।। সাদিকুর রহমান খান ।।
শুনে চমকে উঠলাম। হাতে তখন আবু ইসহাকের পদ্মার পলিদ্বীপ। এক রাশ আতঙ্ক নিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি, হাফিজুর ভাই। আমার মুখে হাসি চলে আসে। হাফিজুর ভাই আর যাই হোক, বই পড়ার জন্য বাসায় বিচার দেবে না, আমি জানি। লাইব্রেরিতে জোরে কথা বলা যায় না। ফিসফিস করে বললাম, চলো বাইরে যাই। পড়তে বিরক্ত লাগতেসে।
রাজশাহী সেন্ট্রাল লাইব্রেরি নিউ ডিগ্রী কলেজের পাশেই। বহু পোলাপাইন এখানে বসে ফোন টিপতে আসে, প্রেম করতে আসে। আমি সত্যিকার অর্থেই বই পড়তে আসতাম। বই পাইলে আমার মাথা কোনকালেই ঠিক থাকতো না।
তবে হাফিজুর ভাই ছিলো বইয়ের চেয়েও ইন্টারেস্টিং। এলাকার বড় ভাই। কলেজের বড় ভাই। তবে রাজনীতি করতেন আমার উল্টোটা। আমি তখন অনিমেষ পড়ে বাংলাদেশে বা-ম বিপ্লবের স্বপ্ন দেখি। আর হাফিজুর ভাই শি-বির করে দেশে ইরানি স্টাইলে ইসলামি বি-প্লবের স্বপ্ন দেখেন।
কঠিন তর্ক করতাম সেই সময়। বেশিরভাগ সময়ই হাফিজুর ভাই আমার সাথে তর্কে হেরে যেতেন। তখন তো বুঝি নাই, এখন বুঝি উনি ইচ্ছা করে হারতেন আমাকে খুশি করার জন্য।
একবার কোনও এক কারণে স্কুল থেকে বাসায় আসবো। রিকশা নাই। হাফিজুর ভাই দেখে বললেন, ‘আমার সাইকেলে উঠো। দিয়ে আসি। আজকে ধর্মঘট। রিকশা পাবা না।’
ছোটবেলা থেকেই আমি নাদুস নুদুস। সেই আমাকে নিয়ে গ্রীষ্মের দুপুরে ভাই হাপাতে শুরু করলেন। থামলেন দুইবার। আমার খটকা লাগলো। ভাইয়ের শক্তি এতো কম কেন? বাসায় এসে দেখি আব্বুও আমাকে নিতে গেছে। আমি চলে এসেছি। আম্মু বললো, ‘কীভাবে এলি?’ আমি বললাম, ‘হাফিজুর ভাই এর সাইকেলে।’
আরও পড়ুন-
আম্মু আতকে উঠলো, ‘ওর সাইকেলে তুই উঠেছিস কেন? জানিস না ওর ক্যা-ন্সার?’
আমি কিছু বলি না। এতো হাসিখুশি মানুষেরও ক্যান্সা-র থাকে? কই কোনদিন বলেনাই তো? হাফিজুর ভাই মূলত ছিলেন লিউ-কোমিয়ার রোগী। তিনমাস পর পর রক্ত চেঞ্জ করতে হতো। অথচ এই লোকটা কত বড় অভিনেতা চিন্তা করেন, আমাদের কাউকে কখনও জানতে দেয় নাই।
এরপর ঐ লাইব্রেরির কাহিনী। লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে মালোপাড়ার দিকে একটা ঘর দেখালেন। বললেন, ‘কোচিং দিচ্ছি। তুমি তো সায়েন্স এ থাকবা, আর্টসে গেলে পড়তে পারতা।’
ভাই তখন পড়েন রাজশাহী ইউনিভার্সিটির পাবলিক এডমিনস্ট্রেশনে। আমি ভাবলাম, যাক। আড্ডার আর ঝগড়ার আরেকটা জায়গা আমাদের হলো। আমি যখনই বা-ম বিপ্লব নিয়ে কোন বই পড়তাম, ভাইকে বিপরীতে কল্পনা করতাম। কল্পনায় তাকে হারিয়ে দিয়ে বিরাট মজা পেতাম। এমনই একদিন হুট করে আব্বু এসে বললো শালবাগানে রাবির এক টিচার খুন হয়েছে।
সারাদেশে হইচই পড়ে গেল। আমরা আগ্রহ নিয়ে ওয়েট করতে শুরু করলাম। আব্বু বাজার না করেই চলে এসেছে। পরদিন আম্মু বললো ডিম নিয়ে আয় দোকান থেকে। আমি ডিম আনতে গেছি। দোকানে অনেক ভীড়। সম্ভবত বাংলাভিশনে বলা হলো, ‘রাবির টিচার হত্যা মামলায় হাফিজুর রহমান নামে একজনকে আটক করেছে পুলিশ।’

আমি বাসায় আসলাম দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে। আম্মুকে বললাম, ‘হাফিজুর ভাইকে পুলিশ ধরেছে।’ আম্মু বললো ধুর, ‘এইটা এই হাফিজুর না। অন্য হাফিজুর। যে ছেলে বড় গলায় একটা কথা বলতে পারে না, তারে পুলিশ কেন ধরবে?’
