Ads

ভ্রমণকাহিনীঃ সূর্যস্নাত বেন নেভিস

।। আমিনা তাবাসসুম ।। 

প্রকৃতি যাকে দেয়, একেবারে উজার করেই দেয়। স্কটিশ হাইল্যান্ডের জায়গাগুলোর সৌন্দর্য যেন সেই উজাড় করা সৌন্দর্য, দেখলে কিছুতেই আর চোখ ফেরানো যায়না। তবে আপাতদৃষ্টিতে প্রকৃতি উজাড় করে দিলেও, কোথাও না কোথাও একটা অপূর্ণতা ঠিকই রেখে দেয়। স্কটিশ হাইল্যান্ডের সেই অপূর্ণতা মনেহয় সেখানকার আবহাওয়া। গ্রীষ্মের সময়ও বৃষ্টি আর ঠান্ডার কোন কমতি নেই। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে সেই বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকেই উঁকিঝুঁকি করে সূর্য। আর সেই সূর্যস্নাত স্কটিশ হাইল্যান্ডের সৌন্দর্য যেন অবর্ণনীয়।

২০২১ সালের মে মাসের শেষে ইংল্যান্ডের স্কুলগুলো এক সপ্তাহের জন্য ছুটি ছিল। তখন সবেমাত্র এখানকার লকডাউন খুলেছে। হঠাৎ করেই যেন আবহাওয়াটাও একটু চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। ইংল্যান্ডের মানুষজনের সেই ছুটিতে একেবারে বাঁধনহীন, লাগামহীন অবস্থা। দীর্ঘ লকডাউনের দমবন্ধ জীবন থেকে সবাই যেন খোলা আকাশের নিচে একটু মুক্তির আস্বাদ পাবার জন্য উতলা হয়ে ছিল।

আমরাও এর ব্যতিক্রম না, মুক্তির স্বাদ নেবার আশায় পরিবার নিয়ে সাত দিনের জন্য চলে গিয়েছিলাম সেই স্কটিশ হাইল্যান্ডে। আগেও আমরা এখানে বেড়িয়েছি, কিন্তু এবার আমাদের ভাগ্য ছিল সুপ্রসন্ন। সাতটা দিনই ছিল একেবারে ঝকঝকে, তকতকে এবং রৌদ্রোজ্জ্বল। তাপমাত্রাও ছিল ২০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের এদিক ওদিক। সেই রোদমাখা দিনগুলোতে আমরা হাইলান্ডের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত একেবারে চষে ফে বেড়িয়েছি। বর্ণনাতীত সৌন্দর্য অবলোকন করেছি। এর মধ্যে বেন নেভিস পর্বতের সৌন্দর্য যেন আলাদাভাবে মনে রাখার মতো।

স্কটল্যান্ডের ল্যাণ্ডস্কেপ কুয়াশা আর মেঘে ঢাকা পাহাড়-পর্বতে পরিপূর্ন। কিন্তু তার মধ্যে সব পর্বতের রাজা যেন এই বেন নেভিস। ১৩৪৫ মিটার উচ্চতার বেন নেভিস ব্রিটেনের সর্বোচ্চ পর্বত। হাইল্যান্ডের লহাবা (Lochabe) অঞ্চলের প্রখ্যাত ফোর্ট উইলিয়াম শহরের কাছাকাছি অবস্থিত এই পর্বত। গ্র্যাম্পিয়ান (Grampian) পর্বতমালার একেবারে ঠিক পশ্চিম প্রান্তে রাজকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে এই বেন নেভিস।

সূর্যস্নাত বেন নেভিসপ্রাচীনকালে বেন নেভিস বিশাল এক আগ্নেয়গিরি ছিল। বাইরে থেকে খুব একটা বুঝা না গেলেও, নিজের মধ্যেই অগ্ন্যুৎপাত হয়ে, বিস্ফোরিত হয়ে ভিতরে ভিতরে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায় এই পর্বত। এর শিখরে হালকা রঙের গ্রানাইট সেই বিস্ফোরণের চিহ্ন এখনো ধারণ করে আছে।

বেন নেভিসের নামকরণও বেশ কৌতূহলের। প্রাচীন গেইলিক ভাষার এই নামের দুই ধরণের অনুবাদ হতে পারে। একটা অনুবাদ হলো, ‘mountain with its head in the clouds’। বাংলায় কাব্য করে হয়তোবা বলা যেতে পারে; “যে পর্বতের শিখর মেঘের দেশে”। আরেকটা মানে হলো “venomous mountain”। অনেকে একে “বিষাক্ত পর্বত” বা “অশুভ পর্বত” বলে অভিহিত করে থাকে।

এর আগেরবার যখন স্কটিশ হাইল্যান্ডে বেড়াতে এসেছিলাম তখন বেন নেভিস ঘুরে দেখেছি। কিন্তু সেই দিনটা ছিল মেঘে ঢাকা বৃষ্টিস্নাত একটা দিন। তাই এবারে এরকম অনুকূল আবহাওয়া পেয়ে সূর্যস্নাত বেন নেভিস আরেকবার দেখার লোভ আর সামলাতে পারলামনা।

তাই একদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সোজা চলে গিয়েছিলাম বেন নেভিসে। শিখরের কাছাকাছি যাবার জন্য কষ্ট করে পর্বত আরোহন করা লাগেনা। মাউন্টেন গন্ডোলাতে চেপে বসে ছবি তুলতে তুলতে আর দৃশ্য উপভোগ করতে করতে তরতর করে পাহাড়ের উপরে উঠে যাওয়া যায়। আমরাও সেটাই করেছিলাম। তবে যারা একটু অ্যাডভেনচারে আগ্রহী তাদের জন্য হেঁটে উঠারও খুব সুন্দর পথ আছে। একদম ক্যাজুয়াল ওয়াকারও সাত থেকে নয় ঘন্টায় উপরে উঠে আবার নেমে আসতে পারবে। আমার মেয়ের অনেক শখ ছিল যে হেঁটে উঠবে। সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে যায়নি দেখে আমরা আর সাহস করিনি।

মাউন্টেন গন্ডোলাতে করে পাহাড়ের উপরে উঠার পর খুবই সহজ একটা রাস্তা ধরে বিশ পঁচিশ মিনিট হাঁটলেই অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের এক ভিউপয়েন্ট। সেখানে গিয়ে দেখি চারিদিকে লেক, পাহাড় আর সবুজের সমারোহ। শুধু তাই না, এই রৌদ্র ঝকঝকে দিনেও পাহাড়ের মাথায় বরফের একটা টুপি ঠিকই পরানো আছে।

পাহাড়ের চূড়ার একেবারে ধার ঘেঁষে ছোট বড় অনেক পাথর। একটা বিশাল পাথরের উপর দেখলাম এক মহিলা দুই হাত উঁচু করে রাজকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। বিশাল আকাশের নিচে রাজকীয় ভঙ্গিতে এই ছবি তোলা দেখে আমারো সাথে সাথে ছবি তোলার শখ জাগলো। আমার হাজবেন্ডকে সেটা জানানো মাত্রই সে মোবাইল ফোন নিয়ে দূরে নিরাপদে ছবি তোলার জন্য দাঁড়িয়ে গেলো। আমি খুশি মনে আরেকটা বিশাল চওড়া পাথরের উপর উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু ব্যাপারটা দেখতে যতটা সহজ মনে হয়েছিল আসলে ব্যাপারটা মোটেও সহজ না। পাথরের পেছন দিকে একেবারে পাহাড়ের খাড়া ঢাল। পাহাড়ের উপর প্রচন্ড বাতাস। আমি ছোটোখাটো মানুষ, আমার মনে হচ্ছিলো দাঁড়ানো মাত্রই বাতাসে উড়ে গিয়ে একেবারে পাহাড়ের নিচে পড়ে যাবো। জানের ভয় বাবা সবচেয়ে বড় ভয়। মরে যাবার ভয়ে সেই রাজকীয় ভঙ্গিতে ছবি তোলার শখ সাথে সাথে মিটে গেলো। আমি অতি সাবধানে কোনোরকমে পাথরের উপর বসে পড়লাম। ভাবলাম বসে বসেই একটা ছবি তুলে ফেলি। কিন্তু আমার হাসবেন্ড দেখলাম নাছোড়বান্দা। দাঁড়িয়ে হাত উঁচু করে ছবি তোলার শখ করেছি যখন তখন আমাকে সেই ছবিই তুলতে হবে। কোনো ছাড়াছাড়ি নাই। বুঝলাম না আমার ছবি তোলার ব্যাপারে তার এত আগ্রহ কেন? আমাকে পাহাড়ের নিচে ফেলে দেবার মতলব নাকি? যাইহোক, দোয়া পড়তে পড়তে কোনোরকমে দাড়িয়ে একটা ছবি তুলে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

