তারিক হক
ছোটবেলায় আমার একটি নেশা ছিল । আমাকে পরীক্ষায় প্রথম হতেই হবে । আমার আব্বা জজ ছিলেন, তিনি সবসময় আমাকে বলতেন, তোমাকে সবার চেয়ে বেশি জানতে হবে ।
আমার স্কুলের সব বন্ধুরা যখন ক্রিকেট খেলায় ব্যস্ত, তখন আমি জ্যামিতি আর বীজগণিতের মাঝখানে ডুবে থাকতাম। তাই বৃত্তি পরীক্ষায় জেলার মধ্যে প্রথম হওয়াটি আমার কাছে ছিল ডালভাতের মত ।
ক্লাসে আমি হতাম প্রথম আর তাপস হতো দ্বিতীয়। তাপস ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী, আর খুব নরম মনের মানুষ। কারো সাথে তেমন একটা কথা বলতো না ও ।
ক্লাস শেষ হলেই সাথে সাথে দিতো ছুট । আমার কাছে ওর এই ব্যবহারটি ঐ বয়সে কেমন যেন লাগতো । একদিন ক্লাসের শেষে আমি তাপসের পিছু নিলাম , ও আসলে কোথায় যায়, কি করে সেটা দেখতে ।
দুই মাইল হেঁটে অন্য একটি গ্রামে গিয়ে সে ঢুকে পড়লো একটি ছোট ছনের ঘরে । এখানেই থাকে সে ? আমার মনটি কেমন যেন হয়ে গেলো ।
আমি যে এতক্ষণ তাপসকে অনুসরণ করে তার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গেছি সেটা সে বুঝতে পারেনি । হঠাৎ ওর মা বেরিয়ে এলেন, সাথে সেও । দুজনেই আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলো ।
তাপস জিজ্ঞেস করলো, তুমি আমাদের গ্রামে কোথায় এসেছিলে ? আমি বললাম, এই এখানেই, একটি কাজে এসেছিলাম ।
ওর মা আমাকে দেখে খুব লজ্জা পাচ্ছিলেন, তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না কিভাবে তার ছেলের সহপাঠীকে আপ্যায়ন করবেন । আমাকে একটি পিঁড়িতে বসতে দিয়ে, এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে একটি থালায় কিছু মুড়ি নিয়ে এলেন ।
আমাকে খেতে দিতে দিতে বললেন , তাপসের বাবা নেই , স্কুল ছুটির পর পাশের জমিতে কামলা খাটে, ওই সংসার চালায়।
আমি যে কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না । আমার মাথায় শুধু একটি কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল, কীভাবে সারাদিন কাজ করেও এই ছেলেটি পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয় !!!
ওর মা বলতে থাকলেন , জানিনা বাবা, আর কতদিন ও পড়তে পারবে । যা খরচ । কোনো বৃত্তি না পেলে ওর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাবে। ও তো কখনো প্রথমও হতে পারে না যে বৃত্তি পরীক্ষা দিতে পারবে । ( তখন আমাদের স্কুলে এই নিয়ম ছিল যে, শুধু ক্লাসে প্রথম হওয়া ছাত্র/ছাত্রী বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পাবে )।
আমার মন এত খারাপ হয়ে গেলো যে আমি আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এলাম । মনে আমার শুধু বেজে চলেছে ওর মায়ের কথাগুলি ।
কয়েকদিন পর পূজা । সবাই কেনাকাটা করছে বাজারে । হঠাৎ তাপসের মাকে আমি বাজার দেখতে পেয়ে কিছু কিনে দিতে চাইলাম কিন্তু তিনি কিছুতেই নিতে রাজি হলেন না।
এরপরে বেশ কিছুদিন কেটে গেছে । আজকে ঈদ । বাসায় রান্নার ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে । হঠাৎ আমাদের দারোয়ান এসে বললো, একটি ছেলে আমার সাথে দেখা করতে চাইছে ।
আমি বললাম, তাকে ভিতরে পাঠিয়ে দিন । দারোয়ান বললো , অনেকবার বলেছি কিন্তু কিছুতেই ভিতরে আসতে চাইছে না। তাপস দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার মোড়ে । আমি বললাম , আরে, আরে , বাসায় চলো । ও কোনো মতেই বাসায় এলো না ।
যাওয়ার আগে আমার হাতে একটি পুটলি ধরিয়ে দিয়ে বললো , আজকে তোমাদের ঈদ , আমি এটি তোমার জন্য এনেছি । আমি খুলে দেখবার আগেই ও পালিয়ে গেলো । বাসায় এসে দেখলাম একটি রঙ্গিন পাঞ্জাবি ।
ভাবলাম যার নিজের জীবন ধূসর রঙ্গে রাঙা সে কিনা আরেক জনের জীবন রাঙাতে রঙিন পাঞ্জাবি নিয়ে এসেছে!
ঈদের দিনেও আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো ।
এর পরে বেশ কিছুদিন কেটে গেছে । পরীক্ষাও এসে গেছে । পরীক্ষার দিন ওর সাথে দেখা হলো ।
ও আমার কাছে এসে বললো, এটাই আমার শেষ পরীক্ষা , আর কোনোদিন পড়াশুনা করতে পারবো না । তোমার সাথে আর আমার দেখা হবে না ।
ওকে কেন যেন ভালোবেসে ফেলেছিলাম । ওর চোখের দিকে তাকালাম । দুচোখে শুধুই বৃষ্টির আভা ।
পরীক্ষা শেষ হলো, কয়েকদিন পরে পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে । আব্বা জিজ্ঞেস করলেন , কেমন পরীক্ষা দিলে ? প্রথম হতে পারবে তো ? আমি হ্যাঁ বা না কোনো উত্তর দিলাম না ।
আমি তো জানি আমার কি রেজাল্ট হবে ।
রেজাল্ট বেরুনোর দিন আমি তাপসের পাঞ্জাবিটি পরে রেজাল্ট আনতে গেলাম। দেখলাম, সারা ক্লাসে উত্তেজনা । তাপস প্রথম হয়েছে আর বৃত্তির জন্য মনোনীতও হয়েছে সে। তাপসের দুই চোখে আনন্দ অশ্রু।
সে আমার কাছে এসে চুপিসারে বললো ,”এভাবে তুমি আমার পাঞ্জাবির ঋণ শোধ দিলে?
শিক্ষক বলেছে তুমি প্রশ্নের সব উত্তর দাও নি, কিন্তু আমি জানি তুমি ইচ্ছে করেই এমনটা করেছো, যাতে আমি বৃত্তি পরীক্ষা দিতে পারি,তাই না?
তারিক হক সাহিত্যিক ও জার্মান প্রবাসী।