হাত তুলে, প্রতিদিনই বিবেকের সাথে যুদ্ধ করে মুখ লুকাই।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরের এক বিকেলে বাসায় ফেরত আসার জন্য রওয়ানা দিয়েছি। শহরের বাইরে হাইকিং স্পটে দাঁড়ানো এক ছেলে হাত তুললো, ষোলো / সতের হবে বয়স। কী নিষ্পাপ চেহারা! দেখে মনে হচ্ছে খুবই নিরীহ টাইপের ছেলে তবে বেদনা ক্লীষ্ট। গ্রীষ্মের এই প্রচণ্ড দাবদাহে দরদর করে ঘামছে। আফ্রিকার গ্রীষ্ম খুবই ভয়াবহ, তার উপর আমার এদিকে সেমি ডেজার্ট এরিয়া। গরমে সিদ্ধ হতে থাকা এই কিশোর ছেলের দুই হাত জোড় করে লিফটের আবেদন দেখে খুবই মায়া লাগলো, আমি ওর চেহারা মন থেকে সরাতে পারছিনা। যেহেতু আমি ব্রেক করার জন্য প্রস্তুত ছিলামনা তাই কিছুদূর গিয়ে ইউ টার্ন নিয়ে আবার ফেরত আসলাম। ভুলে গেলাম নিজের নিরাপত্তার কথা। ছেলেটির কাছে গাড়ি ব্রেক করে বললাম ঝটপট উঠো। সে ওঠার সাথে সাথেই বাটন টিপে দরজা লক্ করলাম, এসি বাড়িয়ে দিয়ে সাথে থাকা জুসের বোতলটি ছেলেটিকে দিয়ে দিলাম। কৃতজ্ঞতায় একেবারে নুয়ে পরলো ছেলেটি, ঢকঢক করে এক নিমিষেই পুরো বোতল খালি করে ফেললো। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসির ঠান্ডা বাতাসে স্বাভাবিক হয়ে আসল ওর চেহারা। জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাবে? সে যে জায়গার নাম বললো এটি এক‌টি গ্রাম, মেইন রোড থেকে ৪০কিঃমিঃ ভেতরে যেতে হবে টার্ন নিতে হবে একশো কিঃমিঃ যাবার পরে। ওকে বললাম আমিতো ওদিকে যাবোনা, তোমাকে মেইন রোডে নামিয়ে দেবো ওখান থেকে আরেকটি লিফট নিয়ে গ্রামে পৌঁছে যাবে।

ওর দ্বিধান্বিত চেহারা দেখে একটু কৌতূহল জাগলো, জিজ্ঞেস করলাম

– তুমি এই এরিয়া ভালো করে চেনোতো?

– না, আমি জীবনে এই প্রথম এসেছি। শুধু নাম জানি।

– কোথা থেকে এসেছো?

উত্তরে সে জানালো, সে এসেছে ‘নেলসপ্রিট ‘ নামক একটি শহর থেকে। এখান থেকে প্রায় তেরোশো পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে। ইন্টার সিটি কানেকটিং বাস সার্ভিস আছে কিন্তু, অনেক ব্যয়বহুল। তার কাছে বাসের টিকিট কেনার মত টাকা নেই তাই এভাবে ভেঙে ভেঙে লিফট নিয়ে যাচ্ছে।

– তোমার কাছে টাকা নেই, একা একা এত দূরে, অচেনা জায়গায় যাচ্ছো কেন?

– আমার মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। আমাকে যেতেই হবে। এতবছর পর সুযোগ যেহেতু পেয়েছি, অবশ্যই মায়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে চাই।

– কী বললে? এত বছর পর? তোমার মা, তোমার সাথে থাকেনা?

– জানো? আমি আমার মা’কে চিনিনা। আমার জন্মের তিনসপ্তাহ পরেই আমাকে দাদীর কাছে রেখে মা চলে এসেছে। কোনো যোগাযোগ ছিলোনা। মায়ের আদর কী জিনিস সেটি দেখার মত ভাগ্য আমার হয়নি। আমি যখন আরো ছোট ছিলাম চারিদিকে তাকাতাম, কাকে মা ডাকবো? কেউ আমাকে হাগ্ করেনা, কেউ আমাকে কিস্ করেনা। শীতের রাতে যখন কেঁপে কেঁপে উঠতাম পাগলের মতো কান্নাকাটি করতাম মা’কে জড়িয়ে ধরবো বলে। আমি যখন চোখের জলের বন্যা ভাসাই পাশের রুমে আমার সৎ ভাই/বোন তাদের মায়ের বুকের উষ্ণতায় আরামে ঘুমোচ্ছে। স্কুলে যাই, সবাই মায়ের গল্প করে, আমিতো জানিই না মায়ের ঘ্রাণ কীরকম হয়? আমার মায়ের কোন ঠিকানা, ফোন নম্বর, ছবি কিছুই নেই আমার কাছে। ছোটবেলা মনে করতাম দাদীই আমার মা, একটু বড় হবার পর দেখতে পেলাম সে আমার ‘মা’ নয়, সে আমার জন্মদাতার ‘মা’। কত যে কেঁদেছি মায়ের জন্য!

– এখন ঠিকানা কীভাবে জানলে?

– কিছুদিন আগে থার্ড সেমিষ্টারে স্কুলের এওয়ার্ড সিরিমনির সময় সবার মা/বাবা এসেছে কেবল আমার কেউ নেই, আমার বাবা গিয়েছে সৎ ভাইয়ের স্কুলে। আমি সহ্য করতে পারিনি, অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। আমার এই ঘটনার পরে অনেক খোঁজাখুঁজি করে, অনেক মানুষের সহায়তায় বাবা ফোন নম্বর পেয়েছেন। মায়ের সাথে ফোনে কথা হয়েছে, ঠিকানা পেয়েছি তাই আজ …। জানো? আমার বাবার কাছে টাকা নেই ; অনেক কান্নাকাটি করার পরও আমার বাবা আমাকে এদিকে আসার জন্য খরচ দিতে পারেন নি। মা’কে বলিনি – যে আমাকে তিন সপ্তাহের রেখে পালিয়ে যায় তার কাছে টাকা চাইবো কীভাবে? সবকিছু জানতে পেরে আমার এক ইন্ডিয়ান শিক্ষক আমাকে খরচের জন্য টাকা দিয়ে পাঠিয়েছেন।

ছেলেটির কথা শুনতে শুনতে কখন যে একশো কিলোমিটার চলে এসেছি টেরও পাইনি। গাড়ি দাঁড় করিয়ে নিজেও নামলাম। ওকে বুঝিয়ে বললাম কীভাবে এখান থেকে লিফট নিতে হবে। সে আমাকে ভাড়া দিতে চাইলে তার কাঁধে হাত রেখে বললাম, “আমি তোমাকে টাকার জন্য লিফট দেইনি, সংঙ্গ পাবার জন্য লিফট দিয়েছি। তোমার জীবনের গল্প শোনার পরেতো আর টাকা নেবার প্রশ্নই ওঠেনা। ”
যাও, তোমার মা’কে প্রাণ ভরে দেখো আর আমার ফোন নম্বর রাখো – যাবার আগেরদিন কল দিও, এই রাস্তায় আমি সপ্তাহে পাঁচদিন যাই।

গাড়িতে উঠতে যাবো পেছনে এসে ছেলেটি দাঁড়িয়ে বললো- আমি কি তোমাকে একটু হাগ্ করতে পারি?
আমার বুকটা কেঁপে উঠলো, ঘুরে দাঁড়িয়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। সে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করলো আর বলতে লাগলো, ” তোমরা ইন্ডিয়ানরা এত ভালো কেন? ” যেখানে আমার জন্মদাতা বাপই আমাকে টাকা দেয়নি সেখানে এক ইন্ডিয়ান টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দেয়, আর আমার জাতি ভাইরা যেখানে টাকা ছাড়া কখনো লিফট দেয়না সেখানে আরেক ইন্ডিয়ান বিনা টাকায় আমাকে পৌঁছে দেয় – তোমাদের হৃদয় কীসের তৈরী?

চোখ মুছতে মুছতে বললাম- স্বর্গ থাকে আমাদের মায়ের পায়ের নীচে, তুমি সেই স্বর্গের মুখোমুখি হতে যাচ্ছো। গড্ ব্লেস ইউ।

সে মাথা নীচু করে বললো – স্বর্গ টর্গ কিছু বুঝিনা, আমি শুধু জানতে এসেছি মায়ের বুকে মুখ লুকানোর অধিকার আমার ছিলো কি না?

( বিঃদ্রঃ স্থানীয় জনগণ বাঙালি, পাকিস্তানি, ইন্ডিয়ান আমাদের সবাইকে জেনারেলি ‘ইন্ডিয়ান ‘ ডাকে।)

 লেখকঃ সাহিত্যিক ও প্রবাসী বাংলাদেশী, সাউথ আফ্রিকা।

 

আরও পড়ুন