মোঃ ইব্রাহীম খলিল
দিনাজপুর গনেশতলায় বটবৃক্ষের তলে চা দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম বেলা তিনটার সময় রাস্তা দিয়ে আধা ময়লা স্কুলের পোষাক পরা নয় দশ বছরের ছোট একটি বাচ্চা একা একা হেঁটে যাচ্ছে। আমি তার দিকে তাকাতেই ছেলেটি রাস্তা ছেড়ে আস্তে আস্তে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া, এই রাস্তায় বাসের হাট যাওয়া যাইবো?
— যাওয়া যাইবো, বাসের হাট কই যাইবা? — কালু ফকিরের বস্তি।
— এদিকে কই গেছিলা?
— পরীক্ষা দিবার।
— কই পরীক্ষা দিলা?
— ওই হাই স্কুলে।
— কি পরীক্ষা দিলা?
— ক্লাস ফাইভে সেন্টার পরীক্ষা।
— সাথে কেউ নাই।
— না।
— সকালে কার সাথে আইছো?
— নানীর সাথে।
— এহন নানী আইসে নাই?
— না।
— ক্যান, আইসে নাই ক্যান?
— নানী সকালে কইছিল আইবো, এহন তিনটা বাজে তাও আইল না। তাই একলা একলা রওনা দিছি।
— তোমার আর কেউ নাই?
— না।
— বাবা মা নাই?
— না।
— তারা কই থাকে?
— তারা তো গাড়ী এক্সিডেন্টে দুই বছর হইল মইরা গেছে।
— এহন কার কাছে থাকো?
— নানীর কাছে।
— নানী আইলো না ক্যান?
— নানী মৌংলা চৌকিদারের বাড়ি কাম করে, মনে হয় ছুটি পায় নাই।
— তোমার মামা, খালা নাই?
— খালা নাই, দুইজন মামা আছে।
— তারা কই থাকে?
— ওই কালুর বস্তিতেই থাকে।
— তারা আইলো না?
— তারা তো রাইস মিলে চাকরী করে, আইবো কেমনে?
— তোমার মামারা বিয়া করছে?
— হ, মামারা দুই জনেই বিয়া করছে।
— মামীরা কি করে?
— মামীরাও রাইস মিলে চাকরী করে।
— তোমার নানী কি মামাদের কাছে থাকে?
— আগে মামারা নানীর সাথে আছিল, বিয়া করার পর এহন আলাদা খায়।
— ক্যান, আলাদা খায় ক্যান?
— নানী আমারে কাছে রাখে দেইখা মামীরা নানীরে দেখবার পারে না। আমারে ফালায়া দিবার কয়। দুইজনরে ভাত দিব না, বলেই ছেলেটি থেমে যায়। আমি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, তারপরে? — তারপরে নানীরে দুইদিন না খায়া রাখছিল, ভাত দেয় নাই। নানীর সাথে আমিও না খায়া আছিলাম। ক্ষিদা কুলাইবার না পাইরা আমি কান্দাকাটি শুরু করলে নানী দিশামিশা না পাইয়া চৌকিদার বাড়ি গিয়া কামে লাগে। চৌকিদার বাড়ি কাম কইরা যা পায় তাই নানী অর্ধেক খায় আমারে অর্ধেক দেয়।
— তোমার নানীরে যে মামীরা ভাত দেয় না মামারা কিছু কয় না?
— মামারা কইবো কি? মামারাও মামীদের কথায় উঠে বসে। নানীর কোন খোঁজ খবর নেয় না। নানী হেই দুঃখে কত কান্দে। ছেলেটি যে অসহায়, নিজের যে কত দুঃখ সে দিকে তার খেয়াল নেই, নানী যে কষ্টে আছে সেই দুঃখে সে দুঃখিত। ছোট্ট ছেলের মুখে নিজের কষ্ট না বলে নানীর কষ্টের কথা বলায় আমার মনটা ব্যাথিত হলো। ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি মুখটি শুকনা। ছোট মানুষ, না খাওয়া মুখ দেখলেই বোঝা যায়। আমার কিছুটা মায়া লাগল। নিজের থেকেই জিজ্ঞেস করলাম, সকাল বেলা কি খাইছো?
— রাইতে খাওয়ার পরে অল্প কিছু ভাত নানী পানি দিয়া রাখছিল, পরীক্ষা দিবার আসার সময় হেই বাসি ভাত খাইছি।
— দুপুরে কিছু খাও নাই? — না — নানী ট্যাকা দেয় নাই?