ছবি তোলা পর্ব শেষে আরো কিছুক্ষন পাহাড়ে কাটালাম, তারপর সেখানকার ক্যাফেতে বিশ্রাম নিলাম, চা কেক খেলাম, সবশেষে আবার সেই মাউন্টেন গন্ডোলাতে চেপে বসে দৃশ্য উপভোগ করতে করতে পাহাড়ের নিচে নেমে আসলাম।

আগেই বলেছি যে বেন নেভিস ফোর্ট উইলিয়াম (Fort William) শহরের কাছেই অবস্থিত। স্কটিশ হাইলান্ডের আরেকটি বড় আকর্ষণ হলো ঐতিহাসিক গ্লেনফিনান ভিয়াডাক্ট (Glenfinnan viaduct)। রেলপথের এই দীর্ঘ সেতু বা ভিয়াডাক্টের উপর দিয়ে পার হয় জেকোবাইট স্টিম রেল (Jacobite Steam Train)। সেই ট্রেন যাত্রাও স্কটিশ হাইল্যান্ডের এক আইকনিক যাত্রা। আর সেই যাত্রা শুরু হয় ফোর্ট উইলিয়াম থেকে আর শেষ হয় এক মৎস বন্দর শহরে, যার নাম মালায়েগ (Mallaig)। বেন নেভিস বেরিয়ে ট্যুরিস্টরা খুব সহজেই ফোর্ট উইলিয়াম থেকে এই যাত্রাটা সেরে ফেলতে পারে। শুধু মালায়েগ থেকে ফেরার শেষ ট্রেনটার সময়ের দিকে একটু খেয়াল রাখতে হবে। তা না হলে মালায়েগে আটকা পরে যাবার একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। আমরা আগে এই ট্রেন জার্নি করে ফেলেছি, তাই এবার রেললাইন বরাবর ড্রাইভ করে সেই একই দৃশ্যাবলী উপভোগ করার মনস্ত করেছিলাম। পথে অবশ্য একবার থেমে গ্লেনফিনান ভিয়াডাক্টের সাথে ছবি তোলা বাদ দেইনি। আর সবশেষে মাছের জন্য প্রখ্যাত মালায়েগ শহরে গিয়ে সেখানকার ফিশ এন্ড চিপস দিয়ে ডিনার করে দিনটার ইতি টেনেছিলাম।

এবারের সাতদিনের হলিডেতে স্কটিশ হাইল্যান্ডের অনেক জনপ্রিয় স্থান দেখা হয়েছে, অনেক কম জনপ্রিয় নিরিবিলি জায়গাও দেখা হয়েছে আর মাইলের পর মাইল ড্রাইভ করা হয়েছে। প্রতিটা জায়গা সুন্দর, প্রতিটা জায়গার ভিন্ন একটা আকর্ষণ আছে, ভিন্ন আবেদন আছে। তবে সব জায়গার মধ্যে এই সূর্যস্নাত বেন নেভিস দেখার অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে অন্যতম।

লেখকঃ ব্রিটেন প্রবাসী বাংলাদেশী

আরও পড়ুন-দ্বিতীয় প্রেম

আরও পড়ুন