অথচ আম্মুর জানা ছিলো না, একটা মাছি না মারতে পারা মানুষকে সাধারণ পুলিশ ধরতে না পারলেও হাসিনার পুলিশ ধরতে পারে।
হাফিজুর ভাইয়ের বাবার ভাষ্য ছিলো, ‘ফজরের নামাজ পড়ে ভাই ঘুমাইছিলো। বাসা থেকেই ডিবি তারে তুলে নিয়ে যায়। ইভেন প্যান্ট পরার সুযোগ তারে দেওয়া হয়নি। টি শার্ট আর লুঙ্গি পরা অবস্থাতেই তাকে তুলে নেওয়া হয়। সবচে বড় কথা, একজন ক্যান্সারের রোগীকে ওষুধ নেওয়ার সুযোগও পুলিশ তাকে দেয় নাই।’
তাকে ৫ দিনের রিমান্ড দেওয়া হয়েছিলো যতদূর মনে পড়ে। দুইদিনের মাথায় অনেক চেষ্টা চরিত করে ভাইয়ের বড় ভাই ওষুধ নিয়ে সেলে যাইতে পারছিলেন। বাট তার আর দরকার হয় নাই। কারণ এর কিছুক্ষণ পরেই হাফিজুর ভাই পুলিশ হেফাজতে মারা যান। বড় ভাইয়ের কাছে অভিযোগ করেছিলেন, ‘তাকে ওষুধ দূরের কথা, পানিও খাইতে দেওয়া হয় নাই।’
হাফিজুর ভাইয়ের লাশ আসার পর অদ্ভুতভাবে বৃষ্টি নামলো। এলাকার সমস্ত মানুষ হাউমাউ করে কানতে লাগলো। আমার দাদির মৃত্যুর পরেও আব্বুরে আমি কানতে দেখিনি। অথচ সেইদিন আব্বুও পারলো না, ‘বললো, এই ছেলেটারেও এমনে মেরে ফেললো?’
আরও পড়ুন-
হাফিজুর ভাইয়ের বড় ভাই বললেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমাকে খুব জ্বালাইসে। তিন মাস পর পর রক্ত দিতে হতো, কত ঝামেলা। আমার আর কোন ঝামেলা থাকলো না। বলে শিশুর মতো কানতে লাগলেন।’
আমি দেখলাম, লাশ নিয়ে আসা পুলিশ সদস্যরা রুমাল দিয়ে চোখ মুছতেসে। এই মৃত্যুর পর এই পরিবারটাই তছনছ হয়ে গেল। ভাইয়ের বাবা স্ট্রোক করলেন, মা প্যারালাইজ হলেন। এতো জুলুম সহ্য করা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হয়নি, মানুষ কতই বা আর পারে?
রেজাউল করিম হত্যা মামলা নিয়ে সবার আগ্রহ শেষ হলেও আমার হয়নি। আমি শেষদিন পর্যন্ত এই মামলার খোঁজ খবর রেখেছি।
চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। অপরাধীদের সেই লিস্টে সম্ভবত সাতজনের নাম ছিলো। না, সেখানে হাফিজুর রহমান নামে কোন নাম ছিলো না। এর অর্থ হলো, ইভেন ‘হাসিনার বানানো করাপ্টেড কোর্টও এই মামলার সাথে তার নূন্যতম সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করতে পারেনি।’

তাহলে আমার হাফিজুর ভাইকে মরতে হলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর দূরের কথা, এই প্রশ্ন করার স্বাধীনতাও আমরা পাইনি কোনও দিন।
৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেকেরই অনেকের কথাই মনে পড়েছে। আমার মনে পড়েছে হাফিজুর ভাইয়ের কথা ।
‘কলেজ পালিয়ে যে বই পড়া হচ্ছে, বাসায় জানে?’
আমি খুব শক্ত ছেলে। অথচ যতবার এই কথাটা মনে পড়ে, আমি আর চোখ খোলা রাখতে পারি না।
হাফিজুর ভাই হিরো নন। ছিলেন না কোনও দিন। তিনি অনিমেষ ছিলেন না, ক্ষুদিরাম ছিলেন না, ছিলেন একজন ক্যান্সারের রোগী। সাধারণ রাজনীতি করা পাবলিক ইউনিভার্সিটির একজন সাধারণ ছাত্র।সেই মানুষটাকেও শেখ হাসিনা খুন করিয়েছিলেন। তাকে ওষুধ তো দূরের কথা, পানিও খাইতে দেওয়া হয়নি।
আজকাল বিকেলে বৃষ্টি হলেই হাফিজুর ভাই এর কথা মনে পড়ে খুব। মনে পড়ে, ক্যান্সার আক্রান্ত একটা হাসিখুশি মানুষ নিজের অসুস্থতা ভুলে একটা রুম নিয়েছিলো কোচিং সেন্টার চালাবে বলে। কিন্তু সেই কোচিংটা তিনি আর কখনও খুলতে পারেননি। ভয়ঙ্কর খুনি ড্রাকুলা হাসিনার কাছে থেকে রক্তশূন্য একজন লিউকোমিয়ার রোগীও ছাড়া পায়নি।
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে- [email protected] ও [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে । আসুন ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।