Ads

বাঙালি মানসের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

আরেফিন আল ইমরান

১) নারীর সিগারেট সেবনের ছবি দেখেই, আশা করি ঝাঁপিয়ে পড়বেননা। মূল বক্তব্যে মনোনিবেশ করলেই ভালো করবেন। কারণ, নিষিদ্ধের প্রতি বাঙালি মাত্রেরই প্রবল আকর্ষণ। কিন্তু উপরে সে সাধুবাবা সাজতে পছন্দ করে। কেউ একজন বলেছিলেন—‘বাঙালি ভীষণ যৌনকাতর জাতি।’ আসলেই তাই। উপরে সে ধার্মিকতার লেবাস নেয়। নানাভাবে উপদেশদাতার আপাত ছদ্মবেশ ধারণ করে। কিন্তু একটু ভেতরে গেলেই বুঝবেন যে, সে যা মুখে বলছে তলে তলে নিজেই সেসব অনুসরণ করেনা।

২) বাঙালি অনেক রকম সাংঘর্ষিক চিন্তা ও মূল্যবোধ ধারণ করে। জীবনভর নানারকম বিপরীতমুখী বিষয়াদি নিয়ে সে পথ চলে। দ্বন্দ্ব তার জীবনের অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য। আবার, দ্বন্দ্বের সমাধান করবার মত জ্ঞানগত প্রস্তুতি তার নেই। তার সামাজিক অভিমুখ একপ্রকার। রাজনৈতিক অভিমুখ আরেক প্রকার। সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রশ্নে সে বিভাজিত। ভ্যালেন্টাইন্সে ডে পালন কিংবা পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিয়ে, হঠাৎ সে ধর্মের ছাউনীতে আশ্রয় নেয়। অবাধ মেলামেশাকে উপরে উপরে সে প্রবল আপত্তির চোখে দেখে। আবার সেই চোখ দিয়েই লুকিয়ে পর্নগ্রাফি দেখে। একান্ত গোপনীয়তা পেলে, সে ধর্ম ও নৈতিকতার চিন্তা করেনা। তার ধর্মবোধ অধিকন্তুই লোক দেখানো। সপ্তাহে একদিন নামাজ পড়ে কিংবা রমজানের প্রথম সপ্তাহে বিপুল উদ্যমে ইবাদত করে, সে সেটার দায় মোচন করে। আজীবন অবৈধ উপার্জন করে, শেষদিকে হজে যায় কিংবা তাবলীগের চিল্লা দিতে তৎপর হয়। তার ধারণা, পৃথিবীর মানুষের মত করে পৃথিবীর পালনকর্তাকেও ফাঁকি দেয়া সম্ভব।

৩) বেসিক্যালি বাঙালি শক্তের ভক্ত। রাজনীতিই হোক আর সমাজনীতিই হোক, সর্বত্রই সে কড়া ধাঁচের অত্যাচারীকে পছন্দ করে। ধরুন, রাস্তায় কয়েকজন মিলে একটা অসহায় মেয়েকে নির্দয়ভাবে প্রহার করছে। এক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষ এই দৃশ্য উপভোগ করবে। কেউ কেউ মোবাইলেও তা ধারণ করবে; কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য তৎপর হবেনা। সমাজের নিচ থেকে রাষ্ট্রের উপর পর্যন্ত এই চিত্রই বিদ্যমান। সুদ-ঘুষ বা দুর্নীতির বিপক্ষেও এদের নিজস্ব অবস্থান স্ববিরোধি। একটা মেয়েকে আধুনিক সাজগোজে দেখলে, পৃথিবী রসাতলে গেল বলে এরা শোরগোল করবে। অথচ, দিনশেষে দুর্নীতিবাজদের লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে সরকারি বা বেসরকারি চাকরি বাগাতে, এদের বিবেকবোধ একটুও জাগবেনা। নচিকেতার গানটি এক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক—‘প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া এই দেশে অপরাধ, ঘুষ খাওয়া কখনই নয়।’

৪) পরচর্চায় বাঙালির আগ্রহ সর্বজনবিদিত। চায়ের কাপে একান্ত আলাপে, সে কাছের জনদেরও মুণ্ডুপাত করতে দ্বিধা করেনা। ধরুন, তিনজনে আড্ডা হচ্ছে। একজন উঠে গেলে, বাকি দুজন তারই সমালোচনা শুরু করবে। সমাজে যে মানুষই উন্নতি করুক, এরা সবাই তার অর্জনকে ঈর্ষার চোখে দেখবে। তাকে নিয়ে যে গর্বও করা যায়—এই বোধ বাঙালি ধারণ করেনা।

৫) কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা উচিত আর কোনটা নিয়ে অনুচিত; বাঙালি কখনই এর সীমা নির্ধারণ করতে পারেনা। ধরা যাক কেউ খেলাধুলায় ভালো করে আন্তর্জাতিক সম্মান বয়ে এনেছে। সেক্ষেত্রে বাঙালি তার বউ কী ধরণের ড্রেসআপ, গেটআপ করে সেটা নিয়ে সমালোচনায় মাতবে। স্পোর্টসম্যানের স্পোর্টস বাদ দিয়ে তার ঘরের বউকে পর্দা শেখানোর দায়িত্বটা পুরো জাতি অবলীলায় কাঁধে তুলে নেয়। কিংবা যে লেখক তার দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয়, সেই লেখকের সাহিত্য নিয়ে সে গভীর কোনো আলোচনায় যাবেনা। লেখক কেন মেয়ের বয়সী একজনকে বিয়ে করল, এটা নিয়ে আদিরসাত্মক আলোচনায় লিপ্ত হবে। বস্তুত, এরা সবার ব্যক্তিজীবনকেই নিজের সম্পত্তি বলে মনে করে।

৬) নারীর প্রতি বাঙালি পুরুষ সমাজের ধারণা অতি নিম্ন পর্যায়ের। সংসারে সে একচ্ছত্র অধিপতি। তার পুরুষত্ব ও বীরত্ব দেখানোর মূল জায়গাই হল তার পরিবার। প্রকৃতপক্ষে বাঙালি পরিবারে কঠোর একনায়কতন্ত্র্য প্রচলিত। আয় করার সুবাদে একজন পুরুষ এখানে তার মতকেই প্রতিষ্ঠা দেয়। নারীকে সহকর্মী, সঙ্গী কিংবা অর্ধাঙ্গী ভাবার বিষয়টি এখনো কেতাবি একটা ধারণা। বউ পেটানোর মত ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি এখনো সমাজে প্রতিষ্ঠিত সত্য। ফলে, বিশ্বায়নের স্রোতে নারীও যখন কর্মমুখী ও স্বনির্ভর হতে শুরু করেছে, তখন অনেক ক্ষেত্রে পুরুষও নারীর দ্বারা নির্যাতিত হয় বৈকি। এটা ক্রিয়ার বিপরীতে প্রতিক্রিয়ার মত। মাঝখান থেকে উভয়ের সংঘর্ষে অনেক শিশুর জীবন ও সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া বিধ্বস্ত হয়।

৭) বইয়ে পড়ানো হয়—সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। নলেজ ইজ পাওয়ার—ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু অর্থই যে জীবনে ভোগ-বিলাস তথা দুনিয়াদারীর চাবিকাঠি; এটা বুঝতে বাঙালির বেশি সময় লাগেনা। কার্যত, সে পড়ালেখা করে কেবল একটা চাকরি পাওয়ার জন্য। জীবিকা নিশ্চিত হলে, সে বই ও জ্ঞান উভয়ের সাথেই সম্পর্ক ছেদ করে। বুদ্ধিবৃত্তি, বইপড়া, জ্ঞানচর্চা এসবের সাথে সাধারণ বাঙালির খুব একটা সম্পর্ক নেই। নিজের জীবন ও জগৎকে চিন্তার আলোকে পর্যালোচনার প্রয়োজন—সে কখনই বোধ করেনা। নিরাপদে থেকে একটা জীবিকা নিশ্চিত করতে পারলেই—বাঙালি খুশী থাকে। মানুষ মাপার ক্ষেত্রে এরা টাকা-পয়সা, প্রতিপত্তিকেই গুরুত্ব দেয়। মণুষ্যত্ব, মূল্যবোধ, জ্ঞান বা অপরাপর মানবিক গুণাবলীকে সে প্যারামিটার বলে ভাবেনা।

বিঃদ্রঃ : এটি একটি সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ণ। আরো অনেক কিছু নিয়েই আলোচনা হতে পারত, কিন্তু পাঠকের ধৈর্যের কথা মাথায় রেখে আলোচনা ছোট করা হয়েছে।

 

লেখক আরেফিন আল ইমরান

লেখকঃ সাহিত্যিক ও সঙ্গীত পরিচালক

আরও পড়ুন