Ads

হাতের লেখার সাতকাহন

শামীমা রহমান শান্তা

সে অনেক দিন আগের কথা। আমি বরাবরই খুব উদাসীন মনের মানুষ। ছোটবেলা থেকে পড়ালেখা করতে হবে তাই করেছি।আক্ষরিক অর্থে স্কুল বা কলেজের লেখাপড়া আমাকে খুব বেশি টানে নি কোনোদিন। যতটা টেনেছে বড় বড় লাইব্রেরীর গাদা গাদা নতুন পুরাতন বইয়ের গন্ধ। গল্পের বই সংগ্রহ করে পড়া, কেনা, বিভিন্ন বইয়ের দোকান গুলোতে ঘুরে ঘুরে বইগুলো ছুঁয়ে দেখা আমার শখ ও অভ্যাস ছিল
একসময়।

আমার বান্ধবীরা যেখানে টিফিন খরচ বাঁচিয়ে গয়না, কসমেটিকস কিনতো, আমি তখন পয়সা জমিয়ে প্রতিমাসেই কিছুনা কিছু বই কিনতাম আর পাঠ্যবইয়ের মধ্যে লুকিয়ে রাতের পর রাত জেগে সেগুলো পড়ে বড় বড় শ্বাস নেয়া ছিল আমার আনন্দ।

কথা তো সেটা নয়।কথা হল বাবা মায়ের স্বপ্ন ছিল আমি অনেক বড় কিছু হবো। সেজন্য স্কুলের বই খাতা পড়া, পরীক্ষা দেয়া সবই নিয়মিত করতে হতো।

সমস্যা হল অতিরিক্ত পড়ার কারণে আমার লেখালেখির অভ্যাস ছিল খুবই কম, হাতের লেখা ছিল সাংঘাতিক রকম পঁচা। সে কারণেই আমার জ্ঞানীগুণী শিক্ষকেরা আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলতেন “বাবা এ হাতের লেখায় বেশিদূর যেতে পারবেনা। এটাকে মেরামত করে ফেলো।”
কিন্তু এটাতো সাইকেলের টায়ার নয় যে গ্যারেজে নিয়ে সারিয়ে আনব!

সবাই বলত “মেরামত কর।”
কিভাবে করব?  সেটা কেউ বলত না, বা বলার প্রয়োজন বোধ করত না।
মহা মুসিবত! মনের মাধুরী মিশিয়ে কত কি যে লিখতাম অথচ স্যার ম্যাডামরা কিছুই বুঝতেন না। যেখানে ১০ এর মধ্যে ৮ পাওয়া উচিত , সেখানে ৫/৬ ও পাই না!

এভাবে এসএসসি পাস করে ফেললাম। খুব অল্প  নম্বরের ব্যবধান এর জন্য স্টারমার্ক এলোনা।আমার সমস্ত শিক্ষকরা আফসোস করে বলতে থাকলেন ,
“তোর হাতের লেখাটা যদি ভালো হতো তুই কমপক্ষে এই নাম্বার থেকে আরো ১০০ নাম্বার বেশি পেতিস ।

তাই ভেবে নিলাম “এ হাতের লেখার পেছনে এবার লাগবো। একেবারে আদাজল খেয়ে লাগবো!”

একেতো মফস্বলের ছোট্ট একটা স্কুলে পড়ি। তারপরও এখনকার মতো মোবাইল, ইন্টারনেট, ইউটিউব  কিছু ছিল না। শুধু খবরের কাগজ পড়তাম । খবরের কাগজের  লেখা গুলো ছাপার অক্ষর। ঠিক বইয়ের লেখার মত। কিভাবে তা থেকে শিখবো, লিখব?

রাতদিন নিজেকে বোঝাতাম
“ভাবো মন, ভাবো। নইলে এইচএসসিতে তোমার কোন উপায় নাই! পড়িতেছো তো বিজ্ঞানে, অজ্ঞান হইতে বাকি থাকিবেনা। যাওবা কষ্ট করে পড়িতেছো তা যদি শিক্ষকেরা নাহি বুঝেন তাহলে ফেল করিয়া পরের ঘরের ঘরনি হইয়া চলিয়া যাইতে বাধ্য থাকিবা।”

যাগ্গে ! তখন অভিনব বুদ্ধি মাথায় আসলো। আমাদের সময় প্রচুর ‘দেয়াল লিখন’ হত। দেখতাম পড়াশোনা না জানা লোকেরা অবিকল ছবির মত বাক্যগুলো গোটা গোটা অক্ষরে কি সুন্দর করে লিখে যেতো।
দেয়ালে গল্প ,কবিতা, স্লোগান, রাজনীতি,  ভোট চাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি সবই থাকতো।

আমি “যশোর সরকারি মহিলা কলেজে” পড়তাম। মাঝে মাঝে বই কিনব বলে টাকা বাঁচাতে, অনেকটা রাস্তা হেঁটে যেতাম। হাঁটার সময় রাস্তার চারপাশে বিভিন্ন বাড়ির পাঁচিলের দেয়ালে মোটামুটি যা লেখা থাকত সবই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। সাথে একটা ছোট্ট নোটবুক থাকতো।
পরিকল্পনামাফিক যে দেয়ালের যে অক্ষর টা বেশি সুন্দর লাগতো, সেটা নোট বইতে তুলে নিয়ে আসতাম।

