ফারহানা বহ্নি শিখা
আচ্ছা, আমার কি দোষ, বলতো? আমাকে এক পড়া পঞ্চাশবার শেখালেও, সাথে সাথেই ভুলে যাই।
স্কুলে আমার পাশে কেউ বসতে চায়না। সবাই কেমন কেমন করে জানি তাকায়। কেউ বলে, পাগলি! তাই স্কুল থেকে আমাকে বের করে দিয়েছে টিচাররা। বলেছেন, অন্য বাচ্চাদের পড়ার খুব ক্ষতি হচ্ছে। আমার নাকি দরকার স্পেশাল স্কুলের!স্পেশাল স্কুল কি আর গ্রামে আছে!?নেই।
তাই আমি ঘরে পড়ি, মায়ের কাছে। তিনবছরেও মা আমাকে অ আ ই শেখাতে পারেননি, লেখা তো দূরের কথা!
মুখে মুখে আমি সব বলতে পারি কিন্তু মা না বললে আমি আঙুলে ধরে একটা শব্দও চিনতে পারি না, এলোমেলো লাগে সবকিছু। মা বারবার জিজ্ঞেস করলে আমার রাগ উঠে যায়, বই ছুঁড়ে মারি, কখনো ছিঁড়ে ফেলি। মা বুঝে না কেনো, আমি পারি না, পারছি না! মাথায় রক্ত উঠে যায় আমার। মায়েরও। মা তখন আমাকে সজোরে থাপ্পড় দিয়ে বসেন। বাবা বাসায় থাকলে হায় হায় করে দৌড়ে আসেন।
-কেন মারছো, ও কি বুঝে? নাকি ভালো কথাও বলতে পারে? কেন চাপ দিচ্ছো? ও তো স্বাভাবিক না।
-কেন স্বাভাবিক না? কি পাপ আমাদের?দশ বছরের মেয়ে, কিছুই পারেনা!এখনো আমাকেই পরিষ্কার করে দিতে হয়।এখনো হাতে খেতেও জানে না, ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে! কখনো খাবার ছুঁড়ে মারে…
মা কাঁদতে থাকেন।
-কখন বুঝবে সে? বলো বলো…
দশমাসের ছেলে আর দশ বছরের মেয়ে, দুইজনেরই একই বুদ্ধি। কখন বড় হবে সে? কখনো কি বুঝবে তোমার মেয়ে?বাবা কি জবাব দেবেন আর, চুপ করে থাকেন।আমি একটু কেঁদে ভুলে যাই, কেনো কেঁদেছি।বাইরে বের হয়ে যায়। কেউই, কোনো বাচ্চাই আমার সাথে খেলে না। আমি নাকি খেলা পারি না। আমি যে দলে থাকবো, পরাজয় নিশ্চিত!
আমাকে দৌড়াতে বললে, মন চাইলে দৌড়াই, নয়তো বেঁকে বসি। বলি,
-না, দৌড়াবো না।কেইবা নিতে চাইবে তাদের দলে!?
তাই আমি তাদের খেলা দেখি।
কখনো মনের অজান্তে প্রতিবেশী কারো ঘরে ঢুকে যাই।
তাদের ঘরের বাসিন্দারা আমাকে বলে,
-এই এখানে কি? যা যা।
তবুও আমি চলে না গেলে মিথ্যা করে বলে,
-তোর মা ডাকছে তো, যা নাহ..
আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকি।আমি কি করেছি, শুধু শুধু তাড়িয়ে দেয় কেনো?আমার প্রস্রাবের বেগ আসে।আমি দাঁড়িয়ে ওদের ঘরে পেশাব করে দিই।আমার পায়খানাও করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার আগেই ওরা চিল্লিয়ে ঘর মাথায় তুলে।একজন এসে, জোরে আমার গালে থাপ্পড় মারে। আমি কাঁদতে থাকি।পায়খানা করার কথা বেমালুম ভুলে যাই।ঘাড় ধরে বের করে দেয়ার আগে, মাকে ডেকে এনে একবারের জায়গায় তিনবার করে পরিষ্কার করায়, আমার পেশাব।মা সব পরিষ্কার করে, খুব শক্ত হাতে আমার কবজি ধরে, আমাকে টেনে নিয়ে আসে ঘরে। আমাকে পরিষ্কার করার আগে অনেক মেরে নেন। তারপর বলে,
-এতো মানা করি, তবুও যাস কেন? গেছিস ভালো কথা, পেশাব করলি কেনো ওদের ঘরে? কখন বুঝবি তুই, কখন?
মা মারছে, চিল্লাচ্ছে আর আমার পেট মোচড় দিয়ে মনে পড়ে গেলো, আমারতো আরো একটি কাজ বাকি।আমি ঘরেই বসে পড়ে, সেই কাজটাও সেরে নিই।মা নাকে হাত দিয়ে আমাকে বদনা হাতে কল তলায় নিয়ে যায়।ছোট ভাইটি তাকে কোলে না নেয়ায় কাঁদতে থাকে ভ্যা ভ্যা করে।
ভাবেই চলছে। আমি ঘর থেকে বেরুলে মা পাঁচ মিনিট পরপর আমার খোঁজ নিতে থাকেন, কোথাও কোন অঘটন ঘটায় কিনা।এরপরেও আমি ভুল করতে থাকি, কখনো পাজামা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিই।
কি করবো, মনে হলো পিঁপড়া ঢুকেছে, কামড়াচ্ছিলো।খেলা দেখা ফেলে মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করেনি।বাইরের মানুষজন আবার চিল্লায়। আর মা আমাকে ঘরে বন্দি করতে চায়।বুঝায়,
-বড় হচ্ছিস মা। যেখানে সেখানে পাজামা খুলতে পারেনারে। আর তুই তো মেয়ে। অনেক বিপদ মা, অনেক বিপদ।
আমি মাথা নাড়ি কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকে না। মায়ের কথা পাগলের প্রলাপ মনে হয়।পিঁপড়া কামড়ালেও পাজামা খুলতে মানা করছে, আশ্চর্য!
আমার সারাদিন ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগেনা। ঘরে থাকলেও কাজ বাড়াই। ছোট ভাইকে আদর করে কোলে নিতে গিয়ে খাট থেকে ফেলে দিই।আবার পিঠে মার পড়ে।পুকুরে মা গোসল করতে নেয়। বালতি ভরা ধোয়া কাপড়ে মায়ের অজান্তে আবার সাবান লাগাই।একটু আগে মাকে এভাবে সাবান লাগাতে দেখেছি।আমি বড় হচ্ছি নাহ! মাকে সাহায্য করা দরকার। কিন্তু মা পিঠে ধুমাধুম আবার বসিয়ে দেয় কিল!জানা হয় না, আমার দোষটা কি!?
কখনো গোসল করতে যেতে ইচ্ছে করে না। মা টেনে হিচড়ে নিয়ে যায়, পঁচা মেয়ে বলতে বলতে।মা চায়, আমাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে আর আমি কখন যে নোংরা হয়ে যায়, জানিওনা। মা উঠোনে বসার অনুমতি দেয় শুধু। মোড়া পেতে বসে মানুষ দেখি।আস্তে আস্তে আমি বড় হচ্ছি। একদিন, পাজামা বেয়ে কি জানি পড়ে, মাটি লাল হতে থাকে। আমি উঠানেই পাজামা খুলে ফেলি। মাকে চিৎকার দিয়ে ডাকি।প্রতিবেশীরা আমার ভয় আতংক দেখে হাসে। তাদের কিশোর ছেলে আমার নগ্নতার দিকে ছোঁকছোঁক করে তাকিয়ে থাকে।এসব খেয়াল করার বোধ বুদ্ধি কই আমার!আমি পাজামা খুলে, কামিজও তুলে ফেলি উপরে! পুরা অর্ধনগ্ন আমি!
এবার প্রতিবেশীনি ধমক দেয়,
-বেয়াদব মেয়ে, ঘরে যা বলছি, ঘরে যা..
আমি দাঁড়িয়ে থাকি। মা এসে কাপড় টেনে নিয়ে যায়।এবার আরো বেশি ঘর বন্দি আমি।
মা বলে, আমি নাকি আরো বেশি নোংরা হচ্ছি। রক্ত ঝরলে, মা কিসব কাপড় বেঁধে দেয়। আমি একটানে খুলে ফেলে দিই, ঘরের আনাচেকানাচে।জামা নষ্ট করি। মা বকে, আবার পরিয়েও দেয়।
আমি কি বুঝি এসবের!একদিন মা বাসায় ছিলো না। হয়তো পুকুরে, কি জানি!
বাইরে বেরিয়েছি। প্রতিবেশী কিশোর বললো,
-আয়, তোকে একটা জিনিষ দেখাবো, যাবি?
আমি মাথা নাড়ি। সে আমাকে আচারের প্যাকেট দেয়। মজার খাবার পেয়ে আমি ওর পেছন পেছন অনেক দূর চলে যায়।হঠাৎ দেখি, কাউকে দেখে সে লুকিয়ে গেছে!আমি পথ হারিয়ে ফেলি, কিশোরকেও!
আমি একা একা পথ চলতে থাকি। কেউ আমাকে চেনে না, আমিও না। আমি হাঁটছি তো হাঁটছি।
কোথায় আমার ঘর? কোথায় আমার মা, বাবা, ছোট ভাই?রাস্তায় চলে আসি। এরপরেও ঘরের খুঁজে হাঁটছি। কেউ কেউ আমার হাতে দুই এক টাকা গুঁজে দেয়। আমি কিছুক্ষণ হাতে রেখে ফেলে দিই।টাকা দিয়ে কি করবো?আমার যে ক্ষুধা পেয়েছে!
সন্ধ্যা হয়ে আসে। আমি কাঁদতে থাকি। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলি,
-ঘরে যাবো।
-ঘর কোথায়?
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। জবাব যে জানা নেই।আমি তো জানিইনা, আমার ঘর কোথায়!রাত হয়ে যায়। চায়ের দোকানের এক চাচা জানতে চায়,
-খিদে লেগেছে?
মাথা নাড়ি।
-কিছু খাবি?
আবারো মাথা নাড়ি।আমি যে অপ্রয়োজনে কিছুই বলি না। ছোটবেলা থেকেই কথা বলি খুব কম।
কথা বলে, সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয়!চাচা বলেন,
-দোকানে আয়।
আমি ঢুকি।
তিনি দোকানের ঝাঁপ ফেলে দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে খেতে দেন।এই প্রথম মা বাবা ছাড়া কেউ আমাকে আদর করে ছুঁলো।খাওয়া শেষ হলে, তিনি আমার সারা শরীরেও হাত বুলাতে থাকেন। তারপর…
হ্যাঁ, প্রচণ্ড ব্যথা।
এমন আদর যে তিনি আমাকে করেছেন, আমার শরীর …।
আমি এবারো পাজামা ছুঁড়ে ফেলে দিই।চাচাটা আমাকে বেয়াদব মেয়ে বলে থাপ্পড় দিয়ে আবারো পাজামা পরিয়ে দোকান থেকে বের করে দেন।আমি সারারাত দোকানের বাইরে ঘুমিয়ে থাকি।
সকাল হতে তিনি আমাকে দুরদুর করে তাড়িয়ে দেন।আমি আবার অজানার পথে হাঁটি।খিদে লাগলে কারো কাছে চাই, কেউ দেয়, কেউ দেয় না।ফুটপাতেও মানুষের ভিড়ে আমার জায়গা হয়না।
আমার গায়ে গন্ধ, আমি নোংরা, আমি পাগলি!তাদের থেকে অনেক দূরে গিয়ে শুয়ে পড়ি।
রাতের আঁধারে নোংরা বলে গালি দেয়া কেউ এসে আমার কাপড় খুলে, মুখ চেপে চুপচাপ আদর করে চলে যায়!
কখনো আদর করতে একজন আসে, কখনো সেইরাতে দুইজন কিংবা তিনজনও!প্রথম আদরে ভালো লাগলেও, শেষ আদরগুলোর পর আমি উঠে বসতেও পারি না। ব্যথায় সারা শরীর কুঁকড়ে যায়। আমিও তো মানুষ! হঠাৎ হঠাৎ মায়ের মার আর আদরের খুব অভাব বোধ করি।
কতদিন মায়ের হাতে খাইনি!মা বাবা ভায়ের মনও কি আমার জন্য কেমন কেমন করছে?
কি জানি! পরক্ষণেই মা ভাইয়ের কথা ভুলে যাই। ভুলে যাই ব্যথা আর ব্যথার কারণের কথাও।
আবার উঠে দাঁড়াই। কোথায় যাই, কেনো যাই কিচ্ছু জানি না।
শরীর নোংরা, জামা কাপড় নোংরা। চুলে তেল দিয়ে দেয়নি কেউ। সেই কবে মা তেল দিয়ে আঁচড়িয়ে দিয়েছিলো!
হঠাৎ বমি পায়।এতো গুলো মানুষের সামনে হড়হড় করে বমি করে দিই।সবাই ছিঃ ছিঃ করে পালিয়ে বাঁচে।এমনিতেও পাগলি বলে দশহাত দূর দিয়ে হাঁটে।আস্তেধীরে খিদে বাড়তে থাকে, পেটটা উঁচু হতে থাকে!এ কোন অসুখ বেঁধেছে আমার শরীরে!
মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে হাসে।কেউ আস্তাগফিরুল্লাহ.. বলে চোখ সরিয়ে নেয়।আর আমি দোকানে দোকানে, জনে জনে খাদ্য খুঁজি।একদিন প্রচণ্ড ব্যথা উঠে, প্রচণ্ড!
কতো দুয়ারে গিয়ে করাঘাত করি। কেউ ফিরেও তাকাইনা।কিছু ছোট বড় বয়স্ক মানুষ লাঠি নিয়ে ধাওয়া করে। আমি দৌঁড়াতেও পারিনা।তাদের গালি দিয়ে ঝোঁপ দেখে ওখানে পালিয়ে বাঁচি।
ব্যথা আরো বেশি বাড়তে থাকে।তারপর কিভাবে যেন, আমার শরীর থেকে, আমার ছোট ভাইয়ের মতো একটা বাচ্চা বের হয়ে আসে।আমার কাছে তা যাদু মনে হয়।
কিন্তু আমার শক্তি নেই, তাকে দেখার, ছুঁয়ে দেয়ার। মনে ভয়ও আছে, যদি সে ভাইয়ের মতো হাত থেকে পড়ে যায়!বাচ্চার কান্না শুনে, কয়েকজন যুবক দৌড়ে আসে ঝোঁপে। মনে হলো, শয়তানে ভরা এই পৃথিবীর ভিড়ে, কয়জন ফেরেশতা যেন তারা!তারা আরো কয়েকজনকে ডাকে।
আমার বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেয়। তারপর ডাক্তার, হসপিটাল!আচ্ছা, সত্যিই কি আমার বাচ্চা সে!কি জানি!কিছুক্ষণ পর তো তাকেও ভুলে যাবো আমি!
আমি যে পাগলি!আচ্ছা, আমার কি কোনো নাম ছিলো!?
একবারও কি বলেছি!?ভুলে গেছি।পাগলি নামের ভিড়ে ঐ নামটা হারিয়ে গেছে!
লেখকঃ সাহিত্যিক