Ads

হেরটা মুলারঃ তৃতীয় পর্ব- গোপন পুলিশ সিক্যুরিটাটে

জুম্মি নাহদিয়া

রোমানিয়ান রাজা প্রথম মিখায়েল  তার দেশের বেশ কয়েকটা বামপন্থী রাজনৈতিক দলকে সাথে নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি সমর্থক এবং স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী মার্শাল আইওন আন্তোনেস্কুর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান পরিচালনা করেন এবং সফল হন।প্রথম মিখায়েলই মূলত রোমানিয়াকে নাৎসি জার্মানির বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দেয়।

আন্তোনেস্কুকে এরপর যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। রোমানিয়ায় সিক্যুরিটাটের কার্যক্রম কিন্তু রাজতন্ত্রেও ছিল তবে ভিন্ন নামে, “সিগুরান্তা স্তাতুলুই” ছিল তৎকালীন সিক্রেট পুলিশ এজেন্সি, আর সে সময় এই সিগুরান্তা স্তাতুলুইতে কমিউনিস্ট আমলের মতন এতটা রাহুর গ্রাসও ছিলনা।

সোভিয়েত NKVD (People’s Commissariat for Internal Affairs) এর পৃষ্ঠপোষকতায় এরপর রোমানিয়া যখন ১৯৪৮ সালে রেড আর্মি অকুপেশনের আওতায় এলো সেই তখন থেকে শুরু করে চশেস্কু পতনের অনেকগুলো বছর পরেও সিক্যুরিটাটের কার্যক্রম অব্যাহত ছিল।

সিক্যুরিটাটের প্রাথমিক উদ্দেশ্য যদিও ছিল দেশের অভ্যন্তরীণ এবং বহিঃশত্রুর মোকাবেলা করা কিন্তু সোভিয়েত প্রভাব রোমানিয়ায় ছেয়ে গেলে সেটা পরিণত হল বিশ্বের অন্যতম অশুভ গোপন পুলিশবাহিনীতে, রোমানিয়ার সাধারণ মানুষের জন্য ভয়াবহ অভিশাপেও। চশেস্কু আমলে সিক্যুরিটাটে ছিল প্রচণ্ড রকমের বর্বর এক আইন শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা রক্ষাবাহিনীর নাম যাদের মূল কাজ ছিল দমন পীড়ন। বিপুল সংখ্যক সদস্য দ্বারা গঠিত এই বাহিনীর বিশাল কর্মযজ্ঞের অপ্রকাশিত তালিকায় আছে হাজারো মানুষের ওপর গ্রেফতার পরবর্তী নির্যাতনে মৃত্যু।

এদের নিয়মিত কার্যক্রমের একটি ছিল গুম। তুলে নিয়ে গুম করে ফেলা ছিল তাদের রাষ্ট্রীয় এখতিয়ার। যে ব্যক্তিকে গুম করা হত তার পরিবারের কোন সদস্য যদি সিক্যুরিটাটের কাছে খোঁজ পাবার আশায় যেত তাহলে সে বেচারাই তাদের পরবর্তী শিকারে পরিণত হত। চশেস্কুর টোটালেটেরিয়ান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভিন্ন মতের কোন অবকাশই ছিল না। ভিন্ন মত, বিদ্রোহ, সমালোচনা দমাতে চশেস্কু স্রোতের মত গুপ্তচর নিয়োগের আদেশ দিল।

মোট জনসংখ্যা বনাম সিক্যুরিটাটে সদস্যের অনুপাত ছিল ৪৩:১। এমন একটা গুমোট পরিস্থিতি সৃষ্টি হল যে মানুষ কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাসে বেঁচে থাকার জন্য পুরো জাতির সাথে বেঈমানির করে হলেও গুপ্তচরের খাতায় নাম লেখাতে বাধ্য ছিল।

