Ads

গবেষণায় কীভাবে ভালো করবেন?

রাজু আহমেদ

একটা ভিন্ন রকম সময় কাটালাম! পাঠশালা পাঠচক্র আয়োজিত “উচ্চতর পড়াশুনা ও গবেষনায় দিক নির্দেশনা” শিরোনামে একটা আলোচনা অনুষ্ঠানে সরাসরি জুম এপে যুক্ত থেকে অতিথির কাছ থেকে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুনার সুযোগ পেলাম। সেইসাথে পেলাম গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অনেক দিক নির্দেশনা।আলোচনার জন্য অতিথি ছিলেন আমেরিকা প্রবাসী বাঙ্গালী গবেষক ও বিজ্ঞানী ড. রউফুল আলম। কিছু গুরুত্বপুর্ণ বিষয়ের আলোচনার নির্যাসটা আমি এখানে তুলে ধরতে চাই। আলোচকের আলোচনাকে সংক্ষিপ্তস্বারে নিজের ভাষায় লিখছি-
গত তিন শতাব্দীতে মোটা দাগে তিনটি বিপ্লব হয়ে গেছে। আর এই বিপ্লবের নেতৃত্ব যারা দিয়েছেন তারাই আসলে পৃথিবীর নেতৃত্ব তাদের কবজায় নিয়ে নিয়েছেন। বিপ্লব তিনটি হলো-
1. স্ট্রিম ইঞ্জিন আবিষ্কার। যেটা হয়েছে ইউরোপের হাত ধরে। শিল্প বিপ্লব নামের এই বিপ্লবের মাধ্যমেই তাঁরা সারা বিশ্বের আনাচে কানাচে গিয়ে রাজত্ব করতে সক্ষম হয়েছে।
2. বিদ্যুৎ আবিষ্কার। আমেরিকানদের এই আবিষ্কারের ফলাফল আলোচনার অপেক্ষা রাখে না।
3. তৃতীয়টি হলো কম্পিউটার আবিষ্কার। এখনকার দুনিয়া যার কাধে পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে বলা যায়। এই কম্পিউটারের আবিষ্কারকও আমেরিকান গবেষক।
শেষোক্ত দুইটা পয়েন্ট দেখে বুঝাই যাচ্ছে আমেরিকা কিভাবে এতোটা শক্তিশালী হলো! সাম্প্রতিক সময়ে চীন যেভাবে বিশ্বের বুকে উদীয়মান হয়ে দেখা দিচ্ছে তাতে ধরেই নেওয়া যায় চীন আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু চীন কি এমন কোনো বিপ্লব করেছে বা করবে? আমরা বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানতে পারছি যে ২০৩০ সাল নাগাদ চীন হবে বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ। কিন্তু কিভাবে এই গতি তাঁরা সঞ্চয় করলেন? চীন সরকার আসলে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চাইনিজ বিজ্ঞানী, যেকোনো বিষয়ে অভিজ্ঞ, দক্ষ ও মেধাবী যুবসমাজকে কাজে লাগিয়েছে। গবেষণায় মোটা অংকের বিনিয়োগ করে সবাইকে নিজ দেশে ফেরত নিয়ে তাদেরকে কাজ ও গবেষণার জায়গা তৈরি করে দিয়েছেন। এছাড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত গবেষনার জন্য সকল প্রক্রিয়াই তাঁরা সম্পন্ন করেছে। যে কারনে মাত্র কয়েক বছরের ব্যাবধানে চীনা পন্যে ভরে গেছে সারা বিশ্ব।
এখন তারা নতুন বিপ্লবের উদ্ধেশ্যে হাঁটছে।সামনের বিশ্বের চাহিদা অনুযায়ী তারা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপর। এবং এটাকেই তারা বিপ্লবের টার্গেট হিসেবে গ্রহণ করেছে বলে হচ্ছে। সুতরাং বলাই যায় এই বিপ্লব যারা ঘটাবে বিশ্ব তাদের কুক্ষিগত হবে।
সুতরাং বিশ্বে মাথা তুলে দাড়াতে হলে উচ্চতর শিক্ষা এবং গবেষণার বিকল্প নেই।
এখন আশা যাক গবেষণা আসলে কী বা কেমন সেই কথায়। সাধারণত গবেষণা শব্দটি শুনলে আমাদের চোখে ভেষে উঠে বড়ো বড়ো ল্যাব, ফিজিক্স, ক্যামিস্ট্রি, বায়োলজি ইত্যাদি বিশেষ কিছু নির্ধারিত বিষয়। কিন্তু আসলে গবেষণা হতে পারে যে কোনো বিষয়ে। মনে রাখতে হবে গবেষণা আসলে শুধু বিজ্ঞানের বিষয় নয়। মনে করেন আপনার বিভিন্ন ধরণের খাবারের উপর অনেক আগ্রহ আছে। খেতে তো ভালো লাগেই সেই সাথে এদেশের কোন খাবার কিভাবে আমাদের সমাজে প্রবেশ করলো তাতেও আপনার আগ্রহ আছে। যেমন ধরেন পাঁচশ বছর আগে এই উপমহাদেশে গোল আলু কিংবা কাঁচা মরিচ ছিলোনা। অথচ এই দুইটা নিয়ামক ছাড়া এখন আমরা বাঙ্গালি খাদ্যকে কল্পনা করতে পারিনা। চাইলে আপনিও “বাঙ্গালীর খাদ্য সংস্কৃতি” শিরোনামে একটা গবেষণা করে ফেলতে পারেন। মোট কথা গবেষণার বহুত বিষয় আমাদের আশেপাশে আছে। প্রয়োজন আমাদের আগ্রহ ও পরিশ্রম। তাহলেই এদেশ দাঁড়াবে।
এখন আসি গবেষণার বিভিন্ন ধাপ কিভাবে সম্পন্ন করতে হয় তার আলোচনায়।
– প্রথমত আপনাকে যেটা করতে হবে সেটা হলো গবেষণার বিষয় নির্ধারণ। মনে রাখবেন গবেষণা সব সময় নিজের একাডেমিক বিষয়ের উপরেই হতে হবে এমনটা নয়। আপনি চাইলে আপনার একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে সরে এসে অন্যান্য বিষয় নিয়েও গবেষণা করতে পারেন। সুতরাং নিজের পছন্দসই একটা বিষয় আপনাকে প্রথমে নির্বাচন করতে হবে। এবং আপনি গবেষণা করে ঠিক কোন ফলাফলে পৌছাতে চান তার একটা আনুমানিক ছক আপনাকে এঁকে ফেলতে হবে।
– বিষয় নির্ধারণের সময় খেয়াল রাখতে হবে আপনার পছন্দের বিষয়টি কতটা মৌলিক( ইউনিক)। যদি এমন হয় যে আপনার বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক অনেক বেশি গবেষণা হয়ে গেছে। তাহলে ঐ বিষয়ের উপরে গবেষণা করতে না যাওয়াই আপনার জন্য ভালো হবে। একটু চোখ কান খোলা রাখলেই এমন অনেক বিষয় পাবেন যেখানে এখনো তেমন ভালো কোনো গবেষণা কর্ম নেই।
– আপনি যে বিষয়ে কাজ করতে চান সেই বিষয়ে ইতোমধ্যে যেসব কাজ হয়েছে সেগুলোর তথ্য উপাত্ব সংগ্রহ করুন। ঐ বিষয়ের সকল বইপত্র, জার্নাল, সাময়িকী যেখানে যা পান, পড়ে ফেলুন। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নোট করুন। এবং খুজে বের করুন পুর্বের গবেষকরা কোন বিষয় গুলো এড়িয়ে গেছেন বা অসম্পুর্ণ রেখেছেন অথচ আপনার কাছে মনে হচ্ছে সেই বিষয়ে আরো ভালো তথ্য উপাত্ব যোগাড় করা যেতো বা যাবে।অথবা পূর্বের গবেষকদের কোনো কাজকে ভুল মনে হলে আপনি সেটা্কে চ্যালেঞ্জ করে নিজেই গবেষণা শুরু করতে পারেন। যদিও এটা কিছুটা রিস্কি। অনেক সময় ভুল প্রমাণ করাটা অনেক কঠিন এবং অসম্ভবও হয়ে উঠে। সেক্ষেত্রে আপনার পুরো সময়টাই হয়তো নষ্ট হবে। কিন্তু একবার আপনি প্রচলিত বা প্রসিদ্ধ কোনো কিছুকে চ্যালেঞ্জ করে সেটাকে প্রমাণ করতে পারলে আপনার অবস্থান কোথায় থাকবে ভেবে দেখুন। যেমন মানুষ একসময় জানতো পৃথিবী স্থির এবং সূর্্য ঘুরছে। এই ধারণাকে যারা সর্বপ্রথম চ্যালেঞ্জ জানিয়ছিলেন তাদের এখন আমরা বিজ্ঞানের গুরু মানি। সুতরাং একটু রিস্ক তো থাকবেই। এক্ষেত্রে আপনি চেষ্টা করুন একজন সুপারভাইজারের কাছে যাওয়ার। যিনি ঐ বিষয়ে আপনাকে রাস্তা দেখাবেন।
– এখন পালা আপনি কিভাবে কাজ করবেন। এ বিষয়ে সর্বপ্রথম সময় নিয়ে আপনাকে একটা কর্ম পরিকল্পনা করতে হবে। এটাকে বলে প্রজেক্ট ডিজাইন। এর মধ্যে থাকবে আপনার কাজের ধরণ ও প্রকৃতি, ফিল্ড ওয়ার্ক ( যদি প্রয়োজন হয়), তথ্য উপাত্ত্ব সংগ্রহ ও অন্যান্য।
– এবার আপনার কাজটাকে গোছানোর পালা। এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এতোদিন দীর্ঘসময় ধরে আপনি যে কাজটি করলেন সেটার একটা নির্যাস তৈরি করুন।এটাকে বলে ড্যাটা এনালাইসিস। বারবার রিভিউ করুন। সুপারভাইজরের সাথে আলোচনা করুন ।
– শেষমেশ আপনি যখন দেখবেন আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত ফলাফলে এসে পৌছে গেছেন। তখন এটাকে প্রকাশ করতে হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন পাবলিকেশন, জার্নাল, বিভিন্ন কোম্পানী, কনফারেন্স বা সেমিনার প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারেন।
এভাবেই আপনি আমি হয়ে উঠতে পারি এদেশের তরুণ গবেষক। জানি অনেক প্রতিকূলতা আছে। কিন্তু এদেশটাকে ভবিষ্যৎ বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে গবেষণা নির্ভর পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই।
আরও পড়ুন