Ads

সুইসাইড খাবো । যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ ও বাঙ্গালির গল্প

দিলরুবা আহমেদ

ইউনিভার্সিটি জীবনে কথাটা প্রায়ই শুনতাম ‘সুইসাইড খাবো।‘ ছ্যাকা খাওয়ার পরবর্তী কথামালার প্রথমটাই সম্ভবত সুইসাইড খাবো। ছ্যাকামাইসিন শব্দটা এখনো প্রচলিত রয়েছে কি না ইউনিভার্সিটিতে জানি না। আমার শোনার সুযোগ নেই। বহু দূরে আমি, ভৌগোলিক এবং সময় দুভাবেই। দুষ্টামির জগতের এই কথাগুলোর গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা বাস্তব জগতে কতোটুকু তখন তা না বুঝলেও আমেরিকা একদিন বুঝিয়ে দিল ভালোভাবেই, গুরুত্বপূর্ণ ভুলের কিংবা মারাত্মক দুষ্টামির মাশুলও কম দিতে হয় না এই মহাদেশে।

হঠাৎ করেই দেখলাম টেক্সাসে আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের ভেতর পুলিশ, দমকল এবং অ্যাম্বুলেন্স তিন বাহিনীই সাইরেন বাজিয়ে হাজির। রাত বলে লাল-নীল বাতিতে চারদিক বেশ ঝিকিমিকি করে উঠছে।পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেডার, প্যারামিডিক্স সবাই বেশ তৎপরতায় ওঠানামা করছে যে বাসাটিতে সেটা ঠিক আমার সামনের অ্যাপার্টমেন্ট, দুজন বয়স্ক মানুষ থাকেন, আপা-দুলাভাই ডাকি। সঙ্গে থাকে এক ছেলে মাহদী।

আপা-দুলাভাইয়ের কিছু হলো কিনা ভেবে শঙ্কিত হলাম। বিশাল দেশের পুলিশ আর দমকলের লোকজন সিড়ি জুড়ে। ওদের টপকে টাপকে উপরে উঠাও সম্ভব না। ওরা উঠতেও দেবে না। বুঝলাম অপেক্ষা আর ধৈর্য খুবই জরুরি এখন।ওরা সরে যেতেই উপরে ওঠার অপেক্ষায় নিচে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলাম। আশপাশের অনেক বাসা থেকেও উকিঝুকি চলছে। বাংলাদেশিরা বের হয়ে নিচে এসে জটলা পাকিয়েছে, স্বদেশি বলে কথা।

কেউ কিছু সঠিকভাবে জানে না। কেউ বলছেন দুলাভাই মারা গেছেন। কেউ বলছেন আপা। শুনে অবশ্য ইন্নালিল্লাহিও পড়তে শুরু করেছেন কয়েকজন।
আমার ঠিক কাছাকাছি পুলিশটিকে জিজ্ঞাসা করে ফেললাম, ‘মারা গেছে কেউ না এখনো বেঁচে আছে?’
পুলিশটি অবাক হয়ে বললো, ‘তুমি জানতে নাকি কেউ মারা যাবে?’
বললাম না, ‘তবে তোমরা সবাই এসেছো দেখে এখানে সবাই ভাবছে কেউ একজন মারা গেছে। অ্যাম্বুলেন্সও এসেছে। থাকেন দুজন বয়স্ক মানুষ। বুঝতেই পারছো সবাই তাই ভাবছে ওই রকম কিছু হয়েছে।’

পুলিশটি গম্ভীর হয়ে বললো, ‘৯১১-এ কল করলে সচরাচর তিন বাহিনীই ছুটে আসে। আজকের কেইসে তো আসতেই হবে। যদি সুইসাইড প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় তবে প্যারামিডিক্স লাগবে, দরজা ভাঙতে হলে দমকল বাহিনী, আর আমাদের তো রিপোর্ট এবং সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকতেই হবে।’

