।। শারমিন আকতার ।।
২২ মে বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস । ইহা জীববৈচিত্র্য বিষয়ক উন্নয়নে জাতিসংঘ কর্তৃক অনুমদিত একটি দিবস । জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে ১৯৯২ সাল থেকে ২২ মে “বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস” হিসেবে পালন করা হয় । প্রতি বছর জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক প্রোগ্রামের অধীন গৃহীত Convention on Biological Diversity (CBD) সনদ কর্তৃক এই দিবসের একটি করে প্রতিপাদ্য ঘোষিত হয় । এ বছরের প্রতিপাদ্যটি হচ্ছে “Harmony with nature and sustainable development”. অর্থাৎ “প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য এবং টেকসই উন্নয়ন”।
মানুষের অস্তিত্ব ও উন্নয়নে জীববৈচিত্র্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে । আমাদের পরিবেশের প্রধান উপাদান হচ্ছে জীববৈচিত্র্য । পৃথিবীর মাটি, জল ও বায়ুতে বসবাসকারী সকল উদ্ভিদ, প্রাণী ও অনুজীবের মধ্যে যে জিনগত, প্রজাতিগত ও পরিবেশগত (বাস্তুতান্ত্রিক) বৈচিত্র্য দেখা যায় তাকেই জীববৈচিত্র্য (Biodiversity) বলে । অর্থাৎ সহজ কথায় আমাদের আশেপাশের পরিবেশে ও বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রে বিদ্যমান উদ্ভিদ, প্রাণী ও অনুজীবের বৈচিত্র্যই হচ্ছে জীববৈচিত্র্য ।
আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেছেন, ‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ করুক—আমি আশ্চর্য উপায়ে পানি বর্ষণ করেছি, এরপর ভূমি বিদীর্ণ করেছি, এরপর তাতে উৎপন্ন করেছি শস্য, আঙুর, শাকসবজি, জয়তুন, খেজুর, ঘন উদ্যান, ফল ও ঘাস; তোমাদের ও তোমাদের চতুষ্পদ জন্তুদের জীবনোপকরণ হিসেবে।’ (সুরা আবাসা, আয়াত ২৪-৩২)
আবার সূরা আরাফে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “স্মরণ কর, যখন আদ জাতির পর তিনি তোমাদেরকে (তাদের) স্থলাভিষিক্ত করেন এবং যমীনে তোমাদেরকে এভাবে প্রতিষ্ঠা দান করেন যে, তোমরা সমতলে প্রাসাদ নির্মাণ করছো ও পাহাড় কেটে গৃহের মতো করছো । সুতরাং আল্লাহর নিয়ামতসমূহ স্মরণ কর এবং পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তার করে বেড়িয়ো না ।” (সূরা আরাফ-৭৪)
উপরোক্ত আয়াতদুটো ভালো করে খেয়াল করলে আমরা দেখতে পাবো, বাস্তুতন্ত্র (Ecosystem) এবং বিভিন্ন জীববৈচিত্র্যের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা কীভাবে আমাদের ও অন্যান্য প্রাণীর খাদ্য এবং বাসস্থলের ব্যবস্থা করেছেন তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে । আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানাবিধ চাহিদা মিটাতে পরিবেশের বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্য কীভাবে আমাদের সহায়তা করতে পারে তা কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় বর্ণনা করা হয়েছে । আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য উপকারী অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদের সাথেও আমাদেরকে পরিচয় করে দিয়েছেন কোরআনের মাধ্যমে । সেগুলো থেকে আমরা কীভাবে উপকৃত হতে পারি, সেগুলোর যত্ন নেয়ার মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব কীভাবে টিকিয়ে রাখতে পারি অনেক সময় তারও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে বিভিন্ন আয়াতে ।
আরও পড়ুন-
২০২২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আজকের পত্রিকায় “জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ইসলামের নির্দেশনা” শিরোনামে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক কাজী ফারজানা আফরিন একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করেছেন । তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘মিসরের প্রখ্যাত আলেম আল্লামা সাইয়েদ তানতাভি বলেছেন, “আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ৫০০ বার প্রকৃতি এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছেন। কোরআনে ৫৪ প্রজাতির উদ্ভিদের কথা বলা হয়েছে; যার মধ্যে ৫১ প্রজাতি পৃথিবীতে পাওয়া যায়। বিক্ষিপ্তভাবে প্রায় ২০০ আয়াতে প্রাণিজগতের প্রসঙ্গ এসেছে।”
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃও বৃক্ষ রোপণ ও পরিবেশের মান উন্নয়নের উপর অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন । এমনকি বৃক্ষ রোপণ তথা জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণকে তিনি ইবাদত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন । তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোনো বৃক্ষ রোপণ করে, আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে তাকে ওই বৃক্ষের ফলের সমপরিমাণ প্রতিদান দান করবেন।” (মুসনাদে আহমাদ- ২৩৫৬৭)
