Ads

বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে কোডিং শিক্ষা অন্তর্ভুক্তি কতটুকু সঠিক?

রাফীউল আহসান (সাদ)

শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই একটি শিশুকে পাঠদান ও সঠিক দিক নির্দেশনা এনে দিতে পারে জাতির উন্নয়ন। শিশুকে পরবর্তীতে দক্ষ ও কৌশুলি করে তুলতে সারা পৃথিবীব্যপী নানা ধরনের সামাজিক ক্যম্পেইন ও পাঠক্রম চালু করা হচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে, শিশুর মেধার বিকাশ ও দায়িত্ববোধ এর উপর কেন্দ্র করে দুই ধরনের দক্ষতাকে গুরুত্ত দেয়া হয়েছে। এক. সৃজনশীল দক্ষতা দুই. কারিগরি নৈপুণ্য ।

সম্প্রতি জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় (২৪.০৪.২০২১) একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী বলেছেন আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই কোডিং ও প্রোগ্রামিং জাতীয় পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কোডিং একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর অংশ যার মাধ্যমে যেকোনো গাণিতিক সমস্যার সমাধান সহজেই করা যেতে পারে। ২০০৫ সালে মাসাচুচেটস ইন্সটিউট অব টেকনোলজির একজন অধ্যাপক সারা বিশ্বব্যাপী ল্যাপটপ পৌঁছে দেওয়ার জন্য নানামুখী ক্যম্পেইন চালু করেছিল যাতে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষের ঘরে ল্যাপটপ পৌঁছে যায়। তিনি একটি তত্ত্ব দাড় করিয়েছিলেন তা হল ওয়ান ল্যাপটপ পার চাইল্ড । এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে দেশের সর্ব স্থানে যাতে ল্যাপটপ পৌঁছে দেয়া। দুর্ভাগ্যবশত, সেই ফাউন্ডেশন আর প্রচারনা সফল হয়নি। আর সে কারনে দেশে যে বাজেট করা হয়েছিল তার পুরটাই ভেস্তে গেল।

দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে কোন অনুন্নত দেশ এই ধরনের প্রযুক্তি কতটা কার্যকরভাবে চালু রাখতে পারবে তা নিয়ে সকলেই সন্দিহান। একটি কোমলমতি শিশুর উপর প্রযুক্তি কতটা সুফল বয়ে আনতে পারে সেটা আমরা একটু পরেই উল্লেখ করতে যাচ্ছি।
প্রথমত, সরকার যে কোডিং পদ্ধতি অন্তরভুক্তিকরনের জন্য যে নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন তার জন্য দেশের প্রতিটি গ্রাম অঞ্চল এবং সেই অঞ্চলের মানুষের আয় রোজগার, বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষক-শিক্ষিকারা কতটুকু প্রস্তুত এবং পিতা-মাতারা এই পদ্ধতির সাথে আদৌ প্রস্তুত কি না এই বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়নি। আর একজন কিছু বিবেচনা না করেই কিভাবে কোডিং এর মত একটি বিষয় প্রাথমিক পর্যায়ে পাঠ্যসুচিতে যোগ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হল।

দ্বিতীয়ত, দেশের অনেক মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষকের কোডিং এর উপর কতটুকু ধারনা আছে তা নিয়েইও কেউ কোন প্রশ্ন তোলেনি। কারণ কোডিং কম্পিউটার বিজ্ঞানের একটি অংশ। এই পদ্ধতিটা সাধারণত স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা গ্রহনের বিষয়বস্তু গ্রহনের সিদ্ধান্ত এর বিষয় বলে বিবেচিত হয়।

তৃতীয়ত, প্রাথমিক পর্যায়ে কোডিং চালু করতে কি পরিমাণ অর্থায়ন করা প্রয়োজন এবং সে তুলনায় জাতীয় বাজেট কতটুকু সফল বাস্তবায়ন করা হবে তা নিয়ে সরকার কোন চিন্তা করেনি এবং তার একটি বিবরণিও পেশ করেনি এখনও।