— নানী যাওয়ার সময় দুই ট্যাকা দিযা গ্যাছে। পরীক্ষা শেষে চানাচুরওয়ালারে কইলাম, আঙ্কেল দুই টাকার চানাচুর দিবেন? চানাচুর ওয়ালা কয়, পাঁচ ট্যাকার নিচে চানাচুর নাই। তিনবার কইছি দেইখা চানাচুর তো দিলোই না, উল্টা আমার ঘাড় ধইরা ধাক্কা দিয়া রাস্তায় উপর ফালায়া দিল। অল্পের থিকা মুখ ঠাসি দিয়া পড়ি নাই। পড়লে নাক মুখ ফাইটা যাইতো। চানাচুরওয়ালা ঘাড় ধাক্কা দিল দেইখা আর কারো কাছে কিছু চাই নাই। ক্ষিদার চোটে স্কুলের চাপকলে পেট ভইরা পানি খাইছি। ছেলেটির কথা শুনে আমার চোখে পানি চলে এলো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, কিছু খাইবা? খাওয়ার কথা শুনে ক্ষুধার্ত মুখটি কালো করে বলল, বাসায় না গেলে তো আর খাওয়া হইবো না ! দুই ট্যাকায় কেউ কিছু দিব না। তার চায়া দুই ট্যাকা নিয়া নানীর কাছে দিলে, নানী লবন মরিচ কিনতে পারবো। কথাগুলো বলেই বলল, আচ্ছা আঙ্কেল, বাসেরহাট এহান থিকা কতদূর? এক ঘন্টায় যাইতে পারমু? বড়দের একঘন্টা লাগে না। কিন্তু ছোট মানুষ এক ঘন্টায় যেতে পারবে কিনা সন্দেহ। তারপরেও উৎসাহ দিয়ে আমি বললাম, হ যাইতে পারবা। তোমার বাড়ি যাওয়ার রাস্তা তুমি চিনবা?
— হ ভাইয়া, টার্মিনাল চৌরাস্তায় গেলেই চিনমু। চৌরাস্তা থিকা ওইদিকের রাস্তা চিনি। এই দিকের রাস্তা চিনি না। এই দিকে কোনো দিন আসি নাই। আমি ছেলেটিকে অভয় দিয়ে বললাম, অসুবিধা নাই, এই রাস্তা দিয়া সোজা গেলেই চৌরাস্তা পাইবা। সোজা গেলে চৌরাস্তা পাবে এমন আশ্বাস পেয়ে ছেলেটির মুখ উজ্জল হয়ে উঠল, খুশি খুশি ভাব নিয়ে বলল, চৌরাস্তা গেলে আমার আর অসুবিধা হইবো না, বলেই বলল, আচ্ছা ভাইয়া, আসি। ছেলেটি বিদায় চাইলে আমিও ঘাড় কাত করে ছেলেটিকে বিদায় দিলাম। একটু পরেই হুশ হলো। আরে– আমার কাছে তো টাকা আছে। দু’টি বিস্কুট কিংবা পাউরুটি কিনে দিলেও তো ছেলেটি খেয়ে পানি খেতে পারে। এতটুকু ছেলে না খেয়ে আছে। একথা মনে হতেই হাত বাড়িয়ে ছেলেটিকে ডাকলাম। এ–ই ছেলে, এ–ই ছেলে। ছেলেটি তখন অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। ছেলেটি ডাক শুনে ফিরে তাকাল, ভাইয়া আমাকে ডাকছেন? আমি বললাম, হ, এই দিকে আস। — না ভাইয়া, আর দেরি করমু না। ক্ষিদা লাগছে, তাড়াতাড়ি বাড়ি যাই। আমি আদর মাখা কণ্ঠে বললাম, এই দিকে আস, আমার কাছে আস।
— না ভাইয়া, তাড়াতাড়ি বাড়ি যাই। দেরি করলে নানী আবার খুঁজতে আইবো। ছেলেটি আমার কথায় আসতেছে না দেখে একটু ধমকের সুরেই বললাম, এ–ই ছেলে আমি ডাকতেছি না। এই দিকে আস। ছেলেটি অগত্যা অনিচ্ছা সত্বেও এগিয়ে এলো। এসেই জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া কিছু কইবেন?