‘তার মানে কেউ সুইসাইড করতে চেয়েছিল?’ আমি রীতিমতো হাহাকার করে বলে উঠলাম।
‘নয়তো আবার কি?’ তুমি সম্ভাবনা জেনে থাকলে আগেই ফোনে আমাদের জানানো উচিত ছিল।

পাশ থেকে এক ভাই বললেন, ‘ভাবী চুপ থাকেন, শেষে আপনাকেই না আবার ধরে নিয়ে যায়।’
আমি চুপ করে গেলাম। আপা-দুলাভাইয়ের জন্য ভয়, চিন্তা, দরদ এবং সামগ্রিক পরিস্থিতিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বা হতবিহ্বল হয়ে চুপ করে থাকলাম।
যদিও তারা শুধুই আমাদের প্রতিবেশী তারপরও যেন অনেক কালের চেনাজানা আত্মীয়ের চেয়েও বেশি। হঠাৎ দেখলাম আপার ছেলেটিকে টেনে-হিচড়ে ধরে নিয়ে পুলিশ বের হয়ে যাচ্ছে। সে বোধ হয় যাবো না জাতীয় কিছু বলতে চাচ্ছে।
পাশ থেকে এক মহিলা কণ্ঠে মন্তব্য এলো, ‘এই হত্যাকারী নাকি? ছেলেই মনে হয় বাপ-মাকে খুন করেছে।’
ঘাড় ঘুরিয়ে কত্থককে দেখলাম। এমন অদ্ভুত ভাবনার ভাবনাকারীকে না দেখে উপায় আছে?

মাহদীকে আমি খুব আদর করি। সে আমাদের সবাইকে আন্টি ডাকে। এতে অবশ্য অনেকেরই আপত্তি আছে। এতো বড় ২০/২২ বছর বয়সী একজন ছেলে সবাইকে আন্টি ডেকে বেড়াচ্ছে এটা অনেকেরই পছন্দ না । ওর মাকে যখন আপা ডাকছি তখন তো আমরা খালাই। আমি যার আসল খালা তার বয়স মাত্র ১ বছর, তার নামও মাহদী, সে কারণেও এই মাহদীকে আমার আদরই লাগে। অনেকের মতো পেছনে বিরক্ত হয়ে ঠোট বাকিয়ে বলি না শুধু আন্টি ডাক শোনার ভয়ে ওই বাসায় একদিন যাওয়াই দেবো বন্ধ করে।

মাহদী আমাকে দেখেই চিচি করে কি যেন কি বললো, কিন্তু পুলিশ ততোক্ষণে তাকে ভ্যানে ভরে ফেলেছে। পাশ থেকে সেই মহিলা আবারো বলে উঠলেন, ‘ও বলছে ওর কোনো দোষ নেই। তবে আমার ধারণা এই খুনি’, বলে চোখ দুটো বড় বড় করে আমার দিকে চেয়ে থাকলেন।
মহিলার চুলগুলো কোকড়ানো, ছাড়া, চুল না আচড়ে, না বেধে দৌড়ে এসেছেন, আমার এমন অন্ধকার রাতে গাছতলায় দাড়িয়ে একেই খুব ভীতিকর মনে হতে লাগলো।তাড়াতাড়ি বললাম, ‘আমার কিছুই মনে হচ্ছে না, আপনারও কিছু মনে হওয়ার দরকার নেই।’

