Ads

পরবাস কাল

 সালমা সাহলি

আরফান অনেকক্ষণ সময় ধরে মোবাইল হাতে বসে আছে বারান্দায় পেতে রাখা লোহার চেয়ারে। অনেক রকমের এলোমেলো চিন্তা তার মাথায় ভিড় করছে। কথাগুলো বলা খুব দরকার, কিন্তু তাতে অবস্থা কি দাঁড়াবে? তার কথা কি বিশ্বাস করবে? যদি বিশ্বাস করে, তাহলেও সবার আগে তো ফখরুদ্দিনভাইকেই কথাগুলো বলবে; তারপর বলবে মাকে, তারপর ছোট বোনকে। এটা সত্যি যে এতে সমস্যা হবে। আর যদি না বলে তাহলে ধীরে ধীরে অবস্থা আরো জটিল হতে পারে। তার দ্বিধা দ্বন্ধময় চিন্তার মাঝে বাধ পড়ল, যখন কেউ একজন পেছন থেকে তাকে দেখে চলে গেল আবার ভেতরে। টের পেল সে, তবু পেছনে তাকাল না। তারপর দ্বিধার পর্দা ঠেলে শেষ পর্যন্ত কলটা করেই ফেলল। ওপাশ থেকে নাজরিন বলল,

-হ্যালো আরফান!

-আসসালামুয়ালাইকুম।

-ওয়ালাইকুমাচ্ছালাম।

-কেমন আছেন?

-ভাল আছি। তুই কেমন আছিস?

-ভাল। আফরা কেমন আছে?

-ভাল আছে।

-ওর কথা খুব মনে পড়ে। আমার কথা ওর মনে আছে?

-আছে।

-ছয় মাস হয়ে গেল ওকে দেখেছি। এখন কত বড় হয়েছে?

-তেমন বড় হয়নি। আফরা খেতে চায় না। ওকে খাওয়াতে অনেক কষ্ট।

-আপা, আমি শুনেছি, বাচ্চাদের জোর করে খাবার খাওয়ালে তারা আরো বেশী খেতে চায় না। জোর না করে আদর করে খাওয়াতে চেষ্টা করতে পারেন আপা। তাহলে দেখবেন সে নিজে থেকে খেতে শুরু করবে।

-তুই এত যে উপদেশ দিচ্ছিস; কয়টা বাচ্চা পেলেছিস?

-আমি পালিনি, কিন্তু আমার আপা পালছে। সেই জন্য আমিও অনেক কিছু জানি। আমার আপা হচ্ছে একজন মা, আর আমি হচ্ছি মামা। অর্থাৎ মা, মা; দুই জন মায়ের সমান হচ্ছে, মামা।

-ফাইজলামি ছাড়। তোর ফখরুদ্দিনভাই কোথায়?

-নিজের রুমে। মনে হয় টিভি দেখছে।

-আর তুই কোথায়?

-বাসার বাইরে, সামনে খালি জায়গায় চেয়ারে বসে আছি। আপা ফখরুদ্দিনভাইয়ের সাথে আপনার এখনও কথা শুরু হয়নি?

-সেটা জেনে তুই কি করবি?

-বলেন না, এখনও কি কথা বন্ধ?

-তোর জানার দরকার আছে?

-আছে আপা। এভাবে কথা বন্ধ রাখা কি ঠিক হচ্ছে?

-তুই কেন এসব নিয়ে মাথা ঘামাস? তোকে না মানা করেছি, এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে না? আমার ব্যাপার, আমি বুঝব। তুই তোর কাজ কর।

নাজরিন বেশ রাগত কন্ঠে বলল কথাগুলো। আরফান মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলাল, বোনকে আর কিছুই বলা যাবে না। বললেই সে রেগে ফখরুদ্দিনভাইকে এসব কথা জিজ্ঞাসা করবে এবং আম্মু আব্বুকেও বলবে। সে শান্ত হয়ে বলল,

-ওকে আপা, ঠিক আছে। আপনি রাগ করবেন না। আমি আর মাথা ঘামাচ্ছি না। এমনি জানতে চাচ্ছিলাম।

-তোর না জানলেও চলবে।

-আপনার কথা আমার না জানলেও চলবে ঠিক আছে, কিন্তু আমার কথা আপনার তো জানা উচিৎ, তাই না? আপনাদের এমপ্লয়ই আমি।

-নিজেকে এমপ্লয়ি কেন বলছিস? তোকে তো তোর ফখরুদ্দিনভাই এমন কথা বলেনি। নাকি বলেছে?

-না, বলেনি।

-তাহলে এসব বাজে কথা কেন বলিস?

-কিন্তু বাস্তবতা তো সেরকমই।

-তুই আর কখনো আমাকে এমন কথা বলবি না।

-ওকে, তবে আপনার কিন্তু সব জানা উচিৎ, আমার সব কথা এবং আমার অবস্থা।

-তোর কি অবস্থা? তোর কি কোন সমস্যা হয়েছে?

-আমার কোন সমস্যা হয়নি।

-তাহলে বললি যে তোর অবস্থা জানা উচিৎ? এটা কেন বললি?

-কিছু না। এমনি বলছিলাম।

-কি বলতে চাস আর কি বলতে চাস না, সেটা কল করার আগে ঠিক করে নিবি।

-বুঝতে পারছি, আজকে আপনার মেজাজ খারাপ। এখন আর কথা বলা ঠিক হবে না। আমি যা-ই বলব এখন সেটাই আপনার কাছে বিরিক্তিকর মনে হবে…। আচ্ছা পরে কথা বলব।

-তোর কাশি গেছে?

-হ্যাঁ, কমেছে। আপা এখন তাহলে রাখি।

নাজরিন ভাইয়ের কথার উত্তরে চুপ করে থাকল কয়েক মুহূর্ত, তারপর ক্ষীণ কন্ঠে বলল,

-তোর ফখরুদ্দিন ভাই কিছু কি বলেছে?

-কি বলবে? এখানকার কাজের কথাই তো হয়।

-আমি ভাবলাম আমার প্রসঙ্গে কিছু হয়ত বলেছে তোকে।

-না।

-কি বলতে চেয়েছিলি তখন?

-কিছু না।

-বল না!

-তেমন কিছু না।

-কি বলতে চেয়েছিলি বল।

-সে রকম বলার মত কিছু না আপা। আপনি তো আমাকে কল দেন না। একটা মেসেজও দেন না।

-আমি বাচ্চা, শাশুড়ি নিয়ে ব্যস্ত থাকি। তুইও তো কল করিস না। অনেক দিন পর একবার কল করিস।

-আমিও ব্যস্ত থাকি আপা। সময় পাই খুব কম। মাঝে মাঝে সময় পেলে আম্মুকে কল দিয়ে কথা বলি।

-আমি তো শুনেছি, তুই ঘন্টার পর ঘন্টা সালাম চাচুর সাথে কথা বলিস।

-হ্যাঁ, মাঝে মাঝে কথা বলি। যখন সারাদিন কাজ শেষে ঘুমাতে যাই, আম্মু আব্বুকে খুব মিস করি, তখন ওনারা ঘুমিয়ে থাকে। আর এই দিকে আমার ঘুম আসে না। তখন যদি ইসলাম বিষয়ে কিছু জানার থাকে তখন সালাম চাচুকে কল দিয়ে কথা বলি। উনিও তো বিদেশেই থাকেন, সময়টাও আমাদের থেকে দুই ঘন্টা পেছনে, উনি জেগে থাকেন তখনো। আর আপনাদের সাথে যখন কথা বলতে সময় পাই, তখন আপনারা ঘুমে থাকেন।

-দিনের বেলা একটা কল দিয়ে পাঁচ মিনিট কথা বলার সময় তোর হয় না! তোর ফখরুদ্দিন ভাই কি তোকে এত কাজের চাপে রেখেছে!

-আমি কি তা বলেছি?

-তোর কথায় তো সেটাই বুঝায়। বললি দিনের বেলা সময় পাস না। কিন্তু দুপুরে তো দেড় দুই ঘন্টা সময় থাকে।

-থাকে না আপা, খাওয়া, গোসল, নামজ পড়ে আর তেমন সময় থাকে না।

-পাঁচ মিনিট টাইম থাকে না! আর তুই পাঁচ দশ মিনিট দেরী করে কাজে গেলে তোর ফখরুদ্দিনভাইও নিশ্চয় কিছু বলবে না! নাকি বলবে?

-আচ্ছা, এখন থেকে কল দিব। এখন রাখছি।

-মাঝে মাঝে সময় বের করে কল দিস।

-আচ্ছা দিব।

-ঠিক আছে, ভাল থাকিস। আল্লাহ হাফিজ।

-আল্লাহ হাফিজ।

 

আরফান মনে কষ্ট চেপে কথা শেষ করল। সে তার বোনকে বলতে পারল না যে, একদিন দুই রাকায়াত সুন্নাহ নামাজের কারণে চার বা পাঁচ মিনিট দেরী করে কাজে গিয়েছে বলে তার বোনজামাই  কেমন কথা শুনিয়েছিল। এটাও বলতে পারল না যে সন্ধ্যায় একটু সময় পেলে তাকে বাজার করতে যেতে হয়। একটু কুরআন পড়া বা কারো সাথে একটু কথা বলার জন্য সে তার ঘুমের জন্য বরাদ্দ সময়টুকু ব্যয় করে। যে ফখরুদ্দিন ভাইকে সে এবং তার পরিবার চেনে, এই ফখরুদ্দিন সে চেনা থেকে ভিন্নতর। ইনি দাম্ভিক, নিষ্ঠুর এবং স্বার্থপর একজন লোক। টাকা আর ক্ষমতা ওনাকে অনেক বদলে দিয়েছে। উনি মাঝে মাঝে পার্টি করেন, তার এক ডিভোর্সি মামাত বোনের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলেন, নিজের স্ত্রী সন্তান সম্পর্কে এখানে তার বন্ধুর কাছে বদনাম করেন, নিজের শশুড় শাশুড়িকে ছোট করে কথা বলেন, ধর্ম কর্ম বলতে প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তার পীরের ছবির বিশাল ফ্রেম টাঙিয়ে ফুল দিয়ে আসন বানানো রুমটিতে গিয়ে লোবান জ্বালিয়ে অস্পষ্ট শব্দে জিকির করা। তার এই সব বিকৃত আচরণের কথা আরফান কাকে বলবে? সে মোবাইলটা বাম হাতের তালুতে রেখে উল্টাতে উল্টাতে ভাবল, তার কি করা উচিত? তার বোনটা অন্যায় ভাবে কষ্ট পাচ্ছে। আবার তাকেও এখানে কষ্ট আর অপমান সহ্য করে থাকতে হচ্ছে। ফখরুদ্দিনের আচরণ দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠছে। কিন্তু এই কথা মা বাবা ভাই বোনকে বলতে পারছে না। নিজেও কিছু করতে পারছে না। মেনে নিতে হচ্ছে এতগুলো অন্যায়। এখানে সে, আর দেশে তার মা সব থেকে বেশী কষ্ট পাচ্ছে। ছটফট করছে মায়ের মন তার জন্য। সে জানে তার মা সেটা ঠিক ভাবে প্রকাশও করতে পারেন না, পাছে বিদেশে ছেলের মন অস্থির হয়ে যায়। আরফান যেমন সেটা বুঝতে পারে, তেমনি মাও হয়ত মনে মনে জানেন, বুঝেন। এই দিকে এখানেও আরফানকে কত রকমের পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে, কিছু কিছু ব্যাপার সইতে হচ্ছে যা তার সহ্য করার কথা নয়, কিন্তু কাউকে তা বলার উপায় নেই। গতকাল সে দেশে প্রায় দুই ঘন্টা কথা বলেছে। ভাই, বাবার সাথে কথা শেষে মা কথা বলেছিলেন। প্রতিদিনকার মত কালকেও শরীর স্বাস্থ্য, খাওয়া দাওয়া নামাজ তিলাওয়াতের খোঁজ নিয়েছেন তার মা। কথা শেষ করার আগে বললেন, রুমি আমি শান্তি পাচ্ছি না, তুই বাবা সত্যি করে বল কেমন আছিস? আলিয়া বেগম ছেলেকে আদর করে রুমি ডাকেন। আহা কত দিন মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলা হয় না,- “আম্মু আপনি আমার এই দুনিয়ার জান্নাত”। “আর তোরা হলি আমার দুনিয়ার জান্নাতি সুখ”- হাসি মুখে প্রতিউত্তরে মায়ের এই বাক্যটি কত দিন শুনা হয়নি। আরফানের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে টপ টপ করে। বিদেশে আসার আগে সে কখনও চোখের পানি ফেলেছে তার মনে পড়ে না। কিন্তু ইদানীং প্রায় তার চোখ ভিজে উঠে। অন্য সময় হলে সে কান্না চেপে রাখত, কিন্তু এখন আর কাঁন্না চাপার চেষ্টা করল না, গড়িয়ে পড়া চোখের পানি মুছল না পর্যন্ত। বেশ কিছুক্ষণ নীরবে কান্নার পর তার নিজেকে একটু হালকা মনে হল যেন।

আলমগীর বাইরে থেকে এসে খোলা দরজায় প্রবেশ করতে গিয়ে আরফানকে দেখতে পেয়ে তার দিকে এগিয়ে এসে বলল,

-আরফান ভাই, আন্দারে বইয়ে কি করতেচেন, মোবাইলে কথা বইলচেন্নি!

-কথা বলা শেষ।

-আপনে এখানে বসি মবাইলে কথা বলেন ত, বাব্লাম এখন কথা বলচেন।

-হ্যাঁ, অনেক দিন পর আমার আপার সাথে কথা বললাম।

-আপনে কথা বলেন আর নয়লে চুপচাপ এখেনে আসি বসি থাকেন।

-ভীতরে সবাই টিভি দেখে, হাসাহাসি আর জোর আওয়াজে কথা বলে, তাতে আমার মাথা ব্যথা উঠে যায়। তায় অবসরে নিজের মত করে এখানে একা একা বসে থাকি। আপনি বাইরে গেলেন কখন? দেখতে পাইনি তো।

-মাথার চুল কাইটতে গেছিলাম।

-চুল কাটিয়েছেন! দেখে তো মনে হচ্ছে না।

-ঠিক ধরছেন। নাইফতের দোকান সইন্দার পর বন্দ হই যাই। আমি হেইটা জাইন্তাম না।

-দিনের বেলা যান নাই কেন?