তারপর বাসায় ফিরে খবরের কাগজের উপরে, নিচে ভেতরে, যেখানে যত ফাঁকা জায়গা থাকতো, সবগুলোতে সেই অক্ষর অনুশীলন করতাম। কোনদিন ক, কোনদিন খ,  কোনদিন গ, কোনদিন ঙ সবথেকে সমস্যা সৃষ্টি করত ক্ষ! এভাবে দিনের পর দিন খবরের কাগজগুলো অক্ষরে অক্ষরে রঙিন হয়ে উঠত। কত ধরনের কলম, কত ধরনের কালি ,তাতে পড়তো তার কোন ইয়াত্তা ছিলনা।

আমার আব্বু খবরের কাগজের  খুব মনোযোগী পাঠক ছিলেন।( এখনো)  তিনি মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত হতেন, মাঝে মাঝে উৎসাহ দিতেন, মাঝে মাঝে বলতেন
” একটা খাতা বানিয়ে লেখ না কেন!”
আমার কিন্তু ওই খবরের কাগজের নরম পাতাটাই অক্ষর অনুশীলনের জন্য প্রিয় ছিল।

হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাম কলেজের প্রিয় শিক্ষকবৃন্দ  আমার হাতের লেখার জন্য খুব প্রশংসা করছেন। কেউ কেউ আমাকে ‘পোস্টার’ লেখার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। ততদিনে ছোটখাট একটা কবি হিসেবে আমার একটা পরিচিতি ও  হয়ে গিয়েছিল।

আলহামদুলিল্লাহ। বুঝলাম চেষ্টা করলে আল্লাহ সবই দেন।তারপর থেকে আমার লিখতে ভীষণ আনন্দ হতো। কত কিছু যে লিখতাম। ডায়েরি ভরে, খাতা ভরে, মনের কথা গুলো সাজিয়ে রাখতাম।

পড়া বইগুলোর উক্তি, পছন্দের কবিতার লাইন, বিখ্যাত উপন্যাসের কত গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যত্ন করে গুছিয়ে লিখেছি তার ইয়ত্তা নাই।

পরবর্তী পরীক্ষাগুলোতে মাশাআল্লাহ হাতের লেখা নিয়ে আর কখনো চিন্তা করা লাগেনি।  যা লিখেছি আশার থেকে অনেক বেশি নাম্বার পেয়ে পার হয়ে এসেছি। আলহামদুলিল্লাহ।

কথা তো সেটা না। এখন এসেছে মোবাইলের যুগ।
বাচ্চাদের লিখতে মন চায় না। হাতের লেখার দিকে অনেকের নজর নেই।

আবার স্কুল-কলেজ পড়ুয়া অনেক ছাত্রছাত্রী আমার মত কিভাবে হাতের লেখা  সুন্দর করবে তা নিয়ে অবিরত ভাবতে থাকেন। তাদের জন্য বলব:

* মনে সাহস রাখুন,
*নিজেকে বোঝান ‘আপনি পারবেন।’
*সর্বপ্রথম পছন্দমত অক্ষর নির্বাচন করুন । (প্রয়োজনে ইউটিউব এর সাহায্য নিন)
প্রতিদিন নির্দিষ্ট অক্ষরটি যতবার সম্ভব অনুশীলন করুন।
*অক্ষর গুলো বাক্যে ব্যবহারের সময় ফরমেট ঠিক থাকছে কিনা লক্ষ্য রাখুন।
*প্রত্যেক ভাষার লেখার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট,  ও নির্ধারিত নিয়ম থাকে। বাংলা ও ইংরেজি ভাষার ও লেখ্যরীতির নির্ধারিত নিয়ম আছে। যা অনুসরণ করা খুবই জরুরী। লেখার শুদ্ধ রীতিটি শিখে ফেলুন।
*ঘড়ি ধরে ১ মিনিটে সর্বোচ্চ কতটি বাক্য লিখতে পারছেন । তা হিসাব করে আরো বেশি বাক্য লেখার অনুশীলন করুন।
*লেখার জন্য পছন্দমত দ্রুত লেখা সম্ভব হয় এমন কালির কলম ব্যবহার করুন।
*এভাবে অনুশীলন করতে থাকলে ইনশাআল্লাহ একদিন দেখবেন আপনার মাথা লিখছে না, আপনার হাতই আপনার লেখাগুলো লিখে দিচ্ছে। মস্তিষ্কের চাপ অনেকটাই কমে যাবে ।
*সর্বোপরি আমিও সবার মত বলতে চাই
“যার মন সুন্দর ,তার হাতের লেখা সুন্দর !

মনকে যেমন আমরা চাইলেই সুন্দর করতে পারি ।হাতের লেখাও আমরাই চাইলে সর্বোচ্চ সুন্দর করে তুলতে পারি। আল্লাহ তৌফিক দিন। আমীন।

শামীমা রহমান শান্তা – কবি ও লেখক।

আরও পড়ুন