পুলিশ চলে যাচ্ছে। আমিও উপরে ওঠার সুযোগ পেলাম। সিড়ি ভেঙে উঠছি। মহিলাটিও বলতে বলতে উঠছেন, ‘লাশ না দেখে যাই কেমন করে।’ আরো অনেকে উঠছেন, সবাই প্রচুর উফ আহ করছেন।
নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ করে ছুটে উপরে উঠে আসলাম। দরজায় পৌছতেই দেখি আপা ছুটে আসছেন। তিনি অক্ষত সুস্থ আছেন দেখে আমি বেশ স্বস্তি পেলাম। পাশের মহিলাটি কি পিছ ছেড়েছে। পেছন পেছন আছেন। বললেন, ‘তাহলে কি বাপকেই শেষ করেছে?’
আপা কান্না থামিয়ে মহিলাটির দিকে তাকালেন। বললেন, ‘মানে?’
মহিলাটি বললেন, ‘সারাক্ষণ মানুষের বাচ্চার বদনাম করেন এখন হলো তো নিজের ছেলের এই দিন দেখতে হলো।’
আপা আরো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। বললেন, ‘আমার এখন কি হবে গো?’
মহিলাটির সঙ্গে আমার অবশ্যই তেমন কোনো যোগাযোগ ভাব বা খাতির নেই। আসতে যেতে দেখা হলে হাই-বাই বলি। আপার সঙ্গেই ওনার যতো যোগাযোগ। এখন যোগ বিয়োগ হবে।

আপা প্রায়ই তার বাচ্চা তিনটিকে দেখে বক-বকান, বাচ্চা তিনটিরই কাজ হচ্ছে সারাক্ষণ পুরো এলাকাময় দৌড়ানো আর চিল্লানো। তিন-চার-পাঁচ বছর সম্ভবত ওদের বয়স। প্রায়ই দেখা যায়, বাচ্চা তিনটি দৌড়াচ্ছে। পিছু পিছু বাপ বা মাও দৌড়াচ্ছে। বাপ ক্লান্ত হয়ে গেলে মা দৌড়ায়, রিলে রেস। দরজা খোলা পেলেই ভৌ-দৌড়। একজনকে ধরতে আরেকজন, এ করে পুরো পরিবার ঘরছাড়া।
প্রায়ই আপা ওই মহিলাকে ডেকে বলেন,

‘শোনো ধরে দুটো আছাড় দাও, একদিনেই বাচ্চা ঠিক হয়ে যাবে। আমরা বাচ্চা পালিনি। বাচ্চার পেছন পেছন সারাক্ষণ দৌড়ানো এসব কি?’ আপা গজগজান।

আপা যে বয়সের মানুষ তাতে করে ধরেই নিয়েছেন, তিনি সবার সব ব্যাপারে নাক গলানোর অধিকারপ্রাপ্ত। এতে কারও মাউন্ড করার কিছু নেই। করলেও তিনি তার ধার ধারেন না। আপাতত দৌড়ানোর প্রত্যেক দিনের কমন দৃশ্যটা বন্ধ করতেই যেন আপা বদ্ধপরিকর।
আজ উসুলের দিন। মহিলার আজ শোধ তোলার সুযোগ হয়েছে। ছাড়বেন কেন তিনি।

ঠিক ওই সময়েই দুলাভাই বের হয়ে এলেন। তাকে দেখা মাত্র এবার মহিলা বিকট চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলেন, ‘একি দেখলাম গো, একি দেখলাম। মরা মানুষ হাটতাছে। অ আল্লাহ একি দেখালে। বট গাছতলার মরাবাড়িতে সন্ধ্যারাতে আসতে নাইগো।’ এরপরই মুখের কথা বন্ধ।
শুধু এ্যা অ্যা এ্যা ও্যা জাতীয় শব্দ বের হচ্ছে। যা খুশি করো চেঁচাও কিন্তু আমাকে এরকম চেপে ধরা কেন। কী উইয়াড় (Wired) । মহিলা সব শক্তি খরচ করে আমাকে চেপে ধরেছে। আপাও সাথে সাথে একবার বিশাল বটগাছটার দিকে তাকিয়ে আমাকে সামনে থেকে জড়িয়ে ধরলেন। দু’জনই খুন ভুত এ্যা এ্যা ব্যা ব্যা অনেক কিছু আওড়াচ্ছে।আশে পাশে আরেক দাফায় গণ-জামায়েতের সম্ভাবনা দেখা গেলো।

চমৎকার একটা পারফিউমের বিজ্ঞাপন হতে পারতো। আমি এমন অসাধারণ একটা পারফিউম লাগিয়েছি, সবাই এসে আমাকে জড়িয়ে ধরছে। ব্যাপারটা সে রকম হলো না। রিয়েল লাইফ ক্রাইসিস। আমি যে ভড়কে গিয়ে সিড়ি দিয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেলাম না সেই ঢের। বারান্দাতেই সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে ঘরে ঢুকতে আর পারছি না।

দুজন চায়নিজ বৌ-শাশুড়ি, প্রায়ই রাস্তায় দৌড়ায়, একই রকম দুজন, আমরা বলি যমজ বৌ-শাশুড়ি। তারাও দেখলাম দৌড়ানোর দিক পরিবর্তন করে আমাদের দিকে তাক করে ছুটে আসছেন। মহিলাটির চিৎকারই সম্ভবত তাদের এদিকে ধাবিত করেছে। আর ওই মহিলা তো চিৎকার করেই যাচ্ছে। করেই যাচ্ছে। কিছু বলছে না, শুধু অ্যাস অ্যা অ্যা।

দুলাভাই শুধু অবাক হয়ে বললেন, ‘আননো গো কি হইছে? হাগলা কুত্তায় কামড়াইছে নি কনো?’ কথাটা প্রায়ই উনি বলেন, অর্থটা আমি এখন জানি। জানতে চাচ্ছেন আমাদের কি হয়েছে কোনো পাগল কুকুরে কামড়েছে কিনা?
আমি দ্রুত মাথা নাড়াতে লাগলাম। আমেরিকাতে পাগলা কুকুর কোথায় যে কামড়াবে। রাস্তাঘাটে বেওয়ারিশ কুকুর তো স্বপ্নাতীত।তাহলে কি হয়েছে ওনার প্রশ্ন।উত্তর দেবো কিভাবে ওই মহিলাটি আমাকে আরো জোরে চেপে ধরে দম বন্ধ করে মারার চেষ্টা করতে করতে কি যেন কি বলেই যাচ্ছেন, যেন মৃগীরোগী।

হঠাৎ আমার কানটান ফাটিয়ে দিয়ে মহিলাটি চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘আল্লাগো খুন খুন।’ বহুক্ষণ চেষ্টার পর এটুকু কথা বের হলো যেন।
শোনামাত্র এবার দুলাভাই স্বয়ং চিৎকার করতে লাগলেন,‘মার্ডার মার্ডার।’
দুলাভাই তার সেই বিখ্যাত ডোরাকাটা লুঙ্গি, হাটু পর্যন্ত তুলে লাফাতে লাগলেন। ‘খুন খুন খুন।’
ততোক্ষণে সিড়ির অর্ধেক পর্যন্ত পৌছে যাওয়া দুই যমজ দৌড়বিদ দর্শক হতে এসে অংশগ্রহণ করে বসলো। ইংরেজি বাংলা কিছু না বুঝলেও মার্ডার তো বুঝে। ৯১১-এ পুলিশকে কল দিয়ে দিল সেল ফোন থেকে। ওটা কোমরে ঝুলিয়ে রেখেই দৌড়াতে বের হয়।
ওই মহিলা এবার তাড়াতাড়ি বললেন, ‘আপনি বেঁচে আছেন তাহলে খুন হয়েছে কে?’ মহিলা যেন সম্বিত ফিরে পেয়েছে।
ততোক্ষণে দুলাভাইয়ের যেন ঘুম ছুটেছে। হুশ হয়েছে। সত্তর বছর বয়সী দুচোখে তাবৎ অবাক হওয়া ভরে মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার কি খুন হওয়ার কথা ছিল নাকি?’

আমি যেন যুদ্ধ করে বহু কষ্টে দুজনের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করলাম। আপা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘তোমাকে কেন খুন করবে, কার এত বড় সাহস?’ মহিলাটিও সাথে সাথে মহা বেয়াকুবের মতন বললেন, ‘কেন আপনাদের ছেলে।’ আপা যে ঘুরে একটা চড় বসায়নি তাকে সেই ঢের। তবে যে চাহনী দিলেন আমি নিশ্চিত তাতে আগামী সাত রাতের এই মহিলার নিদ্রা ছুটে গেছে। আমি ধাতস্থ হওয়ার আগেই চারদিকে ঝড় তুলে দু মিনিটের মাথাতেই পুলিশ হাজির। আগের জনরাই। বেশি দূরে মনে হয় যাওয়াও হয়নি। কাছেই ছিল। ছুটে এসেছে। গাড়ির ভেতরে অবশ্য মাহদীকে দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত তাকে কোথাও রেখে এসেছে।

আরো কিছু দেশি পাবলিকে ততোক্ষণে ঘর ভরে গিয়েছে। আমরা ভিড় ঠেলে বারান্দা থেকে ভেতরে আর ঢুকতে পারলাম না। ঘরটা যে ভেঙে পড়ে যাচ্ছে না সেই ঢের। বারান্দাতেই দাড়িয়ে রইলাম।
পুলিশ উঠতে উঠতেই দুই চায়নিজকে জিজ্ঞাসা করলো কে মার্ডার হয়েছে।
ওরা ঝটপট উত্তর দিল, ‘নো ইংলিশ।’

এরাই ফোনে খবর দিয়েছে অথচ এখন বলছে ইংরেজি জানে না। পুলিশ তাই অবাক হয়ে বললো, ‘তোমরা না ফোনে খবর দিলে।’ ঝটপট একই উত্তর এলো, ‘নো ইংলিশ।’ সবাই আপার দিকে চাইতেই আপা বললেন, ‘হোয়াট ইজ ইংলিশ?’ বলেই আমার গলাটা এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন বা চেপে ধরলেন মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে নিজের অজান্তেই। মহিলাটি তোতা পাখির মতন আওড়ে যেতে লাগলেন, ‘নো ইংলিশ, নেভার ইংলিশ।’
পুলিশ এবার সবার দিকে চেয়ে ইনজেনারেল জিজ্ঞাসা করলো, ‘কে মার্ডার হয়েছে?’
সবাই চুপ। কেউ তো হয়নি। কে কাকে দেখাবে।

আপা হঠাৎ আঙুল তুলে ওই মহিলাটিকে দেখালেন। আপা হয়তো বলতে চাচ্ছিলেন সেই নাটের গুরু। কিন্তু পুলিশ বুঝলো না। বললো সবাই তো দেখছি দাড়িয়ে রয়েছে, ‘কে মারা গেছে তাহলে।’
আমি এক যটকায় আপার হাত সরালাম জান বাঁচানোর তাগিদে। এবার আমার কথা বলার সুযোগ হলো। বললাম, ‘একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। সরি।’ এরপর কারণটা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করলাম।

ওইদিকে আপা একটু পর পরেই হাত তুলে ওই মহিলাটিকে দেখাচ্ছেন। মহিলাটিও অসহায়ের মতো মুখোভঙ্গি করে পেছনের দিকে কাউকে দেখাচ্ছেন। ওনার পেছনে যে কেউই দাড়ানো নেই সেটা বোধহয় ওনার জানাই নেই। চোখ বন্ধ করে যে কারোর দিকে আঙুল তোলাই স্বভাব মনে হয়, যেন সে ছাড়া সবাই দোষী। ভদ্রমহিলাটি যে পুলিশ দেখে ভয় পেয়েছে ভালোই তা বোঝা যাচ্ছে।

পুলিশ আমার কথা শুনছে আর অবাক হয়ে ওদের দুজনার হাত চালাচালি দেখছে। শেষে বললো, ‘তুমি শিওর তো এখানকার আর কাউকে সাইকিয়াট্রিকের কাছে নেয়ার দরকার নেই? থাকলে সবাইকে এক ভ্যানে করে তুলে নিয়ে যেতে পারি। আগের জনকেও তো সেখানে নিতে হবে।’
মহিলাটি সঙ্গে সঙ্গে আপার দিকে চেয়ে বললো, ‘আপনার ছেলে পাগল হয়ে গেছে?’ এবার সে ইংরেজি বুঝলো কেমন করে? দরকার মতো বুঝে দরকার মতো বুঝে না! আমি অবাক হয়ে মহিলাটিকে দেখলাম।

দুলাভাই বললেন, ‘আমি ঠাণ্ডা হওয়ায় একটু নিঃশ্বাস নিতে যাচ্ছি। এখানে বেশিক্ষণ থাকলে আমিই পাগল হয়ে যাবো।’ পুলিশগুলোকে বললো, ‘আপনারা যাকে যাকে খুশি ধরে নিয়ে যান, আমার কোনো আপত্তি নেই।’
দুলাভাই লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে বের হয়ে গেলেন। ওনার পেছন পেছন পুরুষ সমাজও। দুলাভাইয়ে সঙ্গে তারাও কিছুক্ষণ হাটবে। পুরো ঘটনাটা কারো কাছেই পরিষ্কার না এখনো। প্রচুর সান্ত্বনার বাণী নিয়ে অনেকক্ষণ ধরেই সবাই অপেক্ষা করছে কিন্তু ঘটনা না জেনে কিভাবে কোনটা বর্ষাবে? পুলিশও বিদায় হলো।

সবাই যেতেই আপা মহিলাটির দিকে চেয়ে বললেন, ‘রিনি তুমি এবার যাও তো। অনেক নাটক করেছো। বাসায় গিয়ে ঠাণ্ডা শরবত খাও গে।’
আপা ঘরে ঢুকে মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে বসে পড়লেন। মহিলাটিও যার নাম এই মাত্র জানলাম রিনি, তিনিও ঘরে ঢুকতে উদ্যত হতেই আপা বললেন, ‘ঢুকবে না। যাও বাসায় যাও। তুমি থাকলে আমার মাথা ঠাণ্ডা হবে না।’ আমিও দরজা থেকেই বিদায় হবো কিনা ভাবছি। কিন্তু আপা ডেকে বললেন, ‘এক গ্লাস পানি দাও আর দরজাটা শক্ত করে ভেতর থেকে বন্ধ করে দাও।’ বারান্দাতে আরো কিছু বাঙালি ভাবী দাঁড়ানো ছিল তারা নিজেরাই অবস্থা বুঝে সরে যাচ্ছে। চাইনিজ দুটো অবশ্য নট নড়ন-চড়ন। অন্য দেশী পাবলিক তাই ভদ্রতা করে বললাম, ‘Thank you, bye now.’ আপা চেঁচিয়ে বললেন, ‘কী Thank you. বল যে গেলি তোরা।’
আমি দরজাটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিলাম।

পানি ঢালতে ঢালতেই শুনলাম আপা কাঁদছেন আর বিলাপ করছেন, ‘এই বাঙালি সমাজে আজ থেকে উনি মুখে দেখাবেন কিভাবে?’ ইত্যাদি বলছেন। বলছেন,

‘ছেলে তার বন্ধুকে দুষ্টামি করে বলেছে সে আজ রাতেই আত্মহত্যা করবে। আমেরিকান বন্ধু। বোঝেনি। দুষ্টামিকে সত্যি ভেবেছে। পুলিশকেও জানিয়েছে বন্ধুর জান বাঁচানোর জন্য। সে থাকে অন্য স্টেট-এ, নিজে ছুটে আসতে না পারলেও পুলিশকে ছুটিয়ে বেড়াচ্ছে। মাঝখান দিয়ে সবাই এখন ফেসেছে।’

আমি গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে তার কথা শুনে যেতে লাগলাম। আমার মনেও প্রশ্ন অনেক। কিন্তু তাকে একটিও জিজ্ঞাসা করার সাহস নেই।
তিনি নিজেই বলে যেতে লাগলেন, ‘কাল থেকে দেখবে না কতো গল্প চালু হয়েছে আমার ছেলেকে নিয়ে। সাধারণ একটা রসিকতা নিয়ে কি দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার। পুলিশ এসে তাকে একবার এভাবে উল্টে দেখে আরেকবার ওইভাবে। শেষে হাজতে না হসপিটালে নিয়ে গেল। আবার বলে গেল আগামী কিছুদিনও দরকার পড়লে পর পর কয়েকবার সাইকিয়াট্রিকের কাছে যেতে হবে। মানে আছে এসবের কোনো?’
আমিও মাথা দুলিয়ে সায় দিলাম বা সান্ত্বনা দিলাম, ‘না কোনোই মানে নেই এসবের। আমরা যা খুশি করবো, ইচ্ছা হলে বাঁচবো, ইচ্ছা হলে মরবো, তাতে কার কি? My life is my life.’

আমার কথাতে অবশ্য আপা ভ্রু-কুচকে তাকানোর অবকাশ পেলেন না কারণ উনি তখন হু হু করে কান্নায় ব্যস্ত। আমার কথা হয়তো উনার কানেও গেল না। ছেলে ফিরে না আসা পর্যন্ত উনি কাঁদতেই থাকবেন।
এক সময় আমিও উঠলাম।

পাড়াটা নীরব হয়ে গেছে। চুপচাপ। রাত পুরোপুরি গভীর হয়ে গেছে। সিড়ির নিচে একা দুলাভাই দাড়িয়ে রয়েছেন। সিগারেট টানছেন। ছেলের অপেক্ষায়। হাঁটা শেষ করে কখন যেন ফিরে এসে অপেক্ষা করছেন।
আমাকে দেখে দুলাভাই বললেন, ‘আচ্ছা কন তো আমার ছেলে দোষটা কি করলো?’
বললাম বলতে ভুল বলেছে, ‘ওর বলা উচিত ছিল সুইসাইড খাবো। খাবো বললেই ঘটনাটা বদলে যেতো।’
উনি অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইলেন কয়েকটা মুহূর্ত কথাটা বোঝার জন্য তারপরে হাসতে লাগলেন। আমি আর ওনার হাসাতে যোগ না দিয়ে

আমার বাসার দিকে হাঁটা দিলাম। একটু এগুতেই আমার বাসার সিড়ি। একবার পেছন ফিরে চাইলাম।

নিঃসঙ্গ একা দাড়ানো এক বাবা, উপরে জানি মাও আছেন অপেক্ষায়। My life কখনওই শুধু কি My life? My life এর পেছনে দুজন মানুষ সবসময় আছেন। কী সুখে কী দুঃখে।

আমার সিড়ির ধাপে দেখলাম নিহা দাড়িয়ে রয়েছে। আজ রাতে সে আমাদের বাসায় থাকবে। নিহা আমার বান্ধবী। আজ থেকে বহু বছর আগে এক যুবক ওকে বলেছিল তুমি ভালো না বাসলে আমি মরে যাবো। সুইসাইড করবো। এরপর নিহা অযথাই ভালবাসতে গিয়েছিল তাকে। আমার ধারণা নিহা সম্ভবত ভুল শুনেছিল। ওই ছেলে বলেছিল সুইসাইড খাবো। সেই ভালোবাসার ছেলে না হলে আজ কেমন করে চলে গেছে বহু দূরে। নিহাও চলে এসেছে আরো দূরে কোথাও। কেউ কারো জন্যই সুইসাইড করেনি। এতোই কি সহজ মরা! এ দেশে তো আরো কঠিন।

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক দিলরুবা আহমেদ

লেখকঃ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক

যুক্তরাষ্ট্র বিষয়ক আরও লেখা-

জনপ্রিয় অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর লেখা-

করোনা সচেতনতা: যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ ষ্টাইল

জনপ্রিয় লেখক ও গবেষক রউফুল আলমের লেখা-

পদ-পদবীর টিকেট নিয়ে ক্ষমতার প্রদর্শন নেই যুক্তরাষ্ট্রে

আরও পড়ুন