Ads

মানুষের মূল্যায়ন

আরিফুল ইসলাম

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘মানুষ’ কবিতায় একজন মোল্লাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তৎকালীন সময়ে কাজী নজরুল ইসলামের সাথে আলেমদের দ্বন্দ্ব ছিলো প্রকট। এমনটা হবারই কথা ছিলো। কেননা, কাজী নজরুল ইসলামের একাধিক কবিতায় স্পষ্ট শিরক-কুফর ছিলো।
অন্যদিকে, কাজী নজরুলের ইসলামি কবিতার জন্য অনেক আলেম তাঁর প্রশংসা করেন। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, নজরুল তাঁর জীবনের অন্যতম কীর্তি কুরআনের আংশিক কাব্যানুবাদ ‘কাব্য আমপারা’ উৎসর্গ করেন বাংলার আলেমদেরকে!

‘মানুষ’ কবিতায় নজরুল ঐ মোল্লার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে বিচার দেন। এটা তো অবাক করার মতো। হুজুরের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ। সচরাচর তো এমনটা হয় না। নজরুল এমন ‘বাইপাস’ করলেন কেনো? হুবহু তাঁর কবিতার ঐ অংশ তুলে না ধরলে বুঝার উপায় নেই।

“মসজিদে কাল শিরনী আছিল, অঢেল গোস্ত-রুটি
বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটিকুটি!
এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে আজারির চিন্
বলে ‘বাবা, আমি ভুকা-ফাকা আছি আজ নিয়ে সাত দিন!’
তেরিয়া হইয়া হাঁকিল মোল্লা- ‘ভ্যালা হ’ল দেখি লেঠা,
ভুখা আছ মর গো-ভাগাড়ে গিয়ে! নামাজ পড়িস বেটা?’
ভুখারী কহিল, ‘না বাবা!’ মোল্লা হাঁকিল- ‘তা হলে শালা
সোজা পথ দেখ’ গোস্ত-রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা!
ভুখারি ফিরিয়া চলে,
চলিতে চলিতে বলে-
‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুধার অন্ন তা’বলে বন্ধ করনি প্রভু
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি
মোল্লা-পুরুত লাগায়াছে তার সকল দুয়ারে চাবি!’

কবিতাটি আর বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন নেই। কবিতার বক্তব্য ক্লিস্টাল ক্লিয়ার- বে-নামাজী বলে সিন্নি দেয়া হয়নি; সিন্নি পাবার হকদার ধরে নেয়া হয়েছে নামাজীদের। নজরুল যে মানসিকতার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়েন, সেই মানসিকতার লোক সমাজে এখনো বিদ্যমান। সমাজে যতোদিন এমন মানসিকতার লোক বিদ্যমান থাকবে, নজরুলের প্রশ্নটি ততো বেশি প্রাসঙ্গিক হবে।

আপনি একটু চোখ বুলান সমাজের নানান শ্রেণীর দিকে। যারা নিয়মিত নামাজ পড়ে এবং নজরুলের ভাষায় কিছু কিছু মোল্লা বে-নামাজীদের দিকে কিভাবে তীর্যক মন্তব্য ছুঁড়ে। মসজিদে কখনো এমন মানুষ যদি প্রবেশ করে, যে সপ্তাহে জুমআর নামাজ ছাড়া আর কোনো নামাজ পরে না, তার দিকে সবাই ভূত দেখার মতো তাকায়। এমনকি তাকে স্বাগত জানানো তো হয়ই না, তার মসজিদে আসা নিয়ে নানান প্রশ্ন করা হয়।

আপনি দান করার দিকে যান। দেখবেন, সেখানেও সিলেক্টিভ বায়াস পাবেন। খুঁজে-খুঁজে নামাজীদেরকে দান করা হয়। শুধু নামাজীদেরকে দান করাটা খারাপ না, কিন্তু ‘বে-নামাজীদেরকে দান করা যাবে না’ এরকম ধারণা লালন করাটা একধরণের সুপারিওরিটির প্রকাশ। এরকম সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হলে কুরআন-সুন্নাহর দলীল লাগবে।

দুই.
কাজী নজরুল ইসলাম প্রশ্ন তুলছেন- বে-নামাজীকে খাওয়ানো যাবে না কেনো? আমরা প্রশ্ন তুলি- কাউকে খাওয়ানোর জন্য তার আকীদা/বিশ্বাস গুরুত্বপূর্ণ কিনা? অর্থাৎ, বে-নামাজী বাদ দিলাম, কাফির, যে আল্লাহকে বিশ্বাস করে না, তাকে কি খাওয়ানো যাবে? কাফিরকে কেউ যদি খাওয়ায়, এর প্রতিদানে সে সওয়াব আশা করতে পারে?

পবিত্র কুরআনের একটি সূরা আছে, যার নাম ‘সূরা আল-ইনসান’ (সূরাটির আরেক নাম- ‘সূরা আদ-দাহর’)। ‘আল-ইনসান’ অর্থ ‘মানুষ’। এই সূরায় আল্লাহ সাহাবীদের একটি গুণের প্রশংসা করেন। সেই গুণ হলো:

“তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকীন, ইয়াতীম ও বন্দীকে খাদ্য দান করে। তারা বলে, আমরা তো আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দ্যেশ্যে তোমাদেরকে খাদ্য দান করি। আমরা তোমাদের থেকে কোনো প্রতিদান চাই না।” [সূরা আল-ইনসান ৭৬:৮-৯]

 

সাহাবীদের যুগে বন্দী কারা? আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “ঐ সময় তো শুধু মুশরিকরাই (কাফির) বন্দী ছিলো।” [তাফসীরে কুরতুবি: ১৯/১২৯]

আয়াতটির সাধারণ স্টেটমেন্ট হওয়ায় ইমাম ইবনে জারির আত-তাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) এটাকে পছন্দ করেছেন এবং মুসলিম-মুশরিক সবাইকে এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। [তাফসীরে আত-তাবারী: ২৪/৯৮]

তিন.

