Ads

বোরখা পরা নিষেধ !

খাদিজা ইয়াছমিন 

বলছি ইন্টারমিডিয়েট সময়ের কথা। খুব আনন্দ খুশি নিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম এবং কলেজেরই হলে উঠলাম। কলেজটি আমাদের জেলার মধ্যে বেশ নামকরা একটি প্রাইভেট কলেজ,উল্লাপাড়া বিজ্ঞান কলেজ। আমাদের হলে ১২৪ জন মেয়ে কাউকেই চিনিনা। পরে দেখি এক স্কুল ফ্রেন্ড ভর্তি হয়েছে এবং আমারই হলে সিট পেয়েছে কিন্তু রুম ভিন্ন। তাতে কি একজন তো পরিচিত আছে, হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

এই প্রথম বাড়ীর বাইরে এসে থাকা। প্রথম দিনেই বুকের মধ্যে কেমন খারাপ লাগছিলো। আব্বা মা’র কথা মনে পড়ছিলো। আমার টেবিলের পাশে একটা জানালা ছিলো মন খারাপ হলেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতাম। অবশ্য আমার রুমে এক ব্যাচমেট ও অন্য সিনিয়র আপুরা অনেক হেল্পফুল ও আন্তরিক ছিলো। একরুমে আমরা ছয়জন থাকতাম।

প্রথম দিন ক্লাসে যাচ্ছি অন্যরকম একটা অনুভুতি। বুকের মধ্যে অস্থিরতা, ধুঁকপুঁক,একরকম আনন্দ নিয়ে কলেজের গেটে উপস্থিত হতেই দেখি ভেতরে সব স্যার ম্যাডামরা সারি করে দাঁড়িয়ে আছে! বাচ্চাদের ইউনিফর্ম চেকরার জন্য। রুলস অনুযায়ী পড়েছে কিনা সেটা দেখার জন্য। একে একে সবাই চলে গেলো আমরা কয়েকজন আটকে গেলাম রুলস ব্রেক করার জন্য। রুলস ব্রেকটা কি আমরা ইউনিফর্ম পড়েছি ঠিকই কিন্তু উপরে বোরখা পড়েছি এটা তাদের পছন্দ হলোনা। কিছুক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে যেতে দিলো কিন্তু কমন রুমে বোরখা খুলে ক্লাসে যেতে হবে। ক্লাসে বোরখা এলাউ নয়।
আমরা ছোটরা আর কি করতে পারি? তাই কমন রুমে বোরখা রেখে ক্লাস করতে লাগলাম। কিছুদিন যেতে না যেতেই গেটেই আটকে দিতে লাগলো বোরখা পড়ে ভেতরে প্রবেশ করা যাবেনা। যাস্ট ইউনিফর্ম পড়ে আসতে হবে। কি সমস্যায় পড়ে গেলাম আমরা! যদিও আমাদের হল কলেজের সাথেই ছিলো হয়তো ১-২ মিনিট লাগে যেতে!

স্যারদের সাথে কিছু বলি না ভয়ে, কিন্তু হলে এসে আপুদের সাথে রাগ করি কলেজ এমন কেন? বোরখা পরতে দিলে কি সমস্যা? সবাই তো মুসলিম! প্রয়োজনে সাদা বোরখা পড়বো। তবু অনুমতি দিতো যদি!

রিতা আপু বললো তোমরা তাও ভাগ্যবান অন্তত মাথায় হিজাব দিয়ে ক্লাস করতে পারছো। আগের প্রিন্সিপালের সময় ইউনিফর্মের উপর শুধু বেল্ট রাখা যেত কোন স্কার্ফও রাখতে দিতনা। শুকরিয়া করো বুচ্ছো! এই প্রিন্সিপাল একটু নরম আছে।খুব অবাক হলাম, তখনো শহুরে হালচাল জানিনা ওত! কেমন লজ্জা লাগতে লাগলো। এভাবেও সম্ভব! কিভাবে স্কার্ফ ছাড়া শুধু বেল্ট পড়ে ক্লাসে যেত?

আমাদের কলেজের ইউনিফর্ম ছিলো সাদা ফ্রগ,সালোয়ার, ছোট হাতা হতে হবে অবশ্যই। সাদা কেডস। কিছুদিন পর পর ক্লাসে এসে চেক করতো কেউ ইউনিফর্ম ছাড়া আছে নাকি,বড় হাতা দেখলে এলার্ট করে দিত।

আমাদের হলে আমরা ৫ জন ছিলাম যারা বোরখা পরতাম রেগুলার। অন্য হলেও কয়েকজন ছিলো। আমরা সবাই একটা বুদ্ধি করলাম যেহেতু সাদা বোরখাও এলাউ নয়, ফ্রগ তো ঢিলেঢালাই অনেকটা বোরখা টাইপেরই। এবং আমাদের ফ্রগগুলো বড় করে বানানো ছিলো। আমরা করলাম কি সাদা বড় ওড়না কিনে ওপর দিয়ে পড়ে কলেজে যাওয়া শুরু করলাম।

কিন্তু দুঃখ রয়েই গেলো ক্লাসে নেকাব করে থাকা যাবে না। আমরা ওপর দিয়ে ওড়না পড়তাম বলে আমাদের এরকম বেশভূষা দেখে পদার্থ বিজ্ঞানের স্যার পড়া জিজ্ঞেস করলেই বলতো এ ❝তালেবান❞পড়া বলো।

যেকোন কথাতেই আমরা হয়ে গেলাম তালেবান। যদিও স্যার মজা করে বলতো বুঝতে পারতাম। কারন স্যাররা আমাদের বেশ ভালোবাসতো। কলেজের রুলস তাই তারাও এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারতোনা।

এখন কথা হলো! এই কলেজ কিন্তু ঢাকা বা কোন বিভাগীয় শহরে নয়। একটি জেলার উপজেলার প্রাণক্রেন্দ্রে কলেজটি। এই যে আমরা বলি ৯০ ভাগ মুসলিমের দেশ বাংলাদেশ। আসলে কি আমরা প্রকৃত মুসলিম নাকি নামে মাত্র? আমাদের ফ্যামিলি শিক্ষাই বা কি? একটা কলেজে কত স্টুডেন্ট তার মধ্যে হিজাব পড়ে এরকম স্টুডেন্ট গোনা যেত অথচ ম্যাক্সিমামই মুসলিম।

যদি এমন হত ম্যাক্সিমাইমই হিজাব পরে, নন হিজাবী গোনা যায়, তাহলে কি কলেজ এত স্ট্রিক্ট নিয়ম করতে পারতো? বা আমাদের অভিভাবকেরা যদি সচেতন হত তাহলেও কি পারতো? আমাদের অভিভাবকেরা কি এ দায় এড়াতে পারে? আর সিস্টেম তো ঘুনে ধরাই।

কলেজ থেকে বিদায় নিয়েছি ২০১২ সালে। হয়তো এখন অনেক কিছুই চেঞ্জ হয়েছে। কিন্তু এই ❝বোরখা পরা নিষেধ ❞এটার কোন রদবদল হয়েছে কিনা জানি না। এখন আমার মনে হয় কত দূর্ভাগা আমরা, শতভাগ মুসলিমের দেশ এটা কিন্তু আমরা মানার দিক থেকে শতভাগ মুসলিম নই। নইলে একটা উপজেলার কলেজে এরকম নিয়ম সত্যিই ভাবিয়ে তোলে!!!

লেখকঃ সাহিত্যিক ও কলাম লেখক 

আরও পড়ুন