-আপনার বোইঞ্জামাই কেমন মানুষ, জানেন না বাই? আমি পুরান মানুষ, তাও যদি আদা বেলা ছুটি নি, টাকা কাটব। একবার অনারে বলে কয়ে চুল কাইটতে গেলাম। বেতন দেওনের সময় দেখি বেতন কম দিচে। জিজ্ঞাইলাম, কইল, এক দিন চুল কাইটতে গেচি আরেকদিন দেশে জিনিস পাটাইবের লাই একজনের লগে দেখা করতে গেচি। এইবার ভাইবা দেখেন আপনের বোইঞ্জামাই কেমন মানুষ।

-এটা তো ওনার ব্যবসা। সেই জন্য এই সব নিয়ম…

-আরে বাই বাদ দেন। দেখি না, আপনি যে আপন মানুষ, গরের লোক, হেরফরেও আপনার লগে কেমন করে…।

-ঐযে বললাম, এটা ওনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সবার জন্য এক নিয়ম।

-কই নিজের বাইয়ের লগে তো এক নিয়ম খাটায় না। আজ দুই মাসের বেশী সময় দরে দেকচি।

-নাশিদ ভাই নতুন আসছে তাই হয়ত…।

-এইসব কথা কয়ে পোলাপাইনেরে বুঝ দেয়া যায়, বাই আমগোরে না। আপনে আইলেন দেশ থেইকে, বিদেশে নতুন, আর অনার ভাইরে আইন’ল বাহরাইন থেইকে, বিদেশ করা পুরান মানুষ। আপনের কাজ শুরু হইল সকাল থেইকে। আর তার বাইরে দেখেন কি করতাছে, মাতায় তুলি রাখছে।

-ওনার ছোটভাই, ওনারা মালিক মানুষ, ওনাদের সাথে কি কর্মচারিদের সাথে তুলনা চলে!

-আপনে তো তার শালা।

-সম্পর্কে শালা, কিন্তু চাকরী করি ওনার আন্ডারে, আপনাদের মত।

আরাফান হেসে উত্তর দিল। দুরের হালকা আলোয় আলমগীর দেখতে পেল না আরফানের হাসি আসলে কান্নার মত দেখাচ্ছিল। তবু সে বলল,

-বুইচ্ছি। কষ্ট হইলেও বলবেন না। আপনার ভাই আসছিল দুই বছর আগে। সেও কষ্ট পায়য়ে পরে ভাগছে। আমগো সবাইরে মানা করছে, আপনারে যেন কোন কথা না বলা হয়। আপনি তো শিক্ষিত ভদ্র মানুষ, কোন অহং নাই, তাই এই সব সইয্য করতাছেন, অন্য কেউ হইলে…।

-আলমগীর ভাই, এসব কথা বাদ দেন। আপনি বাইরে থেকে এসেছেন, হাত মুখ ধুতে যান। ওয়াশরুম তো একটা, আপনি তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে যান। আমি অযু করব, ঈশার নামাজের সময় হয়ে গেছে।

-বুইচ্ছি। দুলাবাইয়ের বদনাম শুইন্তে ভাল লাগে না।

-দুলাভাই বলে নয়, আমি অন্য কারো সম্পর্কে কি বদনাম আলোচনা করি? কখনো শুনেছেন? এসব করলে গিবদ হয়। গুনাহ হয়।

-গিবদ তো করতেছি না ভাই। অনি জুলুম করে, আপনারেও ছাড় দেয় নাই। আমরা তো যা আছি কিন্তু আপনের কথা ছিন্তা করেন, কি করতেচে আপনের লগে? আপনের তো কোন রেস নাই। সকাল থেইকে ঘুমের আগে ফইয্যন্ত আপনারে খাটায়…।

-আমি একটা কথা বুঝি, ‘যে যা করবে সব কিছুই আল্লাহর কাছে জমা হচ্ছে। পর কালে সেটার ফল পাবে’। এই সব নিয়ে মাথা ঘামাতে ভাল লাগে না।

-বুজি বাই বুজি, বইনের সংসার ঠিক রাখনের জইন্য পতিবাদ করতে পারেন না, এত কিসু সইয্য করেন।

-আটটা বেজে গেছে প্রায়। আপনি যেতে দেরী হলে আমি আগে ওয়াসরুমে যাই?

-আচ্ছা যান। তয় আমার কাচে স্বীকার না করলেও ভাইবা দেইখেন, আপনি এই খানে আসার ফরদিন থেইকে আজ ফইয্যন্ত আপনেরে কি খাটানিটাই না খাটাইতেচে। আপনের বেতইন থেইকে খানা খরচ কাটি রাখে, আর আপনে খান তো একটুক। তাও একবেলা খাইলে আরেক বেলা খাওনের ঠিক থাকে না। এখানে অখানে পাটাইতেই থাকে। এই খাটুনির পয়সা তো দেয় না। এই ফইয্যন্ত কত ভাবেই ঠকাইয়ে চইলছে।

-আমি যাই, দেরী হয়ে যাচ্ছে।

 

আরফান নামাজ পড়ে ঘড়ি দেখল, আটটা পঁচিশ মিনিট বেজেছে। আরো পঁয়ত্রিশ মিনিট দেরী আছে খাবার খেতে। ফখরুদ্দিন নিয়ম করেছে দুপুরের খাবার দুইটায় এবং রাতে নয়টায় সবাই খাবার খাবে। সকাল সারে ছয়টায় মুড়ি, বিস্কুট যে যা খাওয়ার খাবে, কিন্তু সকাল সাতটার সময় সবাই কাজে উপস্থিত থাকতে হবে। খাওয়া দাওয়া বিশ্রাম সব কিছু্রই সময় নির্দিষ্ট। সন্ধ্যার পর আরফানকে দুইবার বাইরে যেতে হয়েছে। এখন তার ক্ষুধা পেয়েছে কিন্তু খাওয়ার উপায় নেই। ফখরুদ্দিন যে শুধু বিরক্ত হবে তাই-ই নয়, ঠিক নয়টায়ও যদি খেতে আসে সেটা নিয়েও হাসাহাসি করবে। “কি আরফান ক্ষুধা কি বেশী লাগছে?” বা “একেবারে ঘড়ির কাটায় কাঁটায় এসে হাজির হয়েছ দেখছি” অথবা অন্যদের উদ্দেশ্য করে বলবে, “আর পাঁচ মিনিট খেতে দেরী হলে আরফান মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।” আর কোন কারণে যদি আধ ঘন্টা দেরী করে খেতে আসে, তখন সে আর খাবার পাবে না। এটাই নাকি নিয়ম। কিছুদিন আগে সে তার চাচা সালামের সাথে কোন একটা বিষয়ে আলোচনা করছিল। কথা বলতে বলতে সেদিন রাত প্রায় ১০টা বেজে গিয়েছিল। সে ইশার নামাজ পড়ে খেতে এসে দেখে তার জন্য কোন তরকারি নেই, তরকারির পাতিলে পানি। রুমমেটদের জিজ্ঞাসা করায় তারা একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকল। আবার জানতে চাইলে একজন জড়সড় হয়ে বলেছিল- “তরকারি তো ছিল, আপনি খেতে আসেন নাই দেখে ফখরুদ্দিন সাহেব স্যার পানি ঢেলে দিয়েছে। উনি হয়ত ভাবছিল কেউ আর খাওয়ার লোক নাই”। আরফান কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ এসে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল, কিন্তু ক্ষুধায় তার ঘুম আসেনি সে রাতে। পরদিন সকালে আবার না খেয়ে কাজে হাত লাগাতে হয়েছিল। কতটা তরকারী নেয় বা সকালে কয়টা বিস্কুট খায় সেটা লক্ষ্য করে এমন করে তাকিয়ে থাকে যে অন্যরাও লজ্জা পায়। সবার চোখে পড়া এসব ব্যাপারগুলো শুধু ঘটে আরফানের সাথে। ফখরুদ্দিন প্রথম থেকেই তার সাথে অন্যায় করে এসেছে, কিন্তু এই সংকীর্ণ আচরণগুলো শুরু করেছে তার ভাই নাশিদকে এখানে আনার পর।

আরফান ক্ষুধার্ত পেটে বাইরে এসে আবার আগের জায়গায় বসল। মনে মনে ভাবছে, আলমগিরের কথা গুলো। সে তো জানে না, আরফান কি ছেড়ে এসেছে, কিসের আশায় এসেছে, আর এখানে এসে কি দেখছে। তবু এখানে অনেকে একটু হলেও বুঝতে পারে যেটা ফখরুদ্দিন বুঝেও বুঝতে চায় না। যেন সে তাকে অধিনস্ত করে, ঠকিয়ে, কষ্ট দিয়ে একটা পৈশাচিক বিজয়ের আনন্দ অনুভব করে। অথচ তার আগের আচরণ ছিল সম্পূর্ণ অন্য রকম।

মনে পড়ছে সেই দিনের কথা- এক বিকেলে নাজরিন বাসায় এসে প্রস্তাব করল আরফানকে দুবাই আসার জন্য। আরফানের মা এবং আরফান শুনে সাথে সাথেই নিষেধ করে দেয়। এক সাপ্তাহ পর কল করে আবারও বলে নাজরিন, তখনো আলিয়া বেগম মানা করে বলেন, “না বাবা, আমাদের এত বড় লোক হবার দরকার নাই। যেমন আছি, আলহামদুলিল্লাহ ভালই আছি। রুমি জব করে বিশ হাজার টাকা পায়, টিউশনি করে আরো পাঁচ সাত হাজার পায়, যথেষ্ট। এখন বিদেশ গেলে ওর মাষ্টার্স পরিক্ষাটা দেয়া হবে না, এমনিতেই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে দুই বছর পিছিয়ে গেছে আগে । এছাড়া তোর আবুল কালাম আর আব্দুস সালাম চাচুরা মিলে কি একটা ব্যবসা করার কথা চলছে”। তার দুইদিন পরে ফখরুদ্দিন টেলিফোন করে কথা বলে। শাশুড়ি মানা করলে তখন অন্য লোক দিয়ে কল করিয়ে সুপারিস করিয়ে বলে, “ফখরুদ্দিন ভাই খুব ভাল মানুষ, এখানে এত বড় ফার্মটা চালাতে একা বেচারা হিমশিম খাচ্ছে দেখে আমরা সবাই বলি দেশ থেকে আপনার শালাকে আসতে বলেন। এখানে আপনার সাথে ব্যবসা সামলাবে। দেশে থেকে যা উপার্জন করছে তার থেকে এখানে দুই গুণ করবে। আপনারা ছেলেকে পাঠালে আপনাদেরও ভাল হবে সাথে আপনাদের মেয়ে মেয়েজামাইয়েরও ভাল হবে”। পরদিন নাজরিন এসে বেশ মন খারাপ করে মা বাবার সাথে। বলে, আপনারা নিজের ভালও বুঝেন না। সারজা গেলে ও নিজের দুলাভাইয়ের কাছে থাকবে, খাবে; যত্নে এবং সম্মানের সাথে থাকবে। বেতনও পাবে ত্রিশ হাজারের উপর। আর ওর নিজের বোনজামাইয়ের ফার্মে তো তাকে গায়ে খেটে কাজ করতে হবে না, কাজের জন্য বাইশ/ তেইশ জন লোক আছে। ও গেলে তো শুধু দেখাশুনা করবে। কাজ বুঝলে থাকলে পরে পার্টনার করে নেয়ার ইচ্চাও আছে”। আলিয়া বেগম আবার বললেন, “কিন্তু ওর পড়ালেখা তো বন্ধ হয়ে যাবে তাহলে। আর কয় মাস পর ছেলেটার ফাইনাল পরীক্ষা”। নাজরিন বিরক্ত হয়ে বলল, “মাস্টার্স সার্টিফিকেট পেয়ে কি করবে আরফান? আপনারা ওকে না বুঝিয়ে উল্টা নিজেরাই বাধা দিচ্ছেন। এই সুযোগ কি ও আর পাবে”? তারপর আরফান এলে তার সাথে রাগ করে কথা বলল। আরফান বলল “আমি পরীক্ষার আগে কোথাও যাব না।তাছাড়া আমি যে জব করি সেটাই আপাতত আমার জন্য যথেষ্ট। আমার এখন আর এর চেয়ে ভাল করার দরকার নাই। আমি যেমন আছি, ভালই আছি”। “তুই আমাকে এভাবে কথা বলছিস? শুন, তোর ফখরুদ্দিনভাই তোকে বলার আগেই তার ভাইকে যেতে বলেছিল, কিন্তু নাশিদ যেতে পারবে না বলেছে। বাহরাইনে তার কোম্পানি তাকে কন্ট্রাক শেষ হওয়ার আগে ছাড়বে না। এই জন্য তোকে এতবার বলার প্রয়োজন হয়েছে। সে তো আমাকে বলেছে, তোমার কেমন ভাই যে বোন, বোনের জামাইয়ের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ায় না? ঠিকই তো বলেছে, যে ভাই বোনের কথা ভাবে না, ভাগনে ভাগ্নীর ভবিষ্যতের জন্য পাশে দাঁড়াই না, সে কেমন ভাই”? শেষের কথা গুলো নাজরিন বলেছিল রাগি এবং কাঁন্না জড়ানো গলায়। তখন আরফান এবং তার বাবা সাহেদ হোসেন সিদ্ধান্ত নেন এবং পাসপোর্ট রেডি করেন। তারপর চব্বিশ দিন পর এক রাতে আরফান সারজাহ ইয়ারপোর্টে এসে পৌঁছায়। ফখরুদ্দিন তাকে রিসিভ করতে যায়। স্যুটকেইস হাতে আরফান বেড়িয়ে আসতেই তাকে জড়িয়ে ধরে ফখরুদ্দিন। অপেক্ষারত গাড়ি করে বাসায় এসে পৌঁছাতে একঘন্টারও বেশী সময় লাগল। রাত দুইটায় বাসায় এসে পৌঁছানোর পর তাকে একটি বিছানা দেখিয়ে বিশ্রাম নিতে বলে ফখরুদ্দিন চলে গেল নিজের কক্ষে। চার কক্ষের বাসাটার তিন কক্ষে চার পাঁচ জন করে মানুষ থাকে আর এক কক্ষে ফখরুদ্দিন একা। আরফান অপরিচিত ঘুমন্ত এক ব্যক্তির পাশের বিছানায় বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর অদ্ভুত বিভ্রান্ত এক অনুভূতি নিয়ে শুয়ে পড়ল। পরদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখে শূন্য বাসা। সে উঁচু গলায় বলল “কেউ আছেন”? কোন সারা পেল না। উঠে অন্যান্য কক্ষে উঁকি দিল। একটা কামরা মোটামুটি পরিষ্কার পরিপাটী, অন্য কামরায় বিছানা পত্র সব এলোমেলো। পাশেই আরেকটা কামরা, দরজা টেনে দেয়া, তবে বন্ধ নয়। সে মনে দ্বিধা নিয়ে হালকা হাতে দরজা ঠেলে ভেতরে চোখ রাখতেই অবাক। মেঝেতে গালিচার উপর জায়নামাজ পাতা। জায়নামাজের এক পাশে কুরআন মাজিদ এবং দুইটা বই রাখা, অন্য পাশের দেয়াল জুড়ে একটা বাঁধানো বড় ছবি ফুলের মালা দিয়ে সাজানো আর নীচে লোবানদানী, কয়েকটা কাগজের ছোট বাক্স এবং একটা দেশলাই দেখা গেল। কাল সন্ধ্যায় বাসা থেকে ইয়ারপোর্টর উদ্দেশে বেড় হওয়ার আগে সে নামজ পড়েছে। ফজরের নামাজ পড়তে হবে এখন। কিন্তু এখানে তো ছবি রাখা। সে ফিরে এল নিজের বিছানায়। স্যুটকেস থেকে কাপড় বের করতে গিয়ে লক্ষ্য করল সে খুব ক্ষুধার্ত। কাল সন্ধ্যায় মা জোর করে একটু খাইয়ে দিয়েছিল। প্লেনে সে একটু অরেঞ্জ জুস ছাড়া আর কিছু খায়নি। রান্না ঘরে গিয়ে দেখল তার জন্য খাবার রাখা আছে কিনা। কিছুই পেল না। জিনিস পত্র সব এলোমেলো, চুলার চার পাশে কত কি। দেখে মনে হয় কখনো পরিষ্কার করেনি। চুলার পাশের তাকে মসলার কৌটার পাশে একটা প্ল্যাস্টিকের বয়ামে মুড়ি রাখা আছে, খেতে ইচ্ছা করল না। সে পানি খুঁজল, কোথাও ফিল্টার বা পান করার মত পানি পেল না। তিনটা মগ পরে আছে, একটা মগ ধুয়ে সিঙ্কের কল থেকে পানি পান করল সে। আরফান সারজাহতে এসে পৌঁছেছে দশ ঘন্টা হয়েছে, এর মধ্যে দেখা এবং কথা হয়েছে শুধু ফখরুদ্দিনের সাথে, আর কারও সাথে দেখা হয়নি। এখনও এখানকার আশ-পাশ, পরিবেশ কিছুই দেখেনি সে, এমন কি একটা গাছও নয়। সে হাত মুখ ধুয়ে কাপড় বদলে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসল। প্রায় বিশ গজ দূরে এসে দেখতে পেল বাসার ডান পাশে কিছু দূরে ফখরুদ্দিন একটা চেয়ারে বসে আছে। তার আশে পাশে দশ বার জন মানুষ কাজ করছে। আরফান সেদিকে এগিয়ে গেলে ফখরুদ্দিন বলল, ”কি ব্যাপার এত তাড়াতাড়ি উঠে গেছ যে? আচ্ছা, উঠেই গেছ যখন, তোমার আম্মার সাথে কথা বল। তোমার আম্মার অস্থিরতা দেখে মনে হয়, উনি ওনার কোলের ছোট অবুঝ শিশুকে দূর দেশে শত্রুর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এই পর্যন্ত দেশ থেকে কয়েক বার কল এসেছে তোমার খোঁজে। এই নাও মোবাইল, কল কর”।

–এমন অদ্ভুত সম্বর্ধনা দিয়ে শুরু হয়েছিল তার পরবাস কালের এই জীবনটা। মা বাবা ভাই বোনের সাথে কথা শেষ করে সে নিজ থেকে এখানকার সবার সাথে পরিচিত হয়ে নিল। তারপর সেইদিনই সবার সাথে কাজে মিশে গেল তাদের একজন হয়ে।

মাস শেষের আট দিনের হিসেব বাদ দিয়ে পরের মাসের শুরু থেকে হিসেব হল আরফানের বেতন পাওয়ার। প্রথমে চার মাস ষোল হাজার টাকা করে দেয়া হল তাকে, তারপর বিশ হাজার টাকা করে পাচ্ছে এখনও। জানতে পেরে নাজরিন জিজ্ঞাসা করলে ফখরুদ্দিন জানায়, বেতন পঁচিশ হাজার করেই দিচ্ছে, থাকা খাওয়ার জন্য পাঁচ হাজার টাকা করে কেটে রাখা হচ্ছে। অথচ দেশে চাকরী এবং টিউশনি করে তার উপার্জন আরও ভাল ছিল এবং পাশাপাশি তার পড়াশোনাটাও চলছিল। প্রথমে খারাপ লাগলেও ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিল সে। কিন্তু মনে মনে মানতে পারল না, যখন জানল, দেশে জমি কেনার সময় ফখরুদ্দিন তার শশুড় সাহেদ হোসেন থেকে যে পাঁচ লক্ষ টাকা ধার নিয়েছিল সেই টাকা থেকে তার এখানে আসার ভিসা এবং প্লেন ভাড়াসহ অন্যান্য খচর বাবদ সাড়ে তিন লক্ষ টাকা কেটে রেখেছে। বলেছে, দেশে গেলে বাকী দেড় লাখ টাকা পরিশোধ করে দেবে। এখানে আসার আগে তাদের যা যা কথা বলা হয়েছিল, আসার পরে সেই কথাগুলোর কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি, উলটা তার বাবাকে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা গচ্চা দিতে হল।

অন্যান্য এমপ্লয়িদের সাথে এবং তাদের মতই সে কাজ করে। তবু এক্সট্রা ভারী কাজগুলো ফখরুদ্দিন আরফানকে দিয়ে করায়। দুপুরে বা সন্ধ্যায় অবসরে তাকেই দোকানে বা যে কোন কাজে বাইরে পাঠায়। পান সুপারি এবং সিগারেট এর মত নিষিদ্ধ জিনিসগুলি তাকেই কিনে আনতে হয়। একটা সামান্য কার্ড থেকে শুরু করে অন্যান্য বড় ঝামেলার কাজগুলি সব সময় তার কাঁধে তুলে দেয়া হয়। আরফান তার বোন জামাইয়ের পীরের ছবি টাঙ্গানো কামরায় নামাজ পড়তে হয়। অন্য কামরায় নামাজ পড়লে রাগ করে। তারপর ছবিটা ঢেকে সে নামাজ পড়েছিল। একদিন তা দেখতে ফখরুদ্দিন রাগ করেছিল। সে বলেছে, নামজ কুরআন যাই পড়া হোক না হোক, প্রতিদিন স্বন্ধ্যায় ছবির নীচে আগর বাতি যেন জ্বলানো হয়। সে এই কাজগুলো করে না বলে তার ঈমান ঠিক নেই। আরফান আসার পাঁচ মাস পর ফখরুদ্দিনের ভাই নাশিদ আসে। তারপর থেকে দুই ভাইয়ের কর্তৃত্ব এবং দুর্ব্যবহার দিন দিন বেড়েছে। আরফান বুঝতে পারে, তার পড়াশুনা চাকরী সব ছাড়িয়ে তাকে জোর করে আনা হয়েছে নাশিদ আগে আসেনি বলে। এখন সে এসে গেছে বলে ফখরুদ্দিন তাকে অপ্রয়োজনীয় ভাবছে। এখন চাইছে ও নিজ থেকে চলে যাক, যেন পরে এই নিয়ে তাকে দোষ দিয়ে নাজরিনকে কথা বলতে পারে।

 

আরফান ঘড়ি দেখল, রাত নয়টা বেজে গেছে, কিন্তু তার ঘরে যেতে ইচ্ছা করছে না। সবাই নিশ্চয় এখন খেতে বসেছে! সবাই খেয়ে আরও এক দেড় ঘন্টা গল্প করবে, টিভি দেখবে, তারপর যে যার মত ঘুমিয়ে পড়বে। কেউ তাকে ডাকবে না, সেও কাউকে কিছু বলতে যাবে না। পাশের বাংলোর কেয়ার টেকার থেকে আধলিটার করে রোজ দুধ নেয় সে। সেটা যদি পাতিলে থাকে তাহলে হয়ত ঘুমানোর আগে একটু দুধ খাবে। না থাকলে কাউকে জিজ্ঞেসও করতে যাবে না তার কেনা দুধটুকু নেই কেন। মাঝে মাঝে সে আপেল কিনে আনে, আজ আপেলও নাই। এখানের অন্যান্য এমপ্লয়রা আরফানকে পছন্দ করে, সেও তাদের সাথে যথেষ্ট ভদ্র ব্যবহার করে, এটা ফখরুদ্দিন বা নাশিদ পছন্দ করে না। এই নিয়ে আজ সন্ধায় তাকে অপমান করেছে। হয়ত এই কারণেই তার খেতে যেতে ইচ্ছে করছে না। সে ক্ষুধা নিয়ে বসে আছে। ভাবছে, যত দিন যাচ্ছে এখানে থাকা ততই কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিল, এখন রাত যথেষ্ট গভীর হয়ে গেছে, একখন কল করে যাবার কথা বললে বাবা মা চিন্তায় ঘুমাতেই পারবেন না সারা রাত। সকালেই মা বাবার সাথে কথা বলবে সে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যাবে এখান থেকে।