যাকাতের অর্থ প্রদান করার জন্য পবিত্র কুরআনে ৮ শ্রেণীর লোকের কথা উল্লেখ আছে। তার মধ্যে এক শ্রেণী হলো ‘মুআল্লাফাতুল কুলুব’। এই খাতে যাকাত দেবার উদ্দেশ্য হলো মন জয় করা। অমুসলিমদের ইসলাম গ্রহণের জন্য উৎসাহ দিতে কিংবা নও-মুসলিমকে ইসলামের উপর অটল রাখতে এই খাতে যাকাত দেয়া হয়।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিভিন্ন সময় অমুসলিমদেরকে দান করেছেন, যাতে তারা ইসলাম গ্রহণ করে। যেমন: হুনাইনের যুদ্ধে প্রাপ্ত গণীমতের সম্পদের অংশ থেকে সাফওয়ান ইবনে উমাইয়াকে দেয়া হয়। তখনো তিনি কাফির ছিলেন। সাফওয়ান বলেন, “তাঁর দান ও সুবিচার আমার অন্তরে সবচেয়ে বেশি তাঁর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করেছিলো। অথচ ইতিপূর্বে তিনি ছিলেন আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ঘৃণিত।” পরবর্তীতে সাফওয়ান ইসলাম গ্রহণ করেন। রাদিয়াল্লাহু আনহু।

ইসলামের উপর অটল থাকার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হুনাইন যুদ্ধের গণীমত থেকে নও-মুসলিম সাহাবীকে একশো উট প্রদান করেন।
মানুষের মনে ইসলামের প্রতি ভালোবাসা জন্মানোর জন্য অমুসলিম এবং নও-মুসলিমকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দান করেছেন। সেখানে দান করতে গিয়ে বে-নামাজীকে মাইনাস করার অর্থ হলো দানের সাইকেল শুধুমাত্র মুসলিম কমিউনিটিতে প্রদক্ষিণ করানো। এটা যদি নর্ম হয়ে যায়, তাহলে অনেক্ষেত্রে এটা হবে- ‘তেল মাথায় তেল দেয়া’।

আপনি কল্পনা করুন, একটি মসজিদ কমিটি কিছু অর্থ জমালো দান করার জন্য। সেই অর্থ দেয়া হলো মসজিদের ইমাম সাহেবের হাতে। ইমাম সাহেবকে বলে দেয়া হলো- ‘জনাব ‘ক’ বেশ দরিদ্র, ঠিকমতো নামাজেও আসে না। শুধুমাত্র জুমুআর নামাজে পাওয়া যায়। পরবর্তী জুমুআর নামাজে সে আসলে তাকে এই ২০০০ টাকা দিবেন। আমাদের কথা বলবেন না।”

এক জুমুআয় জনাব ‘ক’ নামাজ পড়ে যাবার সময় ইমাম সাহেব ডাকলেন। হুজরায় নিয়ে গিয়ে তার সাথে খোশগল্প করলেন, পরিবার, কাজের খবর নিলেন। যাবার সময় একটি খামে ২০০০ টাকা দিয়ে বললেন, ‘এগুলো রাখুন। মাঝেমধ্যে হুজরায় আসবেন, আমরা গল্প করবো’। তাকে ‘নামাজ পড়ুন’ বলার দরকার নেই। শুধু হুজুর যদি তার সাথে সম্পর্ক জুড়ে দেন, সে এমনিতেই নামাজ পড়া শুরু করে দিবে। সে হুজুরকে ভরসার পাত্র মনে করলে, হুজুর কলে-কৌশলে তার মধ্যে ইসলামের বেসিক বিষয় শেখাতে পারবেন।

এসবের জন্য দরকার উদ্যোগ, মানুষকে কাছে টেনে নেবার মানসিকতা। আমরা কল্পনার জগতে বসবাস করে ভাবি- সবাই ঠিক হয়ে যাবে। বাস্তবতা এড়িয়ে গিয়ে কল্পজগতে বাস করলে বাস্তব জগতের মানুষের সাথে আমাদের সম্পর্ক গড়ে উঠে না। নিজেদের স্বার্থে আমরা তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চাই, দূরে সরিয়ে রাখতে চাই।

যেকোনো মানুষের আচরণ দেখে আমার প্রথমেই প্রশ্ন জাগে- এমন ব্যবহার কি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) করতেন? ধরুন, ঐ ‘মানুষ’ কবিতার মোল্লার আচরণ। নামাজ পড়ে না বলে তিনি যেমন মুসাফিরকে সিন্নি না দিয়ে তাড়িয়ে দিলেন, ঐ জায়গায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলে কি এমনটা করতেন?

যেকনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের আচরণ যদি আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়, আমি মিলিয়ে নিই এই আচরণটি কি তার ব্যক্তিগত আচরণ নাকি ইসলামি আচরণ? ইসলামি লিবাস গায়ে জড়ালেই তার ভেতরটা সবসময় ইসলামি হয় না। বহু মানুষের বাহ্যিক আবরণে ইসলাম আছে, ভেতরে নেই। অন্যদিকে অনেকের বাহ্যিক আবরণে ইসলাম নেই, ভেতরে ইসলামি মূল্যবোধ আছে।

লেখকঃ সাহিত্যিক ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন