ডাঃ জোবায়ের আহমেদ
আমাদের দেশের বিত্তশালী,প্রভাবশালী ও এক শ্রেনীর মানুষ কিছু হলেই ইন্ডিয়া ব্যাংকক,সিঙ্গাপুরে উড়াল দেন চিকিৎসার জন্য।
সামান্য সর্দি কাশি থেকে ক্যান্সার এর চিকিৎসায় তারা সেসব দেশে যান এবং সেসব দেশের চিকিৎসা, চিকিৎসক ও সিস্টেমের গুণগান মুগ্ধতা সহকারে প্রকাশ করেন।
গত বছর ডেঙ্গুর ভয়াবহ মোকাবিলায় এই দেশের চিকিৎসকরা যেই আন্তরিকতা নিয়ে নিজেদের সবটুকুন উজাড় করে দিয়ে দেশের মানুষের চিকিৎসায় প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন এবং অন্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে মৃত্যুর হার ছিলো সামান্য।
তো সে জন্য আমরা কতজন কৃতজ্ঞ চিত্তে দেশের চিকিৎসকদের ধন্যবাদ দিয়েছি?
১৮ কোটি জনগন।
১৮ কোটি মন।
১৮ কোটি মানসিকতা।
চাইলেই সবাই কে সন্তুষ্ট করা যাবে না।
আমাদের দেশের মানুষ ডাক্তারের দোষ নিয়ে যতটা সরব, দেশের সাংবাদিকবৃন্দ চিকিৎসায় ভুল ধরতে যতটা মুখিয়ে থাকেন,তারা যদি সত্যি আন্তরিকতা নিয়ে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উন্নত করার দিকে মনযোগ দিতেন তবে আমাদের দেশের মানুষকে বিদেশী চিকিৎসা ও চিকিৎসকদের স্তুতি গাইতে হতো না।
আমাদের কেন একটা মাউন্ড এলিজাবেথ নেই,একটা বামরুনগ্রাদ নেই,একটা সিএমসি ভেলোর নেই তা নিয়ে কেউ ভেবেছেন?
এমন হাসপাতাল তৈরি করার উদ্যোগ কি কেউ নিয়েছেন?
দেশ থেকে লাখো কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, ব্যাংক গুলো লুটপাট হয়ে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে, দেশকে লুটেপুটে খেয়ে শেষ করে দিচ্ছে একটা শ্রেণী কিন্ত তাদের যদি সত্যি দেশের মানুষকে নিয়ে ভাবনা থাকতো, তবে আমরা ভিন্ন চিত্রই দেখতাম।।
আমাদের দেশে একটা কার্যকর চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি।
গড়ে উঠেনি রেফারেল সিস্টেম।
আপনার হাগু টাইট হলেও আপনি ভীড় জমান দেশ সেরা সেলিব্রেটি প্রফেসর এর চেম্বারে।
আবার বলবেন দেশের চিকিৎসকরা সময় দেয়না,কথা শুনেনা,কথা কয়না কেমনে কি?
একজন চিকিৎসক কিভাবে দৈনিক শতজন রুগী দেখতে পারেন??
উনি কি মেশিন।
মেশিনের ও রেস্ট দরকার হয়।।
তো আপনারা যখন সামান্য প্রব্লেমে বড় চিকিৎসক খুঁজেন, তখন উনি চাইলেও আপনার মনখুশি করে সব সময় আচরণ করতে পারেন না।
উনিও মানুষ।
উনার ক্লান্তি লাগে।
অনেক ডাক্তাররা টাকার জন্য ই যে চেম্বারে বসে থাকেন, তা কিন্ত নয়।
তারা আপনার প্রতি একটা দায় অনুভব করেন সেটা আপনার সমালোচক চর্ম চোখে ধরা পড়বে না।
নিজের ফ্যামিলিতে যদি আপনজন ডাক্তার থাকে,তবে আপনি কিছুটা অনুভব করতে পারবেন তাদের প্যারাময় জীবনটা কে।
এমবিবিএস চিকিৎসকদের আপনারা সিম্পল ভাবেন।
অথচ ৫ বছর লেখাপড়া করে এক বছর ইন্টার্ণশীপ করে বের হওয়া দেশের মেধাবীদের আপনারা কতটা অবজ্ঞা ও কটাক্ষ করেন তা জানা আমাদের।
সব কিছুতেই বড় ডাক্তার খুঁজার মানসিকতা থেকে বের হবার সময় এসেছে।
আমাদের দেশের মত উন্নত বিশ্বে আপনি আপনার মন চাইলেই যেকোন চিকিৎসক কে দেখাতে পারবেন না।
সেখানে জিপি সিস্টেম আছে,রেফারেল সিস্টেম আছে,ইমারজেন্সি সিস্টেম আছে।
দেশে শত শত মানহীন মেডিকেল কলেজ হয়েছে।
মানহীন মেডিকেল কলেজ কিভাবে আপনাকে মানসম্পন্ন চিকিৎসক তৈরী করে দিবে?
জেলায় জেলায় প্রতিটি শহরে এত মেডিকেল কলেজের কি দরকার ভেবেছেন??
যারা ব্যবসা ও নামে উঠতে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন,তাদের কিছু বলেছেন কখনো??
যারা এসব মানহীন প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দিচ্ছেন মোটা লেনদেনের বিনময়ে তাদের কিছু বলেছেন কখনো??
দেশে শত শত মানহীন মেডিসিন কোম্পানি মানহীন মেডিসিন দিয়ে বাজার সয়লাব করে ফেলছে।
তাদের নিয়ে আপনি চুপ কেন?
মানহীন কোম্পানি গুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে চিকিৎসকদের চেম্বারে গিফট, টাকা নিয়ে হাজির হয়।
চিকিৎসকরা কি ফেরেশতা?
তারাও আপনার মতই।
আপনি যেমন আপনার অন্যায্য ইচ্ছা পূরণে তবদির করেন,ঘুষ দিয়েও কাজ হাসিল করেন,মানহীন কোম্পানি গুলো সেই পথেই হাঁটে।
নিজে অসৎ হয়ে অন্য থেকে সততা আশা করা বাতুলতা।
দেশে এত ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সেগুলোতে দক্ষ টেকনোলজিস্ট আছে কিনা,মানসম্পন্ন রিএজেন্ট আছে কিনা, মান নিয়ন্ত্রন হচ্ছে কিনা তা দেখবে কে?
আপনার এলাকার হেলথ কমপ্লেক্স এর উন্নয়নে আপনি কতটুকু ভূমিকা রেখেছেন ভেবেছেন কখনো?
কেন মেশিন গুলো বাক্স বন্দি,কেন এম্বুলেন্স অচল জানতে চেয়েছেন?
কখনো আপনারা সুশীল সমাজ ডাক্তারদের গিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, আপনাদের নিরাপদ সংকট আছে কিনা?
আপনাদের আমাদের এলাকায় এসে কাজ করতে কি কি অসুবিধা হচ্ছে??
আজ যখন করোনা ভাইরাস দেশে আসলো তখন আপনি হায় হায় শুরু করে দিলেন।
এখন করোনা আক্রান্ত হলে আপনি কোন দেশে উড়াল দিবেন ভেবেছেন???
আসুন নিজ দেশের চিকিৎসা ও চিকিৎসকদের বিষোদগার না করে মূলে যাই।
প্রব্লেম গুলো খুঁজে বেড়াই।
সিস্টেম এর উন্নয়নে জনমত ও সচেতনতা তৈরি করি।
কিছু হলেই ফার্মেসী থেকে মেডিসিন কিনে খাওয়া বন্ধ করি।
আপনি ডাক্তারদের কসাই কসাই বলে চিৎকার করলেই আপনার দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হয়ে যাবেনা সেটাই খেয়াল রাখিয়েন।।
যা করলে দেশের চিকিৎসা বিশ্বমানের হবে, যেখানে চেচামেচি করলে কাজ হবে, সেখানেই করুন।।
আপনি নিজে কতটুকু ভালো সেটাও ভাবিয়েন।
আপনি আপনার পেশায় ঘুষ খাবেন, অবৈধ তদবির করবেন, ঘুষ দিবেন, নিজে দুই নাম্বারি করবেন আর আশা করবেন দেশের সব চিকিৎসক মানুষ থেকে ফেরেশতা হয়ে যাবে তাও কাম্য নয়।।
তবে দেশে যে হাজার হাজার মানবিক, রুগীবান্ধব চিকিৎসক আছেন,তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন, তাহলে তারা আরো বেশি আন্তরিকতা নিয়ে আপনাকে সেবা দিতে অনুপ্রেরণা পাবেন।।
ডাঃ জোবায়ের আহমেদ চিকিৎসক ও সাহিত্যিক।