হঠাৎ হাতের মোবাইলটা কেঁপে উঠল। বার্তা এসেছে। মা লিখেছে- “রুমি, কেমন আছিস? কি করিস? তোর মন খারাপ? তুই মন খুলে আমার সাথে কথা বল। তুই না হয় চলে আয়। আমারও ভাল লাগে না।” তিনি বিকেল তিনটায় কল দিয়েছিলেন। তখন আরফান কাজে ছিল বলে খেয়াল করেনি। এখন মোবাইলে আসা বার্তাগুলি পড়তে গিয়ে দেখল ম এখন তাকে বার্তা পাঠাবার, আগে বিকেলে কয়েক বার কল করেছিলেন। তাকে বার মিনিটে চার বার কল করেছেন, প্রাত্যেকটা কল তিন মিনিটের ব্যবধানে করেছেন। তারপর সারাটা বিকাল-সন্ধ্যা অপেক্ষা করে এখন এই বার্তা দিলেন।

যে সব কারণে সে নিজের পড়াশোনা, নিজের চাকরি ছেড়ে পরিবার ছেড়ে এসেছে, সেই সব থেকে সে বঞ্চিতই শুধু হয়নি বরং তাকে অমর্যাদা অবহেলা করে এবং অন্যান্য ভাবে কষ্ট দেয়া হচ্ছে। আরফানের চোখ আবার ভিজে উঠল,কিন্তু সে এবার চোখ মুছে নিজেকে সংবরণ করল। তার চোখের অশ্রু ফোটা গুলো রাতের ঠাণ্ডা বাতাসের ছোঁয়ায় শীতল হয়ে উঠল। তার হঠাৎ মনে পড়ল, সালাম চাচু সেইদিন বলেছিলেন, “আমাদের দুঃখ কষ্টে ঝরা চোখের নোনা পানি মিষ্টি শীতল হয়ে উঠতে পারে যদি আমরা এই অশ্রু দিয়ে আমাদের রবের কাছে প্রার্থনার দরখাস্ত লিখতে পারি।” কি অসাধারণ কথা”!!! আরফান চোখ মুছল। না, সে আর কখনো কাঁদবে না। এখন সব কান্না, সব কষ্ট জমা থাক তার চোখে এবং মনে। গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে যাবে তখন সে তার এই কেঁদে না ঝরানো জমা অশ্রু জলে তার রবের কাছে দরখাস্ত লিখবে। না কারো নামে নালিশ পত্র সে লিখবে না, সে শুধু তার অবস্থার পরিবর্তন চাইবে। সালাম চাচু এমনটাই করার কথা বলেছিলেন।

আরফান সামনের খালি জায়গায় বাম পাশের গাছটার দিকে চেয়ারটা টেনে নিয়ে এসে বসল সেখানে। মোবাইলে হোয়াটস’অ্যাপে দেখল মেসেজ এসেছে। গত সাপ্তাহে কৌশলে একটা মিথ্যা বলেছিল দুষ্টামি করে, পরে আব্দুস সালাম তা জানতে পেরে বললেন, এমনটা করা উচিৎ নয়। সে তর্ক করেছিল, দুষ্টামি করে মিথ্যা বলা যায়, কারণ এতে কারো ক্ষতি হচ্ছে না। আব্দুস সালাম চাচু তার ব্যস্ততার মধ্যেই তাকে বুঝিয়েছিলেন, সে বুঝতে চায়নি। যুক্তি দেখিয়ে বারবার তাকে আটকাতে চেয়েছিল তাকে। কারণ সে কোন এক ওয়াজে শুনেছিল, কৌতুক করে মিথ্যা বলা যায়, রাসুল (সঃ)ও এমনটা করেছেন। একথা শুনেই কিছুটা রেগে গিয়েছিলেন আব্দুস সালাম। বলেছিলেন, সেই কৌতুকগুলো কক্ষনো মিথ্যা ছিল না, বরং মজা করা সত্য ছিল। রাসুল (সঃ) কখনো মজা করে, কৌতুক করেও মিথ্যা বলেননি। তখন ওনার সময় না থাকায় বলেছিলেন পরে এই বিষয়ে বলবেন। তিনি সেটাই ভয়েজে পাঠিয়েছেন। নীচে লিখে দিয়েছেন “ইসলামে কৌতুক করা মিথ্যার বিধান”। মনে মনে সে খুশি হল যে সালাম চাচু উত্তরটা ভয়েজে দিয়েছেন। কল করতে বললে ঠিক এখনি কথা বলা তার জন্য অস্বস্তিকর বিষয় হত।

“আসসালামুয়ালাইকুম আরফান। কেমন আছ? আচ্ছা সেদিন কৌতুক করে মিথ্যা বলা ইসলাম অনুমোদন করে কিনা এই বিষয়ে কথা হচ্ছিল। তুমি বলছিলে, ইয়ার্কি করে, বা হাসানোর উদ্দেশে, বা মজা করে কাউকে ভয় লাগানোর উদ্দেশে মিথ্যা বলা যায়, ইসলামে নিষেধ নাই বলে তুমি জান, এবং তোমার যুক্তিতেও বলে সেটা দোষের হবে কেন? কিন্তু দেখ, মিথ্যা বলা কবিরা গুনাহ এটা আমরা সবাই জানি। মিথ্যা তো মিথ্যাই, হোক তা হাসি ঠাট্টার ছলে, অথবা গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়ে। তুমি ভেবে দেখ মিথ্যার মাধ্যমে কি করে আনন্দ লাভ হতে পারে ক্ষতি না হয়ে? ক্ষতিটা হয়ত বড় ক্ষতি নয়, আবার হতেও পারে বড় কিছু। ক্ষতি হতেও পারে তোমার অজান্তে। মিথ্যা বলে কাউকে ভয় লাগিয়ে তুমি মজা পেতে পার, কিন্তু যে ভয় পাবে তার মনের সেই অবস্থাটা কেমন হয় ভেবে দেখ। ভয়ের কোন কিছু, হয়ত লজ্জার কিছু, এতে তার মনটা খারাপ হবে যাতে সে পরে ভীতরে ভীতরে কষ্ট পেতে থাকবে। রাসুল (সঃ) কখনোই মজা করেও মিথ্যা বলেননি। যদি জীবনে দুই একবার উনি হাসি মজা করেছেন, তাও ওনার হাসি কৌতুক ছিল একান্ত নির্মল এবং সত্যনির্ভর। এ বিষয়ে প্রসিদ্ধ একটা হাদিস আছে। সেটা এরকম,- একবার এক বৃদ্ধ মহিলা রাসুল (সঃ) এর কাছে এসে বলল, আপনি আমার জন্য দুয়া করুন যাতে আমি জান্নাতে যেতে পারি। তখন রাসুল (সঃ) মুচকি একটু হেসে বললেন, কোন বৃদ্ধা তো জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। একথা শুনে বৃদ্ধা কাদঁতে শুরু করল। তখন রাসুল (সঃ) হেসে তাকে বললেন, কোন বৃদ্ধা মহিলা বৃদ্ধাবস্থায় জান্নাতে যাবে না বরং আল্লাহ তাদের যৌবনে ফিরিয়ে নেবেন, তারা কুমারী হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারপর তিনি সেই মহিলাকে কুরআনের আয়াত পড়ে শুনান। “অতপর আমি তাদেরকে বানাব কুমারী এবং সোহাগিনী ও সমবয়সী”। তখন বৃদ্ধা মহিলা খুব খুশী হয়ে ফিরে যায়। দেখো, রাসুল (সঃ) সত্যই বলেছেন, শুধু বলার ধরণে বৃদ্ধা বিভ্রান্ত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু পরে সে এমন আনন্দ নিয়ে ফিরে গেল যে সেটা এত শত বছর পরে জেনে আমাদেরও মন ভাল হয়ে যায়, সুবহান আল্লাহ! হাদিসে বর্ণিত মজা কৌতুকগুলো পর্যন্ত কত অপুর্ব সুন্দর!

