Ads

সমাজে ধর্ষণ রোধে ছেলে মেয়ে উভয়কেই নৈতিক শিক্ষা দেয়া দরকার

শারমিন আকতার

ধর্ষণ শব্দটা শুনলেই কেমন যেন পঁচে যাওয়া গলে যাওয়া কোন এক নারীর লাশ চোখে ভেসে উঠে; ধর্ষণ করার পর যাকে রাস্তার ধারে, নর্দমায় বা নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে ।  আমাদের জাতীয় পত্রিকার সাংবাদিকেরা যে ধর্ষণের নিউজ খুঁজতে অনেক বেশী ব্যস্ত থাকে ।পত্রিকাগুলোর পাতা যেন ধর্ষণের খবরে ভরপুর  । ধর্ষিতা বোনের ছবি বড় করে পত্রিকার ফ্রন্ট পেজে দেয়ার জন্য যতটা ব্যস্ত থাকে তার সিকি ভাগ ব্যস্ততাও থাকে না ধর্ষকের ঠিকানা ভালভাবে পত্রিকায় দেয়ার ক্ষেত্রে । ছোট্ট করে অর্ধেক লাইনে তার নাম আর গ্রামের নাম দিয়েই খালাস ।এই পরিচয়ে তাকে কেউ চিনবে  কি না এতে সন্দেহ থাকে । অন্যদিকে ধর্ষিতা বোনের বাবা, মা , ভাইবোন, গ্রামের নাম, থানার নাম এমনকি পারলে তার নানাবাড়ি কোথায় সেটাও দিয়ে দেয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কেন ধর্ষিতার ছবির পরিবর্তে ধর্ষকের ছবি দেয়া হয় না? আমার খুব অবাক লাগে যে জুলুমের শিকার তার ছবি বড় করে ছাপিয়ে তার প্রতি দরদ না দেখিয়ে বরং সমাজে তার বেঁচে থাকা  আরও দুর্বিষহ করে তোলে আমাদের জাতীয় পত্রিকাগুলো !

আমরা সাধারণত দেখি বিভিন্ন আলাপচারিতায় বা আলোচনায় সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া ধর্ষণের প্রসঙ্গ আসলেই  অনেক মেয়ে বলে, ” আমাদের জামা কাপড় নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না, বরং ছেলেরা তার মন মানসিকতা ঠিক করুন ” । আবার অনেক ছেলে বলে, ” মেয়েরা পর্দা করে না বলেই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে।”

আসলে ধর্ষণ ঘটছে মূলত সামগ্রিকভাবে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে । যে পরিবারের  বা সমাজের একটা ছেলে রাস্তার মেয়েকে খাবলে ঘাড় মটকে দিয়ে ধর্ষণের মজা নিবে, সে পরিবারের বা সমাজের মেয়ে সত্যিকারের পর্দা করে ঘুরবে এমন প্রত্যাশা করা আসলে কি অযৌক্তিক নয় কি? 

নৈতিকতার শিক্ষা পরিবার থেকে ছেলে মেয়ে উভয়কেই দেয়া দরকার । ছেলেদের শিক্ষা দিতে হবে মেয়েদের দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকাবে না । আর মেয়েদের শিক্ষা দিতে হবে অনেক বাজে ছেলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এগুলো থেকে সতর্ক থাকার জন্য কিছু পদক্ষেপ তোমার নেয়া দরকার । সেটা যে যার মতো করে নিতে পারে । তবে ধর্মীয় বিধানের আলোকে হলে তো ভালোই হয় । ছেলেরা যদি নৈতিক শিক্ষা না পায় তাহলে মেয়েদের দশ পর্দার বাঁধনে রাখলেও যে মেয়ে বেঁচে যাবে তার গ্যারান্টি আমরা দিতে পারি না । সেনানিবাসে মিতু ধর্ষণ ও হত্যা তার একটা জ্বলন্ত উদাহরণ ।

আজকাল এমনটা হয়েছে যে, পর্দা বলতেই আমরা বুঝি যে এটা শুধু মেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। ইসলাম একটা পূর্নাঙ্গ জীবনবিধান এবং মানুষের সুখী,শালীন ভাবে বেঁচে থাকার সকল উপায় এখানে বাতলানো আছে। আমরা পড়াশুনা করি না তাই জানতে পারি না। আবার অনেকে না জেনেই অনেক বিরূপ ধারণা পোষণ করে থাকি। এখানে উল্লেখ্য যে পর্দা যেমন নারীর জন্য ফরয তেমনি পুরুষের জন্যেও ফরয। পবিত্র কুরআনের পর্দার বিধান সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সূরা নূরের আয়াতদুটিতে প্রথমেই পুরুষদের পর্দার বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছেঃ
‘হে নবী! মুমিন পুরুষদের বলে দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে। এটি তাদের জন্য পূত-পবিত্র পদ্ধতি। তারা যা কিছু করে, আল্লাহ তা জানেন। আর মুমিন মহিলাদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে। আর তারা যেন স্বীয় সাজসৌন্দর্য না দেখায়, তবে যা নিজে নিজে প্রকাশ হয়ে যায় … তা ছাড়া তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে। এবং তারা কারো সামনে তাদের সাজসৌন্দর্য প্রকাশ করবে না এই মাহরাম আত্মীয়গণ ব্যতীত যথা­ স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, ভ্রাতা ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক, অধিকারভুক্ত, বাঁদী, নারীর প্রতি স্পৃহাহীন সেবক, ওই সব বালক যারা নারীর গোপনীয় বিষয় সম্পর্কে অবহিত হয়নি। তারা যেন পথচলার সময় এমন পদধ্বনি না করে যাতে তাদের অপ্রকাশিত সৌন্দর্য পদধ্বনিতে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। ‘হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তওবা কর যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরাঃ নূর, আয়াত- ৩১)।

রাসূল কারীম (স.) হযরত আলী (রা.) কে বলেছিলেন:
“হে আলী! পরনারীর প্রতি প্রথম (হঠাৎ) দৃষ্টির পরে দ্বিতীয় দৃষ্টি দিওনা। কারণ প্রথম দৃষ্টি তোমার পক্ষ থেকে হবে। আর দ্বিতীয় দৃষ্টি তোমার বিপক্ষে অর্থাৎ তোমার জন্য অকল্যাণকর” । দ্বিতীয় দৃষ্টি বলতে এখানে যৌন লালসার সাথে তাকানো বুঝিয়েছেন।
অন্য হাদিসে আছে,
“যে ব্যক্তি কোনো পরনারীর সৌন্দর্যের প্রতি যৌন লালসা নিয়ে তাকায়, কিয়ামতের দিন তার চোখের মধ্যে সিসা ঢেলে দেয়া হবে” ।(ফতহুল কাদির)

এদিকে নারীদেরকেও কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে পর্দার ব্যাপারে । আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নারীদের পর্দার বিধান সম্পর্কে  বলেন, ‘হে নবী! আপনার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ এবং মুমিন স্ত্রীগণকে বলে দিন যে তারা যেন চাদরের কিছু অংশ নিজেদের মুখের ওপর টেনে দেয়, এতে তাদের চেনা সহজতর হবে ফলে তাদের কেউ উত্ত্যক্ত করবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ (সূরা আহজাবঃ আয়াত-৫৯)

শুধু ইসলাম ধর্ম কেন প্রত্যেকটি ধর্মে বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবীদ ডা. জাকির নায়েক বলেছেন, নারীদের পোশাক পরার ব্যাপারে শুধু ইসলাম ধর্ম-ই নয়; খ্রিস্টান এবং হিন্দু ধর্মেও শালীন ও লম্বা পোশাক পরার বিধান রয়েছে।
খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘খ্রিস্টান ধর্ম মতে মহিলারা এমন পোশাক পরবে না, যা পুরুষের পোশাকের মতো। পুরুষরাও মহিলাদের মতো পোশাক পরবে না। যারা এমনটি পরবে তারা প্রভুর ঘৃণার পাত্র। বাইবেলে আরও বলা আছে, মহিলারা শালীন পোশাক পরবে।’ [বুক অব ডিওটরনমী : অধ্যায় ২২, অনুচ্ছেদ ৫]।
হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদের উদ্ধৃতি টেনে তিনি বলেন, ‘হিন্দু ধর্ম মতে মহিলার পুরুষের মতো পোশাক পরবে না। এবং পুরুষরাও তাদের স্ত্রীদের পোশাক পরবে না।’ [ঋগবেদ : অনুচ্ছেদ ৮৫, পরিচ্ছদ ৩০]।

বেদে আরও বলা হয়েছে, ‘মহান ইশ্বর তোমাদের নারী বানিয়েছেন। তোমাদের দৃষ্টি সংযত রাখবে। পর্দার আড়ালে থাকবে।’ [ঋগবেদ : অনুচ্ছেদ ৩৩, পরিচ্ছদ ১৯]।

আমাদের সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা প্রণয়নে আরও সতর্ক হতে হবে । ইউএস এ প্রবাসী লেখক মুনিয়া মাহমুদ বাংলাদেশী মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলেছেন-

“বাংলাদেশের মেয়েরা শোন, তোমরা রাস্তায় সন্ধ্যার পর একা বের হয়ো না। কারণ তোমাদের চারদিকে হায়েনার দল ঘুরছে। তোমাদের ঘাড় মটকে খাবে। তাই তোমরা সাবধানে চলাচল করো। তোমাদের ইজ্জত, তোমাদের অপমৃত্যু তোমাদের নিজেদের ঠেকাতে হবে। দেশে তোমরা নিরাপদ নও তাই তোমাদের নিজে নিজে নিরাপত্তা দিতে হবে। কারণ তোমরা জানো, এ পর্যন্ত অনেক মেয়ের অপমৃত্যু হয়েছে এবং কোনো বিচার হয়নি। নতুন কোনো অপমৃত্যুর খবর আমি পড়তে চাই না। মেয়েরা তোমরা সাবধানে থাকো।”

কোরআনে যেমন মেয়েদের পর্দা করার কথা বলা হয়েছে তেমন ছেলেদের পর্দা করার কথাও বলা হয়েছে ।সুরা নূরে দেখা যায় যে আগে ছেলেদের দৃষ্টি সংযত করার কথা বলা আছে …। ধর্মীয় বক্তব্য যদি বাদ দিয়েও দেয়, তাও বুক উচিয়ে আমরা বলতে পারি  যে আমদের বাঙ্গালী সমাজের সৌন্দর্য ও মূল্যবোধের ভিত্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে শালীনতাবোধ । তাই প্রত্যেকটি বাবা-মার উচিৎ ছেলে- মেয়ে উভয়কে শালীনতার চর্চায় অভ্যস্ত করা । তাদের নিজেদের কর্তব্যের ব্যাপারে সজাগ করা  । তবে ক্ষতিটা যেহেতু মেয়েদের বেশি হয় তাই তাদেরকে আরও বেশি  চিন্তাশীল ও যত্নশীল করে তুলতে হবে এই বিষয়ে….

লেখকঃ সম্পাদক, মহীয়সী

আরও পড়ুন