Ads

আত্মদর্শন

অর্পিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

কিছুদিন আগে একটা বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেই বাড়ির গৃহিণী যে ঘরে নিয়ে গিয়ে আমাকে বসালেন সে ঘরটি মোটামুটি ভালোই সাজানো গোছানো। মধ্যবিত্তের ঘর যেমন হয় আর কি। কথা বলছিলাম ভদ্রমহিলার সঙ্গে আর ঘরের চারপাশে তাকাচ্ছিলাম। কেন জানি না মনে হচ্ছিল এ বাড়িতে কেউ বাস করে না। ঘরটি বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তবু আমি ঠিক স্বছন্দ বোধ করছিলাম না । হঠাৎ বলেই ফেললাম, এখানে আপনারা থাকেন না তাই না ? ভদ্রমহিলা একটু অবাক হলেন। বললেন,কী করে বুঝলে আমরা এখানে থাকি না ? আমি সে কথার উত্তর না দিয়ে বললাম কোথায় থাকেন তাহলে ? উনি জানলার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ওই দিকে আমাদের বাড়ি । বললাম, ওই বাড়িতেই চলুন তাহলে। ওখানে বসেই কথা বলব। ভদ্রমহিলা মনে হল একটু অস্বস্তিতে পড়লেন। তবু আমার অনুরোধে নিয়ে গেলেন ওনার বাড়িতে।

সে বাড়িতে গিয়েই বুঝলাম কেন তিনি এখানে না এনে আমাকে ওই বাড়িতে বসিয়েছিলেন। এ বাড়ির বারান্দায় টালির নিচু ছাউনি। মাথা নামিয়ে ঢুকতে হল। ঘরে আসবাব বলতে একটা নড়বড়ে তক্তাপোষ,তাতে একটা পুরোনো চাদর পাতা। বসতেই ক্যাচকোচ আওয়াজ হল। ঘরের ডানদিকে একটা পুরানো আলনা,তাতে পুরোনো,রঙ ওঠা কিছু জামাকাপড়, বাঁদিকে কাঠের একটা ঠাকুরের সিংহাসন। তাতে অনেক ঠাকুর। মাঝখানে ফুলে চন্দনে সেজে রাজকীয় ভাবে বসে আছে গোপাল ঠাকুর। তার সামনের ছোট্ট পিতলের থালায় দুটি নাড়ু, কয়েকটি নকুলদানা,আর দু টুকরো পেয়ারা। ধুপকাঠি জ্বলছে। তার মানে একটু আগেই পুজো দেওয়া হয়েছে। এককোণায় একটা ছোট্ট টেবিল।সেটাও পুরানো। তার উপরে তিনটে চায়ের কাপ। একটার কানা ভাঙা। সারা ঘরে দারিদ্রের ছাপ। এই দারিদ্র লুকোতেই আমাকে ওই ভালো পাকা বাড়িটিতে বসানো হয়েছিল বুঝলাম।

এ কথা ও কথার পর উনি নিজেই বললেন,ওই বাড়িটা আমার ছেলের। ছেলে ও বউমা বাইরে থাকে। ওই বাড়িতে এখনো অবধি কেউ বাস করেনি। তালা দেওয়াই থাকে। দেখছ তো আমাদের ঘরের অবস্থা। তাই তোমাকে ওই বাড়িতে বসিয়েছিলাম। আমি বললাম,আমার এখানে বসতেই বেশি ভালো লাগছে। কি সুন্দর করে গোপালকে সাজিয়েছেন আপনি ! ওই বাড়িতে তো গোপাল নেই। ভদ্রমহিলা বেজায় খুশি। গোপাল ভক্ত তিনি। তাই গোপালের কথা বলায় তার মুখ চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

ভাবছিলাম ওই ভালো বাড়িটায় বসতে আমার ভালো লাগছিল না কেন? এই বাড়িতেই বা কী আছে যার জন্য এখানে বসতে ভালো লাগল ? এ ভাঙাচোরা বাড়িটার বারান্দায় বাঁশের খুঁটি জড়িয়ে যে চালকুমড়া গাছটি বেয়ে উঠেছে তাতে চালকুমড়া ফুল ফুটেছে। আঁকশি জড়িয়ে যে দেওয়াল আর খুঁটি বেয়ে উপরে উঠছে গাছটি সেই খুঁটি আর দেওয়াল মানুষের কথা শোনে,মানুষের কলহ শোনে,সুখ দুঃখের শ্বাস পড়ে তাদের গায়ে। তাই গাছ ও তার অবলম্বন দুটোই জেগে আছে এ বাড়িতে। জেগে আছে ওই ভাঙা টেবিলের ওপরে রাখা কানা ভাঙা কাপ। স্টোভের উপরে উথলে পড়া ভাতের ফ্যানের দাগ, আলনার পুরোনো জামাকাপড়, সব কিছু জেগে আছে এখানে। কেউ ঘুমোয়না এ বাড়িতে। গভীর ঘুমের ভিতরেও এক নিশ্ছিদ্র অভাব জেগে থাকে এখানে সর্বক্ষণ। সারা বাড়ি প্রাণময়।

ওই ভালো বাড়িতে এই প্রাণটুকুর অভাববোধ ঘটছিল । সাজানো গোছানো, পরিচ্ছন্ন বাড়িটির কোথাও কোনো সংলাপ নেই। ওই প্রাণহীন অসাড় ঘরটি আমাকে মেরে ফেলেছিল প্রায়। আর একটু সময় বসে থাকলে আমি হয়ত অসুস্থ বোধ করতাম। কেন এমন হল ? কী কারণে হল ? তাহলেকি আমার ভিতরের কেউ একজন শব্দ চায়? কথা চায় ? জেগে থাকতে চায় সর্বক্ষণ ? সংস্পর্শ চায় কোনো জাগ্রত অস্তিত্বের ? এত সজাগতা নিয়ে কি করে ধ্যান হবে ? আমিতো ধ্যানে ও মৌনতায় ডুব দিতেও চাই, দিইও। তাহলেকি সেই ধ্যান ও মৌনতার মধ্যেও একটা কেউ সচকিত হয়ে হাওয়ার ফিসফাস,পাতা ঝরার টুপটাপ শোনে ? ঝড়ের শব্দও শুনতে চায় ? কে সে ? সে তো আমি নই। আমাকে যে অতিক্রম করে যায় সে কি করে আমি হব ? সে তো অন্য কেউ। সেই অন্য কেউ,সেই অন্য প্রান্তর, সেই অন্য ভূমিকে খুঁজতে খুঁজতে আমি এত বছর বেঁচে রইলাম। অথচ এ বাড়িটায় না এলে জানাই হতনা যে আমি আসলে বেঁচে ছিলামনা,বেঁচে নেই। আমার হয়ে বেঁচে থাকছে অন্য কেউ,অন্য কোনোখানে। আমি শুধু প্রক্সি দিয়ে যাচ্ছি। হাত তুলে বলে যাচ্ছি ,বলেই যাচ্ছি আমি বেঁচে আছি,বেঁচে আছি , আলবৎ বেঁচে আছি।

লেখকঃ ভারতীয় বাঙ্গালী সাহিত্যিক ও শিক্ষক, কলকাতা

আরও পড়ুন