Ads

শিখন্ডী । একজন নিষ্পাপ বৃহন্নলার গল্প

শোয়াইব আহমদ

বনানীতে বাসটা থামতেই দুজন নারী কড়া সাজে বাসে উঠেই ঠাস ঠাস করে হাতে তালি দিয়েই টাকা চাইতে শুরু করলো। সাথে সাথে বুঝে গেলাম এরা নারী না হিজরা। এদের দেখলেই বিরক্ত আর ক্ষোভ তৈরী হয়। মনে মনে ওদের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে লাগলাম। কোন কাজ করবে না। এই ভাবে জোর করে টাকা তুলবে। এদের ব্রাশ ফায়ার করে মারা উচিৎ।

এসব যখন ভাবছি তখন ওদের একজন সামনে এসে ঠাস করে তালির শব্দ তুলে বললো, ” মামা টাকা দাও!”। আমিও বিরক্তি নিয়ে বলতে গেলাম, “হবে না” কিন্তু আমার কথা মুখেই থেকে গেলো। তা আর বের হলো না। হিজরাটাও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আর কোন কথা না বলে হনহনিয়ে বাস থেকে নেমে গেলো।

আমি কিছুক্ষণের জন্য কেমন স্তম্ভিত হয়ে রইলাম। ও কে? ও তো আসাদ! এটা মনে হতেই আমিও হুড়মুড় করে নেমে পড়লাম। এদিক ওদিক তাকাতেই দেখি দূরে চার পাঁচ জন হিজরা দাঁড়িয়ে আছে আর আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওদের কাছে যেতেই ওদের মধ্যে নেতা গোছের একজন আমার পথ রোধ করে দাঁড়ালো, “কি চাই, মামা?”
আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে বললাম, “আসাদ কোথায়, ওকে ডাকো?”
– এখানে আসাদ বলে কেউ নেই। আপনি এখান থেকে যান।
– অবশ্যই আছে। এতো বড় ভুল আমার হতে পারে না। সেই চোখ, সেই নাক। না, না, আসাদ অবশ্যই এখানে আছে। ওকে ডাকো।
– আপনি ভুল করছেন এখানে আসাদ নামে কেউ নেই।
আমিও নাছোড়বান্দা। ওদের সাথে তর্ক জুড়ে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের ঘিরে একটা জটলা তৈরী হয়ে গেলো।
– মামা, আপনি খামাখা ঝামেলা করতেসেন।
– কিসের ঝামেলা? আসাদকে ডাকো।
– মামা, পুলিশ আসতেসে।আপনি চলে যান। খামাখা ঝামেলা বাড়ায়েন না।
– পুলিশ আসলে আসুক, ঝামেলা হলে হোক তারপরও আমি আসাদের সাথে কথা না বলে যাবো না।

এমন সময় ওদের একজন নেতা তার কানে কানে কি যেন বললো।তারপরই নেতাটা আমার দিকে ফিরে বললো, ” এখন চলে যান, ঘন্টা খানেক পরে বনানী রেলস্টেশনের পিছনে আসেন।” এই কথা বলেই ওরা মুহূর্তে উধাও হয়ে গেলো। আমিও ভীড় থেকে বের হয়ে বনানী রেলস্টেশনের দিকে এগোতে থাকলাম। আজ আসাদের সাথে কথা না বলে আমি যাবো না।

আসাদ, আমার ছোট বেলার বন্ধু। ছোট বেলা বলতে একেবারেই ছোট বেলা। আমার মায়ের বান্ধবীর ছেলে আসাদ। আমাদের জন্ম নাকি একই দিনে হয়েছে। তাই আমাদের মায়েরা আমাদের দুজনকেই খুব ভালোবাসতো। আসাদ দেখতে হালকা পাতলা কিন্তু সুশ্রী ছিল। ওকে যে দেখতো, সেই পছন্দ করতো। আসাদের মা মিনু খালার কোন মেয়ে ছিল না। তাই ছোটবেলায় মাঝে মধ্যে উনি আসাদকে মেয়েদের সাজে সাজাতেন। এই নিয়ে মা আর মিনু খালা খুব মজা করতেন। প্রায়ই বলতেন, “আসাদ যে কেন মেয়ে হলো না! মেয়ে হলে কত ভালো হতো। সুন্দর করে সাজাতে পারতাম।” এই ভাবে হাসি আনন্দে দিন চলতে লাগলো এদিকে আমি আর আসাদও বড় হতে থাকলাম।

আমরা বড় হচ্ছি ঠিকই কিন্তু কোথায় যেন একটা ঘাপলা রয়ে গেলো। আসাদ আর চার পাঁচটা ছেলেদের মতো হলো না। ও যত বড় হতে লাগলো ওর মধ্যে নারী সুলভ আচরণ তত বাড়তে লাগলো। এ নিয়ে অশান্তিও চরমে।

মিনু খালা এখন মায়ের কাছে এসে কান্নাকাটি করেন, “আসাদ এরকম কেন হলো, মাজেদা? ওর বাবা সারাক্ষণ আমাকে বকাবকি করেন। আমি কি করবো! এই ছেলের জন্য ওর বাবা আমাকে তালাক দিতে চায়। আমি এখন কি করবো, মাজেদা?”

আমার মা মাজেদাও কিছুই বলতে পারেন না। উনিও শাড়ীর আঁচলে চোখ মুছেন। এদিকে আসাদের জীবনও হয়ে উঠেছে ভীষণ কণ্টকময়। স্কুলে যেতে পারে না। সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। হাসতে হাসতে কখনও কখনও আসাদকে মারধরও করে। স্কুলের শিক্ষকরাও আসাদকে নিয়ে মজা পায়। আসাদ না থাকতে পারে বাড়ীতে না যেতে পারে স্কুলে। তার যদি কথা বলার কোন জায়গা থাকে, সে জায়গা হলো আমি।

আসাদ মাঝে মধ্যে আমাকে জিজ্ঞেস করতো, ” আচ্ছা, বলতো আমি এমন কেন? আমি কেন তোদের মতো হতে পারি না?” আমি বলতাম,”ধৈর্য্য ধর আসাদ। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। একদিন দেখবি উনিই সব ঠিক করে দিয়েছেন”।  ও তখন বলতো “সবই যদি উনার ইচ্ছায় হয়, তাহলে এখানে আমার দায়টা কোথায়? আমাকে কেন এতো লাঞ্ছনা সহ্য করতে হচ্ছে?”

তখন আসলে আমি আর কিছুই বলতে পারতাম না। এইভাবেই চলছিল আমাদের দিন। কিন্তু সেবার খুব বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো। আসাদ তখন খুব একটা বাহিরে বের হতো না। স্কুলে যাওয়া ওর প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে আমাদের বাড়ীতে আসতো। আমি আর মা ছাড়া কেউ ওর সাথে কথা বলা তো দুরের কথা ভালো ব্যবহারই করতো না। সেদিন ও কথা বলতে বলতে আর কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল আর এটা আমার বড় জ্যাঠাতো ভাইয়ের চোখে পড়ে। উনি সাথে সাথে লোকজনকে জড় করে আমাদের গালাগাল করতে থাকেন এবং এক পর্যায়ে সকলে আসাদকে মারতে মারতে চেয়ারম্যানের বাড়ী নিয়ে যায়।

আমাকে নেয়নি, কারণ আমার বাবাও বেশ প্রভাবশালী। কিন্তু ঐ রাতেই চেয়ারম্যানের বাড়ীর উঠানে সালিশ বসে। এই পাপ আর মেনে নেওয়া যায় না। আসাদ এই গ্রামে পাপ ছড়াচ্ছে। তাই ওকে হয় মরতে হবে অথবা আজ রাতেই গ্রাম থেকে বের করে দিতে হবে। আমার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে আমার বাবা পরদিন সকালেই আমাদের নিয়ে শহরে চলে আসেন। এদিকে আসাদের কি হয়েছিল তা আর আমার জানা হয়না। আজ প্রায় দশ বছর পর আসাদকে এই রুপে দেখতে পেলাম।

“আসাদকে কেন দরকার? ” এই কথায় পিছনে ফিরে দেখি আসাদ দাঁড়িয়ে আছে তবে নারীর বেশে নয় পুরুষের স্বাভাবিক বেশে।
– তুই কেমন আছিস, আসাদ?
– আসাদ! আসাদ তো মরে গেছে। আসলে আসাদ বলেতে কেউ কোন দিন ছিলোই না। যে ছিলো না, তাকে খোঁজ করছেন কেন?
– তুই আমাকে আপনি করে বলছিস কেন আসাদ? আমি তোর বন্ধু বাবলা। আমাকে চিনতে পারিসনি?

– আমার কোন দিন কোন বন্ধু ছিল না। আমি তো মানুষই না। মানুষ তো হয় পুরুষ অথবা নারী। আমি তো কোনটার মধ্যেই পড়ি না। আমি যেহেতু মানুষ না, তাই আমার কোন বন্ধুও নেই।

– রাগ করে আছিস, না!
– কার উপরে রাগ, কিসের রাগ? সেই অধিকারও তো আমার নেই। কেন এসেছেন আপনি, চলে যান।
– তোর কাছে ক্ষমা চাইতে।
– ক্ষমা! কিসের ক্ষমা?
– আমি সেদিন তোকে বাঁচাতে পারিনি। আমি সেদিন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বাড়ীর প্রত্যেকে আমাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখছিল। সকাল হতে না হতেই বাবা আমাদের শহরে পাঠিয়ে দেয়। সেই থেকে এই শহরেই আছি। আমি আর গ্রামে যাইনি। তবে তোর খোঁজ করার চেষ্টা করেছি, পাইনি। কিছু আজ তোকে এই ভাবে দেখবো….!

বেশ কিছুক্ষণ আমি আর আসাদ চুপ করে থাকি। আসাদ মাটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর আমি ওর দিকে। আসাদ প্রথমে নিরাবতা ভেঙে বলে উঠলো, ” ঐ রাতে আমার কোন অস্তিত্বই ছিল না। কেউ আমার কথা শুনতে চায়নি। কেউ আমাকে কথা বলতে দেয়নি। সবার এক কথা, আমি গ্রামে পাপ ছড়াচ্ছি। গ্রামের যুবক ছেলেদের আমি খারাপ করছি। আমাকে মেরে ফেলতে হবে, তা-না হলে এই গ্রাম পাপ মুক্ত হবে না। আমার মায়ের কান্নাকাটি আর মাফ চাওয়াতে আমাকে আর প্রাণে মারে না। তবে সিদ্ধান্ত হয়, আমাকে এই এলাকা ছাড়তে হবে। এদিকে মা আমার হয়ে কথা বলায় বাবা মাকে ঐ আসরেই গালমন্দ করতে থাকে আর বলে মা যদি আমাকে ঘরে তোলে বা আমার সাথে কোন যোগাযোগ রাখে তাহলে বাবা মা কে তালাক দিবে। আমার ভাইয়েরা তো অনেক আগেই আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো। আমি কি করবো, কোথায় যাবো কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। চেয়ারম্যান সিদ্ধান্ত দিলো রাতটা ওর কাচারিতে কাটিয়ে আমি যেন সূর্যের আলো ফোঁটার আগেই এখান থেকে বেরিয়ে যাই। আমি চেয়ারম্যানের কাচারিতে বসে আছি। তখন রাত আনুমানিক একটা। চেয়ারম্যান কাচারিতে ঢুকে আমার দিকে হাসতে হাসতে বললো, “কি রে মাগি তুই নাকি খুব ভালো …… পারিস? তো হবে নাকি একদান। ” এই বলে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো চেয়ারম্যান। আমার বাধা দেওয়ার কোন শক্তি ছিল না। একসময় ক্লান্ত হয়ে চেয়ারম্যান আমার শরীরের উপর থেকে নেমে এলো। আমাকে বললো, “এই টাকা কয়টা রাখ আর ফজরের আজান দেওয়ার আগেই এখান থেকে বেরিয়ে যাবি।” আমি ফজরের আজান দেওয়ার আগেই বেরিয়ে আসি কিন্তু ঐ টাকাটা নেয়নি। আমি দিক শূন্য হয়ে হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় আমি ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ি। কোন জায়গা ঠিক চিনতে পারছিলাম না। এমন সময় এক মহিলা আমার পাশে এসে জিজ্ঞেস করলেন আমার নাম কি, কোথা থেকে এসেছি। উনার কণ্ঠ ছেলেদের মতো, চেহারাটাও ঠিক মেয়েদের মতো নয়। আমার জানি না কি হলো,

আমি উনাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলাম আর শুধু এতটুকুই বলতে পারলাম, “মা, আমি মরতে চাই।” উনি আমাকে বুকে টেনে নিলেন আর বললেন, ” মরবি কেন, বাঁচতে হবে তোকে।” আর তারপর থেকেই….. বলে ঠাস করে তালি দিলো আসাদ। তালির শব্দে আরও কয়েকজন হিজরা এসে ওর পাশে দাঁড়ালো।

আসাদ আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “এখান থেকে চলে যান। আর কখনোই আসাদের খোঁজ করতে আসবেন না, আসাদ মরে গেছে ।” এই বলে আসাদ আর ওর সাথীরা তালি দিতে দিতে কোথায় উধাও হয়ে গেলো। আমি হতভম্বের মতো ওখানে বসে রইলাম।

লেখকঃকবি ও সাহিত্যিক ও  এ্যডমিন, মহীয়সী প্যানেল।

আরও পড়ুন-

থার্ড জেন্ডার কেন অসামাজিক?

আরও পড়ুন