অফিস আদালত, কফিশপ- হাট- বাজার, নাপিতখানা- কসাইখানা কিংবা পারিবারিক বৈকালিক আড্ডা- চায়ের কাপ সব জায়গাতেই অদ্ভুতভাবে বিরাজমান ছিল লুকোনো গুপ্তচরেরা।সিক্যুরিটাটের সদস্যদের সাথে সরাসরি কোন যোগাযোগ করা যেত না। তারা কেবলই ছিল মহান চশেস্কুর অনুগত সেবক। কল- কারখানা, রাস্তার অলি গলি, ঘরের কোণ কোন কিছুই নিরাপদ নিশ্চিন্ত ছিল না তাদের থেকে।

পাবলিক প্লেসে বসে বন্ধুরা মিলে দেশ জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে যে দুটো নৈরাশ্যের কথা বলবে সেটারও কোন অবস্থা নেই, সভা সমাবেশ- ডেমন্সট্রেশন তো বহু দূরে! মানুষের বসত বাড়ির দেয়াল থেকে সন্তর্পণে ইট তুলে নিয়ে গোপন ক্যামেরা বসিয়ে দিত সেখানে। টেলিফোন তো ট্র্যাক করতোই। পাড়া পরশী, বন্ধু, পিতা মাতা সন্তানের ভেতর স্বাভাবিক বিশ্বাসের জায়গাটা নষ্ট হচ্ছিল দিন দিন। কোন না কোন ভাবে কারো না কারো প্রবঞ্চনায় সামান্য ব্যক্তিগত ব্যাপারও আর ব্যক্তিগত থাকতে পারছিল না।

প্রতিষ্ঠান বা কল কারখানার সহকর্মীদেরও সম্পর্কের সেই এক টানাপড়েন। একটু এদিক ওদিক হলেই টর্চার সেলে ধরে নিয়ে যাওয়া, তারপর গন্তব্য মরণ তক। সব মিলিয়ে রোমানিয়ার নিরীহ সাধারণ মানুষ কথা বলা ভুলেই যেন যাচ্ছিল। দুই রকম সত্ত্বার ভার তাদের বহন করতে হত। নিজের স্বাচ্ছন্দ্য প্রকাশ যেখানে অসম্ভব সেখান মন ও মনন দুটোই তো মরে যায়। রোমানিয়ান ইতিহাসবিদ, গবেষক দোরিন হবরিঙ্কুর মতে তারা সিজোফ্রেনিক হয়ে পড়ছিল ধীরে ধীরে, এবং আজও তাদের অনেকেই সেই মনোবৈকল্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।

একে তো চরম দারিদ্র, খাওয়া পড়া ঘুম কোনকিছুতে প্রশান্তি নেই, তার ওপর জবানের ওপর তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে, পুরো অস্তিত্বের ওপর রাখা হয়েছে অতন্দ্র নজরদারী। মানুষের সিজোফ্রেনিক হওয়া ছাড়া উপায় কি?

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কমিউনিজম এবং চশেস্কুর “পার্টি লাইন” ঠিক ঠাক পড়া হচ্ছে কিনা, বাইরের তো বটেই প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকেও চরেরা প্রস্তুত নজর রাখতে। কোথাও ধর্মীয় অনুশাসনে ঝুঁকে পড়ছে মানুষ তো তার বিরুদ্ধে নথিবদ্ধ করা হত তথ্যাদি। বহু ধর্ম প্রচারককে তারা আদেশবলে গ্রেফতার করেছে তারপর দরকার মত আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে। হাসপাতালেও যদি চশেস্কু বিরোধী কেউ চিকিৎসা নিতে আসত তাহলে সিক্যুরিটাটের সদস্য ডাক্তার কর্তৃক তার শরীরে রেডিয়েশন ছড়িয়ে মেরে ফেলারও নজীর রয়েছে।

মোট কথা রাষ্ট্রে সমাজে যারা চশেস্কুপন্থী এলিট তারা প্রচণ্ড জাঁকজমকে দিন পার করতে লাগলো। আর বিরোধীরা হচ্ছিল নিশ্চিহ্ন, দিন এনে দিন খাওয়া রাজনীতি বিমুখ মানুষেরা মরছিল ধুঁকে ধুঁকে, প্রতিটা পদক্ষেপ ছিল তাদের কাছে পাহাড় সমান ভারী।

সিক্যুরিটাটের ফাইলগুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা থাকতো। হেরটা মুলারের নিজেরও দুঃসহ সিক্যুরিটেট অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার অভিজ্ঞতায় তিনি নথিবন্দী হয়েছিলেন জার্মান ন্যাশনালিস্ট অ্যান্ড ফ্যাসিস্ট’বিভাগে। ক্রিস্টিনা নামে খোলা হয়েছিল তার ফাইল। তার বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ মোটামুটি এরকম,

১। তিনি তার বই নিদারুঙ্গেনে দেশ এবং বিশেষভাবে দেশের গ্রামীন পরিবেশের বাস্তবতার উদ্দেশ্যমূলক বিকৃতি ঘটিয়েছেন।

২। জার্মান ভাষা-ভাষী কবিদের আড্ডায় তার আনাগোনা ছিল।

এথনিক জার্মানদের সোয়াবিয়ানও বলা হয়। এই সোয়াবিয়ানদের মতই সংখ্যালঘু হাঙ্গেরিয়ান কোন সন্দেহভাজনের ফাইল ছিল হাঙ্গেরিয়ান ইরেডেন্টিস্ট এর অন্তর্গত, আবার ইহুদীদের তথ্য পাওয়া যেত জিউ ন্যাশনালিস্ট হিসেবে।

হেরটা মুলার তিমিসোয়ারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রোমানিয়ান এবং জার্মান সাহিত্যে স্নাতক শেষ করার পর একটি ট্রাক্টর ফ্যাক্টরিতে অনুবাদকের কাজ করছেন কিছুকাল। সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া কিংবা ইস্ট জার্মানি থেকে আমদানিকৃত মেশিনগুলোর ম্যানুয়াল অনুবাদ করার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। সেখানে তিন বছর কাজ করেন। অনুবাদকের কাজ করতে করতে এক সিক্যুরিটাটের এজেন্ট সহকর্মীর বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হন মুলার। তাকে সিক্যুরিটাটে নিয়োগ পরীক্ষা দিতে বাধ্য করা হয়। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তাকে মেরে ফেলারো হুমকী দেয় একজন বড় পুলিশ কর্মকর্তা। “নিদারুঙ্গেন” বইটিতে খণ্ড খণ্ড ভাবে সেই বাজে অভিজ্ঞতার কথা লেখা আছে নানান কল্পিত এবং অথচ ভীষণ বাস্তব চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে

তারপর তার দুর্গতি আরও বাড়ে তার জায়গায় বিনা নোটিশে এবং পরবর্তী নির্দেশনা ছাড়াই অন্য আরেক ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়ার পর। তিনি তার ম্যানুয়েল অনুবাদের অভিধান নিয়ে সিঁড়িতে বসে পুরো কর্মঘণ্টা গুণে গুণে কাজ করেছেন কয়েকদিন। এভাবেও যদি কাজটা টিকে যায় সে আশায় বাড়ি ফিরে যাননি। সিঁড়িতে বসে বসে কান্না গলায় আটকে রেখে কাজ করে যেতেন মুলার, খুঁজে যেতেন কারিগরি প্রতিশব্দগুলো। সেখানেই দুপুরের খাবার খেতেন তিনি।

ফ্যাক্টরির লাউডস্পিকারে তখন শোনা যেত শ্রমিকদের কণ্ঠে দেশের মানুষের সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারার আনন্দমুখর সঙ্গীত।

(চলবে)

আগের পর্বের লিঙ্ক-চশেস্কু সমসাময়িক

আগামী পর্বঃ দ্বৈতসত্ত্বা কিংবা ভঙ্গুর সময় সংক্রান্ত গদ্যের নির্মাণ

লেখকঃ সাহিত্যিক ও জার্মান প্রবাসী বাংলাদেশী

আরও পড়ুন