সাধারণত শিশুরা কোমলমতি হওয়ায় তাদের মস্তিষ্ক এক প্রকার কাদামাটি জাতীয়। তাই এই বয়সে তাদের উপর কোন চাপ না দিয়ে তাদেরকে তাদের মত করে বেড়ে উঠতে দিতে হবে।

জার্মানির ভাল্ডরফ বিদ্যালয় সারা পৃথিবীর মধ্যে একটি স্বনামধন্য স্কুল যেখানে শিশুদেরকে প্রথম অবস্থায় একটি রেখা অঙ্কন থেকে শুরু করে পূর্ণ একটি অক্ষরের জ্ঞানদান করা হয় অথচ জার্মানির মত একটি প্রযুক্তির শীর্ষে থাকা দেশে ১২ শ্রেনীর আগে এমনকি কোন প্রকার মোবাইল অথবা টেলিভিশন দেখতে দেয়া হয় না। আসলে শিশুকে প্রথম অবস্থায় তার নিজ স্কুল , এবং তার সাথে যোগাযোগ ও ভালবাসা স্থাপনের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে যাতে তারা বুঝতে পারে পড়াশনা কোন চাপের কিছু না ,এটা একটা আনন্দের বিষয়।

আমাদের দেশের ৭০-৮০ ভাগ ছাত্র-ছাত্রী গ্রামে বাস করে তারা কতটুকু এই বিষয়টির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন সেটা নিয়েও সরকার ভাবেনি। একাটি শিশুর বেড়ে উঠার প্রাক্কালেই যদি এমন কঠিন একটি বিষয় যোগ করা হয় তাহলে ভবিষ্যতে শিশুদের মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত হবে। একটি উদাহরণ দেয়া যাক, আমরা সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী রাইট ব্রাদার্স এর কথা সবাই জানি যারা প্রথম বিমান আবিস্কার করেছিলেন। তারা দুজনই কোন প্রকার প্রযুক্তি ছাড়াই কিভাবে তাহলে আবিষ্কার করলেন? কম্পিউটার ও প্রযুক্তি জ্ঞান কতটুকু লেগেছে এই প্রশ্ন আপনাদের সামনে পেশ করলাম।

তবে হ্যাঁ কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর একটি অংশ কোডিং হওয়ায় এর সাথে যুক্ত গাণিতিক যুক্তির ব্যবহার, গাণিতিক পুনরাবৃত্তি, দর্শন ও চারুকলা কাজ। ইত্যাদি। যা একজন প্রোগ্রামারকে সৃজনশীল ও কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এটা নিঃসন্দেহে একটি উদ্ভাবনী দক্ষতা। কিন্তু শিশুদেরকে কম্পিউটার ও প্রযুক্তির বাইরে নিয়ে গিয়ে একটি প্রাকৃতিক পাঠদান জাতীয় শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, শহরের অধিকাংশ ছেলে মেয়েরা বর্তমানে কম্পিউটার ও প্রযুক্তির আগ্রাসনে বিপর্যস্ত। তাদের কেউই আজ কম্পিউটার ছাড়া কিছুই চিন্তা করতে পারে না। তাহলে শিশুরা বাস্তব থেকে অনেক বাইরে থেকে যাচ্ছে।

সর্বোপরি বলতে চাই, দেশের আরথ-সামাজিক উন্নয়ন এর বিষয়টি বিবেচনায় রেখে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সঠিক শিক্ষা ও পাঠদানে সকল শিক্ষকমণ্ডলী সবাইকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের উচিত যে পরিমাণ অর্থ প্রযুক্তি খাতে বরাদ্ধ করা আছে তার একটা অংশ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। কারণ একটি সঠিক সিদ্ধান্তই পারে আগামী প্রজম্নকে একটি উজ্জ্বল সমাজ উপহার দিতে।

লেখকঃ কলাম লেখক 

আরও পড়ুন