পৃথিবীর ভারসাম্য এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়া চলমান রাখার জন্য পরিবেশের বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ । জীববৈচিত্র্য আমাদের জীবনে এবং আমাদের অস্তিত্ব রক্ষায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে । জীববৈচিত্র্য ভিত্তিক সম্পদ আমাদের সভ্যতা গড়ে তোলার মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। সারা পৃথিবীতে মানুষের ৮০ শতাংশেরও বেশি খাদ্য আসে উদ্ভিদ থেকে । পৃথিবীর প্রায় কয়েক বিলিয়ন মানুষের ২০ শতাংশ প্রাণীজ প্রোটিন আসে শুধুমাত্র মাছ থেকে । পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলোর গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ তাদের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য চিরাচরিত উদ্ভিদ-ভিত্তিক বিভিন্ন ধরণের ওষুধের উপর নির্ভর করে থাকে। এছাড়াও উদ্ভিদ জীববৈচিত্র্য সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন অবমুক্ত করে যা মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণীর শ্বাস- প্রশ্বাসে ভূমিকা রাখে । জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণেও উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে ।
আমাদের নিজেদের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থেই আমাদেরকে জীববৈচিত্র্যের যত্ন নিতে হবে । নিজেদের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কল্যাণের জন্য জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ এবং এর টেকসই ব্যবহার করা আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য । আল্লাহর রাসুল সাঃ বৃক্ষ রোপণের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেছেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে কিয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে, যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি রোপণ করবে।’ (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৪৭৯)
তিনি অন্য এক হাদিসে বলেছেন, ‘যদি কোনো মুসলমান একটি বৃক্ষ রোপণ করে অথবা কোনো শস্য উৎপাদন করে এবং তা থেকে কোনো মানুষ কিংবা পাখি অথবা পশু ভক্ষণ করে, তবে তা উৎপাদনকারীর জন্য সদকা (দান) স্বরূপ গণ্য হবে।’ (বুখারি- ২৩২০) । রাসুলুল্লাহ (সা.) সব সময় বৃক্ষরোপণের ফজিলত উল্লেখ করে সাহাবাদের উৎসাহ ও নির্দেশনা দিতেন।
অথচ আমরা নির্বিচারে বনাঞ্চল কেটে নগরায়ন করছি, নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট করে উন্নয়ন কার্যক্রমের নামে জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল নষ্ট করে ফেলছি, বনাঞ্চলের গাছ কর্তন করছি, পাখি ও বিভিন্ন বন্যপ্রাণী শিকার করছি ঠুনকো স্বার্থে । নানাবিধ কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা পরিবেশ দূষণ করে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসে ভূমিকা রাখছি । যেমন অধিকহারে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার, শিল্প-কারখানার বর্জ্য নদী বা সমুদ্রে ফেলা, ব্যাপক হারে পলিথিনের ব্যবহার । শুধুমাত্র অর্থনৈতিক লাভের কথা মাথায় রেখে আমরা এমন সব কাজ করছি যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে মারাত্মক হুমকীর মুখে ঠেলে দিচ্ছি ।
উন্নয়নের স্রোতধারায় সামিল হতে গিয়ে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা মাথায় রাখলে হবে না । বরং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের কোনও ক্ষতি সাধন না করে টেকসই উন্নয়নে নিজেদের পদক্ষেপ রাখতে হবে । আমাদের নবীজি (সা.)সহ পরবর্তী সব খলিফা যুদ্ধের সময় সৈন্যদের প্রতিপক্ষের কোনো গাছপালা বা শস্যক্ষেত্র ধ্বংস না করতে নির্দেশ দিতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলছেন, ‘তোমরা কোনো বৃক্ষ উৎপাটন করবে না।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৯৪৩০) । আবার অন্য এক হাদিসে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ওই ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে প্রাণীদের অঙ্গচ্ছেদ করে।’ (বুখারি)
জীববৈচিত্র্যের যত্ন নেয়া আমাদের ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব । জীব বৈচিত্র্যের ক্ষতি করে আমরা মূলত নিজেদের ধ্বংসের আয়োজন করছি । আল্লাহ তায়ালার সেই সতর্কবাণী আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ‘তোমরা নিজেদের ধ্বংস ডেকে এনো না।’ (সুরা বাকারা: ১৯৫) ।
লেখকঃ লেখক, গবেষক এবং সম্পাদক, মহীয়সী
লেখাটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পূবের কলমে পূর্ব প্রকাশিত
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল, আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেইজ মহীয়সী/Mohioshi-তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হ্যাঁ, মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইল-
[email protected] ও [email protected] -এ; মনে রাখবেন, “ধন দৌলত খরচ করলে কমে যায়, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়”। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনি জ্ঞান দান করেন।” (সহিহ বুখারী- ৭১, ৩১১৬, ৩৬৪১, ৭৩১২, ৭৪৬০; মুসলিম- ১০৩৭; ইবনে মাজাহ- ২২১) ।
মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম; আজই আপনি যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে। আসুন, ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি। আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমীন।