Ads

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার সামগ্রিক ভাবনা

ওমর ফারুক

বর্তমান দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে শিক্ষাখাতে। উন্নয়ন এবং অর্জনের নানা চিত্র বা পর্যায় রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে যে শিক্ষা ব্যবস্থা বা শিক্ষার যে ধরন সেটা আজ আর অটুট নেই।শিক্ষার সংজ্ঞায় পরিবর্তন এসেছে।শিক্ষার সুফলের সাথে এর কুফল নিয়েও সম্যক আলোচনা হচ্ছে।নানা বিষয় যুক্ত হয়েছে জ্ঞানের রাজ্যে।এখন আর ফলিত জ্ঞানের উপর নয় বরং ব্যবহারিক জ্ঞানই শিক্ষার মূল বুনিয়াদ।পাঠ্যপুস্তক ক্রমেই পঠন সামগ্রী বা উপকরণ থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে।শিক্ষার যে কোনো গণ্ডি নেই, সীমা নেই সে সত্য প্রতিভাত হচ্ছে ক্রমে। মানুষের আর্থিক উন্নতি নির্ভর করে শিক্ষার উপর। তবে বিনিয়োগের ধরনে বিস্তর তফাৎ রয়েছে। আমাদের দেশে পাঠ্যক্রম রচনা করা হয় ফলিত জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে।প্রাথমিক, মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ শিক্ষার কোনো স্তরেই ব্যবহারিক জ্ঞানের পর্যাপ্ত ব্যবহার লক্ষণীয় নয়।

 

দেশে দেশে যে শিক্ষা কাঠামো সেগুলো গতানুগতিক এবং পরিবর্তনীয়।প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা টোল,পাঠশালা শিক্ষার নয়া সংস্করণ। শিক্ষা ভাবনায় প্রথমেই আসে শিক্ষার্থীর প্রয়োজন। পাঠ্যক্রম সে অনুযায়ী প্রণয়ন করা শ্রেয়।শিক্ষার এটা মৌলিক বিষয়।
আমাদের দেশে যে পাঠ্যক্রম এবং যে বিষয় নির্বাচন করা হয় সেগুলো শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনের পথে অন্তরায়। শিক্ষার্থীদের বাহুগত যে বিকাশ সেটা সুষ্ঠুভাবে প্রতিফলিত হয় না। ফলিত জ্ঞান বা তত্ত্বীয় জ্ঞানের মুখস্থ করার পথকে সুগম করে।সঠিকভাবে বিষয় নির্বাচন ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনের পথকে সুগম করে।
শিক্ষার কিছু মৌলিক কাজ থাকা আবশ্যক। এখন আর শিক্ষা গুরুমুখী নয়।শ্রেণিকক্ষে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করতে শিক্ষকের চাইতে শিক্ষার্থীকে বেশি সক্রিয় থাকতে হয়।শিক্ষার্থীকে সক্রিয় রাখার জন্য ফলিত বা তত্ত্বীয় শিক্ষা যথেষ্ট নয়।
তত্ত্বীয় বিষয় শিক্ষার্থীকে মুখস্থ বিদ্যার প্রতি ধাবিত করে।তখন আর শিক্ষার্থীর মধ্যে চিন্তন শক্তির যথাযথ বিকাশ হয় না। নিজের মধ্যে যে উদ্ভাবনী সত্ত্বা রয়েছে সেটা বিনা সুযোগে কিংবা বিনা কায়ক্লেশে নষ্ট হবার যোগাড় হয়।
আমাদের মৌলিক কাজগুলো নির্দিষ্ট নয়।প্রাথমিক পর্যায়ে যে শিক্ষা সেটা অনেকটাই ফলদায়ক বিবেচিত হয়নি।শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে বিকাশ হবার কথা সেগুলোর কোনটাই বৈজ্ঞানিকভাবে হয়নি।যতটা বিকাশ তার সবটাই পরিবার থেকে।শিক্ষায় যে বিকাশের ধরন তারও একটা রূপ নিরূপণ করা জরুরী।

 

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই।পরিকল্পনা না থাকাটা পিছিয়ে পড়ার কারণ নয়।পিছিয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে যতটুকু প্রয়োগ হচ্ছে সেটা আন্তরিকতা এবং সামষ্টিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। সক্রেটিস যে শিক্ষা চালু করেছিলেন সে শিক্ষার ধরন এ সমাজ গ্রহণ করেনি।আমাদের দেশীয় যে ব্যবস্থা, সেটাও প্রায়োগিক নয়।রবীন্দ্রনাথ বা সুলতান শিক্ষার ভিন্ন উপায় খুঁজেছেন।রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি নির্ভর শিক্ষার কথা বলেছেন।কিন্তু সেগুলো আলোচনায় আসেনি।আলোচনায় না আসার কারণ হলো বুর্জোয়া এলিটদের ভূমিকা। এই এলিট শ্রেণী সাহেব বানাবে সাহেবের সন্তানকে। এই চক্র প্রাচীন থেকেই বিরাজমান।

 

আমরা কি পড়াচ্ছি বা কীভাবে পাঠদান করছি তার একটা কৈফিয়ত তলব করা বিধেয়।শ্রেণিভিত্তিক পাঠদান বার্ষিক সিলেবাস দিয়েই সমাপন হয়।এখানে মূল উদ্দ্যেশ সিলেবাসের সমাপ্তি, শিক্ষার্থীর হালহকিকত নিরূপণ করা নয়।বছর শেষে পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সামষ্টিক মূল্যায়ন করা হয়।শ্রেণিকক্ষে যে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হয় তার কোনো চমৎকার বার্ষিক মূল্যায়নে নেই।
পরীক্ষার খাতায় নম্বর বিবেচনা ক্লাস পরিবর্তনের একমাত্র পন্থা, উপায়।শিক্ষার্থীরা বছর শেষে ক্লাস ঠিকই পরিবর্তন করছে কিন্তু তাদের মধ্যে চেতনাবোধ জাগ্রত হয়নি।চেতনাবোধ জাগ্রত না হবার আরও একটা কারণ হলো অদক্ষ এবং যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব।
শিক্ষার মৌলিক আরও একটা ধাপ পেশাগত শিক্ষক।শিক্ষকতা কোনো পেশা নয় এমন একটা ধারণা বহুল প্রচলিত। আমাদের স্কুলগুলোতে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের সংকট রয়েছে। এর ফলে যে মানদণ্ড ধরে পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে তা ব্যাহত হচ্ছে। পড়া দেয়া,পড়া নেয়া,সিলেবাসের বাইরে না যাওয়া, শিক্ষার্থীরা চাহিদা অনুযায়ী পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা না করা,শ্রেণি কক্ষে শিক্ষার্থীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারা, শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার বহুমাত্রিক পথকে উন্মুক্ত করতে না পারা প্রভৃতি সীমারেখা রয়েছে।

 

আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে।আমরা শিক্ষার্থীদের শুধু শেখাতেই চায়।একজন শিক্ষার্থী কিছু না জেনে বিদ্যালয়ে আসে না। তাদের মূলত শোনা আর বলার কাজটি পরিবারই করে দেয়।আমাদের কাজ হলো পড়া আর লেখার কাজটি সমাপ্তিতে উৎসাহ দেয়া।এই উৎসাহ দিতে গিয়েই বিপত্তি ঘটে। শিক্ষার্থীদের কোনো চিন্তা বা পূর্বানুমান আমরা আমলে নিই না।আমরা মনে করি তারা ফাঁকা কলস।পড়াশোনায় শিক্ষার্থীর মেধার বিকাশ হয় এটা সত্য কিন্তু পড়াশোনা ছাড়াও শিক্ষার্থীর মেজর কিছু বিকাশ ঘটে সেটার প্রতি আমাদের অবহেলা।

 

শিক্ষার মধ্যে বিনিয়োগের ফল দৃশ্যমান নয়।আমাদের দেশে শিক্ষায় বিনিয়োগ সর্বাধিক এবং উৎসাহব্যঞ্জক। কিন্তু ফলটা শুধু তেতোই।বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতির কারণে আমাদের স্কুলগুলো ২০২০ সালে ১৭ মার্চ সরকারি নির্দেশে বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকাতে শিক্ষার্থীর পাঠদান কার্যক্রম থেকে দূরে। ধাপে ধাপে লকডাউন বৃদ্ধির ফলে শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা বর্তমান নেই। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে দিয়ে গৃহকর্মে লেগে গেছে। বিদ্যালয় থেকে দূরে এইসব শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কার্যক্রমে নিয়মিত করা বিরাট চ্যালেঞ্জ। স্কুল খুলে গেলে এইসব কোমলমতি শিশুদের বিদ্যায়তনিক কাজে সহানুভূতি দিয়ে সম্পৃক্ত করতে হবে।করোনায় শিশুদের মানসিক বিপর্যয় ঘটেছে।শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সময় পাঠে মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে না। বাড়ি বাড়ি পাঠ দিয়ে গিয়ে এ সত্য সামনে চলে আসে।
শিক্ষায় সঠিক বিনিয়োগের মানে হলো শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল কর্মের উৎকর্ষ সাধন।সে কাজ হচ্ছে না।এদেশে গবেষণার সুযোগ এখনো সৃষ্টি হয়নি।আর এ কারণেই মেধা পাচার রোধ করা যাচ্ছে না। শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নে ফলিত নয় ব্যবহারিক শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে।আর সে অনুযায়ী পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করতে হবে।ব্যবহারিক শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের নিজস্ব ভাবনাকে প্রাধান্য দেয়া জরুরী।
স্বল্প মূল্যের, সহজলভ্য এবং প্রচলিত উপকরণ সংগ্রহ করে বিভিন্ন প্রকল্প তৈরির প্রতি শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করতে হবে। শিক্ষার্থীরা যাতে স্কুলেই নিজেদের প্রকল্প তৈরি এবং প্রদর্শন করতে পারে তার ব্যবস্থা করা কাম্য।পাঠ্যক্রম বিস্তৃত নয় বরং উপযুক্ত পাঠ্যক্রম প্রণয়নই চ্যালেঞ্জ। প্রাথমিকে আরও একটি উৎপাত হলো শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সময় শ্রেণিকক্ষে আটকিয়ে রাখা।এতে করে তাদের সক্রিয়তা দীর্ঘ সময় বজায় থাকে না।খেলাধুলার পথ থাকে না।বইয়ের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে থাকা যথাযথ বিকাশের পথ সংকীর্ণ করে দেয়। আমাদের এই পথ থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে।সামগ্রিক শিক্ষার পথকে উন্মুক্ত করার জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগের পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলো অব্যাহত রাখতে হবে। নয়তো উত্তর-প্রজন্ম জাতি গঠনে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে পিছিয়ে পড়বে।

 

লেখকঃ কলাম লেখক 
আরও পড়ুন