আর আবুদাউদের একটা হাদিস আসছে, যেখানে বলা হয়েছে। “ঐ ব্যক্তির জন্য কঠিন শাস্তি, কঠিন শাস্ত, এবং কঠিন শাস্তি, যে লোক হাসাতে মিথ্যা বলে”। আরেকটা হাদিস আসছে যে মিথ্যা বলে না অর্থাৎ সত্য বলে এবং ঝগড়া তর্ক ছেড়ে দেয় তার জন্য জান্নাত। রাসুল (সঃ) বলেন, “আমি ঐ ব্যক্তির জান্নাতের কোন একটি ঘরের জামিন হব যে সঠিক হওয়ার পরেও বিপক্ষ কারো সাথে তর্ক ছেড়ে দেয়। এবং ঐ ব্যক্তির জন্যেও হব যে ঠাট্টার ছলেও মিথ্যা বলে না”।

এছাড়া পবিত্র কুরআনেও অনেক বার মিথ্যা সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে। অনেক গুলো হাদিস বর্ণিত হয়েছে। সহি বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সঃ) বলেছেন, আমি কি তোমাদের সব চেয়ে বড় গুনাহ সম্পর্কে জানাব না? তখন সাহাবীরা বললেন, অবশ্যই ইয়া রাসুলাল্লাহ। তখন রাসুল (সঃ) বলেন, আল্লাহর সাথে শরিক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, এবং মিথ্যা কথা বলা। হাদিসে এসেছে ,এই কথাগুলোর রাসুল (সঃ) কয়েকবার বলেছিলেন। এই কথাগুলোর গুরুত্ব কত বেশী ভেবে দেখ।

এবার তুমিই বল, মিথ্যা কি করে ভাল হতে পারে? মিথ্যাবাদী মজা করে আনন্দ পেতে পারে কিন্তু এর ফল কখনো ভাল হয় না। জানি না তোমাকে আমি ঠিক ভাবে বোঝাতে পারলাম কিনা।

আর তুমি প্রশ্ন করেছিলে, মাকে খুশী করতে মিথ্যা বলা যায়, এটা তো সত্যি, তাই না? আবার বললে, ইসলামে আছে কয়েকটা ক্ষেত্রেই মিথ্যা বলা যায়, তুমি সিউর, ভাল কোন এক হুজুর থেকে তুমি শুনেছ, আমিই হয়ত জানি না। তোমার কথার উত্তরে বলছি,- হ্যাঁ এটা ঠিক, আমার জানার সীমাবদ্ধতা আছে, অনেক কিছুই আমি জানি না। কিন্তু চেষ্টা করি না জেনে তর্ক না করতে এবং ধারণা করে কথা না বলতে। এবার বলছি ইসলামে অনুমোদিত সেই মিথ্যা সম্পর্কে।

একটা হাদিস জানি, যেটা উম্মে কুলসুম রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন যে,  রাসুল (সঃ)কে মানুষের কথাবার্তায় মিথ্যা বলার অনুমতি দিতে শুনিনি, তিন ক্ষেত্র ছাড়া। এক, যুদ্ধকালে, দুই, ভাইদের ঝগড়া মিটাবার ক্ষেত্রে এবং তিন, স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের কথাবার্তায়। মুসলিম গ্রন্থে এটা বর্ণিত হয়েছে।

তোমার বুঝার জন্যে আমি একটু ব্যাখ্যা করছি, এক- যুদ্ধ কালে মিথ্যা, যেমন হতে পারে শত্রু পক্ষকে সঠিক তথ্য না দেয়া। দুই, ভাইদের মাঝে ঝগড়া বিবাদ মিটিয়ে দিতে মিথ্যা। যেমন, ধরো দুই ভাই, আপন ভাই তো বটেই, হতে পারে রক্তের সম্পর্কিত নয়, কারণ ইসলামে মুসলিমদের ঈমানের একটা শর্ত হচ্ছে তার চেনা জানা অন্য মুসলিমকে সে আপন ভাইয়ের মর্যাদা দেবে। হতে পারে প্রতিবেশী ভাই বা বোনদের ক্ষেত্রেও হতে পারে। শুধুই রক্তের সম্পর্ক হতে হবে এটা শর্ত নয়। আর রক্তের সম্পর্ক তো ছিন্ন করা যাবেই না, সেটা সরাসরি নিষেধ আছে, সেটা কবিরা গুনাহ। তো যা বলছিলাম, দ্বীন রক্ষার বিষয় ছাড়া রক্ত সম্পর্ক তো ছিন্ন করা যাবেই না, আর তারপরেও যদি আপন বা সাধারণ মুসলিম ভাইদের মাঝে যদি মনমালিন্য হয়, অথবা কোন কারণে একে অপররের প্রতি শত্রু মনোভাব পোষণ করে তখন তৃতীয় জন দুজনকে মিলিয়ে দেয়ার জন্য মিথ্যা বলতে পারে। তাও বুঝে শুনে মিথ্যা হতে হবে, যেমন এক জনকে বলতে পারে, তোমার সম্পর্কে ঐ ভাই তো এমন ভাল ভাল কথা বলে, আসলে সে বলেনি, অথবা বলতে পারে, তোমার ঐ ভাই তোমার জন্য ক্ষতি করা থেকে বিরিত থেকেছে, বা তোমার জন্য দুয়া করে। যেহেতু সব মুসলিম অন্য সকল মুসলিমের জন্য দুয়া করে। তাহলে আবার অপর জনকেও গিয়ে বলল, যে তোমার ঐ ভাই তো তোমার সম্পর্কে ভাল ধারণা রাখে, বা বলতে পারে সে তো তোমার সাথে ভাল সম্পর্ক আশা করে তাহলে কেন সম্পর্ক খারাপ করে রাখছ। তুমিই মহত্ব দেখিয়ে তার সাথে ভাল ব্যবহারে আগে এগিয়ে যাও। তবে সেই মিথ্যায় কোন গুরুত্বপূর্ণ মিথ্যা থাকবে না। এখন কেউ যদি বলে, অমুকের ভুলে তোমার এই ক্ষতি হয়েছে বলে সে তোমার ক্ষতি পূর্ণ করে দেবে বলেছে এমন কথা নিজ থেকে বলা যাবে না, বলতে হবে, সে তো বুঝতে পারে নি, সে তার কর্মে অনুতপ্ত, তাকে আরেকটা সুযোগ দিয়ে ক্ষমা করে দাও। এই ধরণের মিথ্যা বলে তাদের কাছাকাছি আনা। আর তিন, স্বামী স্ত্রী একে অন্যকে খুশি করার জন্য ছোট মিথ্যা বলতে পারে। যেমন, রান্না ভাল না হলেও স্বামী বলল ভাল রান্না হইছে। অথবা স্বামীর কেনা কোন কিছু স্ত্রীর পছন্দ হল না, তবু স্বামীকে খুশি করতে স্ত্রী বলল, খুব সুন্দর, আমার পছন্দ হয়েছে। কোন কোন স্ত্রী আছে যারা শোকর গুজারি নয়, তাদের সহজে খুশি করা যায় না, এমন স্ত্রীকে স্বামী কিছু কিনে দাম বাড়িয়ে বলতে পারে। তবে এগুলোকে অভ্যাস বানিয়ে নেয়া যাবে না। আর একটা হাদিস আসছে, স্ত্রীর প্রতি যতটুকু মায়া মনে থাকে তার থেকে বেশি বাড়িয়ে বলা যাবে, সেমন কেউ বলল, তোমাকে আমি প্রাণের থেকে বেশী ভালবাসি। অথবা বলল, আমার কাছে তুমি পৃথিবীর সব থেকে বেশী সুন্দরী। আসলে বাস্তবতা তা নয়। সুবহান আল্লাহ ! ভেবে দেখ, ইসলামে অনুমদিত মিথ্যার সীমানা যেটুকু সেটাও স্পষ্ট এবং কত গভীর কল্যাণকর।

আশা করছি, ব্যাপারটা তোমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। দ্বীনের বিষয়গুলো ভাল করে বুঝার চেষ্টা করবে, নিজের ধারণা বা কি শুনেছ সেটা গুলিয়ে ফেল না। কারণ এটা জীবনের চলার পথ, জীবন পরিচালনার বিধান।

আর তোমাকে সেদিন রামজানের আমল সম্পর্কে বলেছিলাম। সেগুলো অনুসরণ করবে, আমল করবে। আল্লাহ আমাদের ভুল ত্রুটি ক্ষমা করুন, আমীন। আর কোন প্রশ্ন থাকলে মেসেজ দিও, আমি সময় করে উত্তর দিব ইন শা আল্লাহ। এই কিছুদিন ব্যস্ত থাকব। কথা বলতে পারব না। আল্লাহ হাফিজ।”

আরফান দীর্ঘ রেকর্ড বার্তাটি দুই বার শুনল। একটু লজ্জা লাগছে তার, না জেনে কত তর্ক করছিল সেদিন। সে লিখল,

“চাচু, ওয়ালাইকুমুসসালাম। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি আপনার কাছে অনেক ঋণী। আপনার মূল্যবান সময় দিয়ে আমাকে শেখাচ্ছেন বলে। হ্যাঁ সেদিন রামজানের জন্য যে আমলগুলো গুরুত্বপূর্ণ বলেছেন, সেগুলোর কথা মনে আছে। ইন শা আল্লাহ, আমি কাজের ফাঁকে সময় বের করে কুরআন তিলাওয়াত এবং সকাল স্বন্ধ্যায় দুয়াগুলো আমল করব। আর বলেছেন, বেশী বেশী ইস্তেগফার করতে, ইন শা আল্লাহ করব। আপনি আমার জন্য দুয়া করবেন। আসসালামুয়ালাইকুম।”

আব্দুসসালাম আরফানকে নিজের ছেলে ভাবেন। বলেন, তার দুনিয়া আখিরাতে ভাল চান। দুই এক সময় বকাও দেন। সেই সব বকা আরফানের ভুল শোধরানোর জন্য হলেও মাঝে মাঝে তার মনে হয়, আব্দুসসালাম তাকে ভুল বুঝে রাগ করেছেন, তার তেমন ভুল হয়নি। কিন্তু তিনি বলেন, তিনি সঠিক বুঝেছেন। সময় অভিজ্ঞতা এবং বয়সের তারতম্যের কারণে সে এখন বুঝতে পারছে না, যেটা আব্দুস সালাম বুঝতে পারেন তার অভিজ্ঞতা দিয়ে।

আরফান নিজের চাকরী, পড়া, টিউশন, বাবা, মা, ভাই, বোন এবং নিজের দেশ ছেড়ে এসেছে বোনজামাইয়ের কথায় নিজের পরিবার এবং বোনের পরিবারের ভাল হবে, উন্নয়ন হবে এই ভরসা পেয়ে। কিন্তু এখানে এসে সব উল্টা হলেও এই কয়েক মাসের প্রবাস জীবনে দুইটা দিক ভাল হয়েছে তার। এক, অজানা পরিবেষ পরিস্থিতিতে নতুন কাজের অভিজ্ঞতা, চেনা মানুষ অচেনা হওয়ার অভিজ্ঞতা, বাবা মায়ের স্নেহ ভালবাসাহীন প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা। আর অন্যটি হল তার সালাম চাচুর সাথে যোগাযোগটা আরো দৃঢ় হওয়া। সে তার কষ্টের কিছু কথা আব্দুস সালামকে জানিয়েছে। তিনি দূরে থেকেই তাকে অনেক ভাবে গাইডও করেছেন। আব্দুসসালাম সম্পর্কে আরফানের বাবার চাচাত ভাই। মালয়েশিয়া থাকেন, নিজের ছোট্ট একটা কফি সপ আছে ওনার। তিনি সেটা একাই চালান বলে খুব ব্যস্ত থাকেন। এত ব্যস্ততার মাঝে তিনি আরফানকে প্রচুর সময় দিয়েছেন। বলেছেন, সামনে পড়া লেখা বা প্রয়োজনীয় কোন কথা ছাড়া উনি কথা বলতে পারবেন না। এতে তার মন অনেকখানি খারাপ হয়েছে। তবু সে খুশি, কারণ আব্দুসসালাম থেকে সে না চাইতেই অনেক কিছু পেয়েছে, অনেক কিছু শিখেছে। তার বদৌলতে ইসলামের মূল ধারাণা এবং জীবনের সঠিক আলোর সন্ধান সে পেয়েছে। কুরআন এবং হাদিসের কাছাকাছি আসার সৌভাগ্য হয়েছে তার, আলহামদুলিল্লাহ। তা না হলে শুধু পাঁচ বেলা নামজ পড়েই নিজেকে সৎ ধার্মিক মনে করা সে হয়ত ফখরুদ্দিনের এমন বিভ্রান্ত ধর্ম পালনের দিকেই ঝুকে পড়ত। এমন হলে কি ভয়ঙ্কর অন্ধকারে ডুবে যেত সে। এই চিন্তাটা মাথায় আসার সাথে সাথে তার অন্তরটা কেঁপে উঠল। নিজেই আবার আশ্বস্ত হয়ে ভাবল,- আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ তাকে রহম করেছেন, আলোর সন্ধান দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ।

একটা ভাল লাগা ভাব তাকে আচ্ছন্ন করে নিল। সে আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,

“আল্লাহ আপনি কত মহিমাময়, কত উদার, দয়াময় আপনি। আমি বসবাস করছি এমন এক পরিশেষে, এমন এক বিভ্রান্ত মানুষের অধিনে, যার প্রভাবে এই ধর্ম জ্ঞানহীন আমি আরো বেশী অজ্ঞতার অতলে ডুবে যেতাম আর আপনি আমাকে আরেক দুর পরদেশ বাসী একজনের মাধ্যমে আলোর পথ দেখিয়েছেন। আপনি কোন কোন মানুষকে কত ভাল মনের করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন আর কোন কোন মানুষকে তার বিপরীত। আসীম দয়ালু আপনি আমাকে অনেক বড় দয়া করেছেন আপনার নির্দেশিত পথের আলোর সন্ধান দিয়ে”।

আরফান তার পেছনে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে আকাশের পানে তাকাল। কি সুন্দর স্বচ্ছ আকাশ। রাতের অন্ধকারও কত সুন্দর হয়ে যায় যখন চাঁদ তার জ্যোৎস্না ছড়িয়ে দেয়। ছায়া ছায়া আকাশে অসংখ্য ছোট ছোট তারার মাঝে এক ফালি চাঁদ জ্বল জ্বল করে ঝুলে আছে একটা বৈদ্যুতিক বাতির মতো। আরফান মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল সেই দিকে অনেকক্ষণ। একটু যেন চোখ ধরে এলো তার। চোখ বন্ধ করল সে।

 

লেখকঃ সাহিত্যিক ও প্রবাসী বনাগ্লাদেশি, ইউএসএ

আরও পড়ুন