— হ কমু। আমার পাশে বস।
— না ভাইয়া এমনিই দেরি হইছে। ক্ষিদা লাগছে। তাড়াতাড়ি যাই। আমি আরেকটা ধমক দিয়ে বললাম, আমি কইছি বস। আমার ধমকে ছেলেটি থতমত খেয়ে মুখটি কাচুমাচু করে বেঞ্চের উপর বসল। আমি বটতলার দোকান থেকে এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে ছেলেটির হাতে দিলাম। ছেলেটি নিতে চাচ্ছে না। বলছে, ভাইয়া, এই বিস্কুটের দাম তো দশ ট্যাকা, আমার কাছে দুই ট্যাকার বেশি নাই। বাকি আটট্যাকা দিমু কোইত্থিকা?
— ট্যাকা লাগবো না।
— তাইলে কি কাম করা লাগবো। ভাইয়া আইজ আমি কাম করবার পারমু না। কাম করলে কাইলকা পরীক্ষা দিবার পারমু না। — তোমার কোন কাজ করা লাগবো না। এমনিই খাইতে দিলাম। ছেলেটির ধরা গলায় বলল, ভাইয়া, বাপ মা মরার পর থিকা আমারে কেউ এমনি এমনি খাইতে দেয় না, কিছু না কিছু কাম কইরা নেয়। আপনি আবার ফাঁকি দিয়া খাওয়ায়া কামে লাগাইবেন না তো? ছেলেটির কথায় আমার চোখ আবার ভিজে গেল। চোখের পানি মুছে ছেলেটির কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, না রে খোকা, আমি তোরে দিয়া কাম করামু না, তুই নিশ্চিন্তায় খা।
— ভাইয়া এইখানে বইসা খাইলে তো সন্ধা লাগবো। সন্ধা লাগলে বাড়ি যাইবার পারমু না। আমি ছেলেটির মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে বললাম, অসুবিধা নাই, আমি তোরে বাড়ি পৌছায়া দিয়া আসমু। আমার দরদ মাখা কন্ঠে বাড়ি পৌছানোর আশ্বাস পেয়ে ছেলেটি প্যাকেট খুলে বিস্কুট মুখে দিল। দু’টি বিস্কুট খেতেই আধাপুরানো ময়লা শাড়ি পরা বৃদ্ধাকে রাস্তা দিয়ে হনহন করে হেঁটে যেতে দেখে ছেলেটি লাফিয়ে উঠল। এই তো নানী আইছে। বলেই ডাক দিল, ও–ই নানী, ও—ই নানী। ডাক শুনে বৃদ্ধা থমকে দাঁড়াল। পিছন ফিরে ছেলেটিকে দেখেই দ্রুত কাছে চলে এলো। কাছে এসেই ঠাস করে গালে একটি চড় মেড়ে দাঁত কিড়মিড় করে বকাবকি শুরু করল, মরার ঘরের মরা, এই হানে চুপচাপ বইসা রইছস, আর আমি দুইন্নাডা খুঁইজা মরতাছি। দুইজন তো মইরা বাইচা গ্যাছে। তরে রাইখা গ্যাছে না আমার ঘাড়ে আজাব রাইখা গ্যাছে। তর জন্যে আইজ বুইড়া বয়সে মাইনষের বাড়ি কাম কইরা খাই। হারামজাদা, দুইন্নার বেবাক পোলাপান বাড়ি গ্যাছে, আর তুই এইহানে বইসা খোস গল্প করতাছোস। তোর জ্বালায় আমার জানডা শেষ হইল, বলেই ছেলেটির হাত ধরে হেঁচকা টান মেরে বেঞ্চ থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। বৃদ্ধার হেঁচকা টানে ছেলেটির হাত থেকে বিস্কুটের প্যাকেট ছিটকে পড়ে গেল। পড়ে যাওয়া বিস্কুট মাটি থেকে তুলে নিয়ে আমি পিছন থেকে ডাক দিয়ে বৃদ্ধাকে থামানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু বৃদ্ধা কোন কথাই কানে নিল না। সে ছেলেটিকে বকাবাকি করতে করতে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল। বাপ মা হারা ছেলেটির অসহায়ত্ব দেখে আমার খুব মায়া লাগল। চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত ছেলেটির দিকে একপলকে তাকিয়ে রইলাম।
লেখকঃ সাহিত্যিক