Ads

ভারত হয়ে উঠুক মানুষের

ডাঃ জোবায়ের আহমেদ

আমি আজন্ম মানবিক চিন্তা লালন করে এসেছি।আমি মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান জানাতে শিখেছি।ছোটবেলায় দেখলাম হিন্দুদের সাথে আমার বাবা দাদার শখ্যতা।আমাদের গ্রামের যেই বাড়িটা এখন,সেটাই আমাদের গ্রামের ভাওয়ালদের।উনারা ইন্ডিয়া চলে যাবার আগে আমার দাদার কাছে জমিটা বিক্রি করে গেছেন।

আমার বাবার যাদের সাথে খুব সখ্যতা ছিলো তারা হিন্দু।আমি মেডিকেলে কোচিং করি।তখন তীব্র অভাবের দিন আমাদের।আমার জন্য মাসিক খরচের টাকা পাঠাবেন বাবা কিন্ত টাকা তো নাই।তখন যিনি আমার বাবাকে টাকা ধার দিয়েছিলেন তিনি হিন্দু একজন কাকা।

একবার বাড়িতে গেলাম।আম্মা খুব অসুস্থ।উনার মেডিসিন কেনার টাকা নাই।যার কাছ থেকে কখনো খালি হাতে ফিরে আসিনি,যার কাছে টাকা না থাকার পরেও তিনি আরেকজন থেকে টাকা ধার এনে দিয়েছিলেন আমাকে তিনি একজন হিন্দু।

ছোট বেলায় আমার বাবা দাদাদের ডাক্তার ছিলেন মনরঞ্জন ভাওয়াল।যাদব কাকা ছিলেন আমার বাবার প্রিয় বন্ধু।
নন্দীদের সাথে ছিলো আমাদের হৃদ্যতা।ঠাকুর বাড়ির সবাই আমার দাদাকে সম্মান করতেন।

আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ একজন শিক্ষক যিনি আমার অনুপ্রেরণার অন্যতম বাতিঘর পূজনীয় চন্দ্রভূষন শর্মা।পরিমল দাস স্যারের সাথে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন স্যারের আদরমাখা দুষ্টুমি গুলো আজো ভুলিনি।ধীরেন্দ্রনাথ স্যার, পন্ডিত স্যার এর কথা মনে পড়ে।

আমি যখন মাদ্রাসার অংক প্রাইভেট পড়তে হারাধন স্যারের কাছে খাটলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম, তখন আজকের আমি হয়ে উঠতে মন্ত্র যিনি দিয়েছেন সেই হারাধন স্যারকে ভুলি কিভাবে?আমি মেডিকেলে চান্স পাবার পর হারাধন স্যার আমাদের আড্ডা বাজারে আমাকে শত মানুষের সামনে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়েছিলেন কপালে।স্যারের সেই স্নেহ ভুলি কিভাবে।?

আমার পেশাগত দূর্দিনে পিতার স্নেহে পাশে থেকে যিনি সাহস যুগিয়েছেন সেই ডাঃ বাসুদেব স্যার কে ভুলে যাবো?
আমার বাবার চিকিৎসায় যখন অন্যায্য বিল দাবী করেছিলো কুমিল্লার ট্রমা সেন্টার, তখন স্যার মায়া নিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ভুলে যাবো তা?

আমার স্কুলের প্রিয় বন্ধু বিষ্ণু পদ শীল কে ভুলে যাবো কিভাবে?আমাদের বাজারের বড় ফার্মেসী ছিলো হারু কাকার।
রাস্তায় এই মানুষটাকে আদাব দিলে উনি যেই মায়াভরা হাসি দিতেন তা ভুলে যাবো?

মেডিকেল কলেজে আমার পাশের রুমে থাকতো কল্যান, অনল,পিযুস।আমি তাদের রুমে কত আড্ডা দিয়েছি।
সেই সব স্মৃতি ভুলে যাবো?

শিশির চক্রবর্তী স্যার যখন আমার রুগীকে বলে দেন বা অন্য রুগীকে বলেন আপনারা কিছু হলে আমার ছাত্র জোবায়ের আপনাদের কাছে আছে তাকে দেখাবেন, স্যার যখন রুগীদের সামনে আমার প্রশংসা করে আমার মুখ উজ্জ্বল করেন এবং রুগী যখন আবার এসে আমাকে জানায়, তখন স্যারের প্র‍তি যেই সম্মান অনুভব করি, তা কি আর করবো না???

চিত্তরঞ্জন লোদ স্যার আমাদের এলাকার একজন আলোর মশাল ছিলেন।আমার দাদার বন্ধু ছিলেন।একদিন পেরপেটি বাজারে স্যারকে আদাব দিলে, স্যার কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি মাওলানা সাহেবের নাতী তাইনা?
তারপর অনেক দোয়া করলেন।ভুলে যাবো স্যারের সেই দোয়া কে??

আদিত্য সেন আমার অন্যতম প্রিয় বন্ধু।চট্রগ্রামের এই ছেলেটি আমাকে অকৃত্রিম ভালবাসা ও বন্ধুত্বে মুগ্ধ করে রেখেছে।
আমার মন খারাপ হলে সে ব্যাকুল হয়ে উঠে।আমার প্রতি তার এই পবিত্র ভালবাসা কে অসম্মান করবো তবে???

জনি চক্রবর্তী দাদাকে যখন বললাম,দাদা লোনের ইএমআই দিতে পারছিনা।তখন শুধু বললেন, তোমার একাউন্ট নাম্বার দাও।কিছুদিন আগে যখন বললাম,দাদা টাকা টা ফেরত দিতে দেরী হবে।তখন বললেন, তোমার যখন সময় হয় দিও।
আমার টাকা ফেরত দেওয়া নিয়ে বাড়তি চাপ নিতে হবেনা।এই ভালবাসা ও মায়া কে ভুলে যাবো তবে??

পিংকি দিদি যখন জামাইবাবুর চিকিৎসায় আমার উপর আস্থা রাখেন,আমার পরামর্শ শুনেন, সেই আস্থার জায়গাটার কি হবে তবে?

মুমু সেন গুপ্ত দিদি যখন স্বামীর আত্মহত্যার পর একমাত্র মেয়ে পিউ কে নিয়ে অথৈহ সাগরে, তখন আমার পরামর্শ শুনে সাহস পান জীবনে লড়ে যাবার।উনি দ্বিতীয় বিয়ে করবেন কিনা সেই মত যদি আমাকে দিতে বলেন, সব কিছুতে আমাকে ভ্রাতৃস্নেহে আবদ্ধ করেন, সেই জায়গাটা কি হারিয়ে যাবে আমার??

শিবা চন্দ ছেলেটা আমার জন্য কি না করে।আমাকে রাত দুইটায় গরম ভাত রান্না করে খাওয়ায়।আমার উন্নতি নিয়ে যে সারাক্ষণ ভাবে,নিরলস ভাবে আমাকে ও আমার রুগীদের মায়া বিলিয়ে যাচ্ছে।বলা যায় শিবা চন্দ আমাকে আগলে রাখছে পরম মমতায়।সেই মমতা টুকুন আর থাকবে না??

আমি যখন নিজ শরীরের রক্ত অসহায় গরীব হিন্দু নারী প্রতিমালা দে কে দিয়ে দেই, তখন কি তার সাথে আমার মা ছেলের সম্পর্ক গড়ে উঠেনা??

আমি তো কোনদিন আমার হিন্দু স্বজনদের মালাউন বলে গালি দেইনি।তারা যে হিন্দু এটাই তো ভাবতে শিখিনি।
কারণ আমাকে তো তারা মুসলমান ভাবেননি।ভেবেছেন বন্ধু,ভাই,পুত্রতুল্য।

আমাকে যদি হিন্দুরা মানুষ ভাবে,তবে আমি কেন তাদের হিন্দু ভাবতে যাবো?পৃথিবীটা তো আমাদের মানুষের হবার কথা ছিলো।মানুষ হিসেবে মানুষ এর সম্মান পাওয়া উচিত ছিলো।সেই জায়গাটায় নেই আর বহু বর্ণ,গোত্র, ধর্মের মহান ভারত।

আজ ভারতে মুসলমান নিধন চলছে।হেলমেট বাহিনী আজ ভারতেও দেখা যায়।প্যান্ট খুলে ধর্ম যাচাই চলছে।মুসলমানদের মানুষ হিসেবেই মানতে চাইছেন না গেরুয়া বাহিনী।

জেগে উঠতে হবে মানুষদের কে।পৃথিবীটা কে মানুষের করতে বিবেকবান মানুষদের এক হয়ে লড়তে হবে আজ।হিন্দুদের মন্দিরে আক্রমণ হলে গর্জে উঠা চাই।
আবার মসজিদের মিনার ভেঙ্গে হনুমানের পতাকা উড়ালেও গর্জন শুনতে চাই।।মুখে অসাম্প্রদায়িকতার বুলি আওড়ানো কিন্ত কর্মে প্রচন্ড প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক আচরণ মেনে নিতে পারেনা সভ্য পৃথিবীর মানুষেরা।

হিন্দু যখন কাঁদে, মুসলমান যখন কাঁদেএই দুই কান্নার ব্যাথা কি এক নয়???

একজন হিন্দু বন্ধুর কমেন্ট দেখলাম। তিনি লিখলেন, আমরা যদি এখন দলে দলে মুসলমান হওয়া শুরু করি, তবে মোদি কি করবে?অনেক আক্ষেপ থেকেই এই মানবিক মানুষটি এই কথা লিখেছেন।।মোদিদের জিততে দিবেন না।
কখনোই দিবেন না।

আজ সে মুসলমান কে আক্রমণ করছে,কাল সে আপনাকেই আক্রমণ করবে নিশ্চিত থাকুন।ধর্ম দিয়ে যেই বিভাজন এর রেখা টেনে দিতে চাইছে তারা তা রুখে দিতেই হবে মানুষদের।

অনেক রক্ত বয়ে গেছে।অনেক প্রাণের বলিদান হয়েছে এই ধর্মের জন্য।আবার ভারত মাতা মহান হয়ে উঠুক।
সভ্য হয়ে উঠুক।হিন্দুর নয়,মুসলমানের নয়,ভারত হয়ে উঠুক মানুষের।।

 

আরও পড়ুন