।। জান্নাতুল ফেরদৌস স্বর্না ।।
হঠাৎ বিকেলে বৃষ্টিতে ভিজেই আমার সঙ্গী ( স্বামী)কে সাথে নিয়ে চলে গেলাম ননদের বাসায়। ফিরতে ফিরতে মধ্য রাত। কোরবানির গরু ট্রাকগুলো আসতেছে, গরু নামাচ্ছে -সব মিলিয়ে বিশাল জ্যাম রাস্তায়।থেকে থেকে একটু গাড়ি চলছে।ক্লান্ত শরীর আর বিষন্ন মন,হঠাৎ বাসের জানালা দিয়ে তাকালাম। চক্ষুগোচর হলো খুব স্বাভাবিক এক দৃশ্য। রাস্তার দুপাশে গরুর হাট।কিন্তু এই স্বাভাবিকের ভিড়েও কিছু অস্বাভাবিক এবং হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য আমাকে ভিষণভাবে চিন্তিত করলো,আহতও করলো।
হঠাৎ চোখ পড়লো একটা খড়ের বস্তার বড় স্তুপ, সেখানে একটা লোক গুটিসুটি মেরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। বাস জ্যামে দাঁড়ানো। খুব খেয়াল করে দেখলাম লোকটাকে মশা ঘিরে ধরেছে। কিন্তু ক্লান্তির ঘুম। কোনো চেতনা নাই। আবার আরেকজনকে দেখলাম ভেজা কাঁদা রাস্তায় পলিথিন বিছিয়ে পায়ের কাছে একটা কয়েল ধরিয়ে ঘুমাচ্ছে। দুইজনকে দেখলাম সিগারেট খাচ্ছে, কিন্তু মনে হলো ঘুমে পড়ে যাবে। এরকম যে কতজন কে দেখলাম! তারা সবাই দূর-দূরান্ত থেকে গরু বিক্রির উদ্দেশ্যে ঢাকায় এসেছে।
এই ছোট্ট দর্শন থেকে আমার উপলব্ধি :পুরুষের জীবন যুদ্ধ
পুরুষ, এক অদৃশ্য সংগ্রামী, যিনি সংসারের অদৃশ্য বোঝা কাঁধে তুলে নেয়, প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্তে। ঘরের বাইরের যুদ্ধের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধও লড়তে হয় তাকে। শারীরিক অনেক জটিলতাও তাদের থাকে,সব কিছু সহ্য করেই তিনি সামনে এগিয়ে যান। তবে, একটা কথা মনে রাখা উচিত যে, পুরুষের এই শ্রম কখনোই একতরফা নয়। স্ত্রী, সন্তান, এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের একটু ভালো রাখার জন্য। কিন্তু সে কিছুই চায় না—শুধু একটু ভালবাসা, যত্ন, এবং স্নেহ।
পুরুষ সেও তো এক মানবিক সত্ত্বা। তারও রক্তমাংসের হৃদয়, তারও অনুভূতি আছে, তারও প্রয়োজন কিছুটা শিথিলতার, কিছুটা আশ্বাসের, কিছুটা স্নেহের। যখন তার পরিশ্রমের পরেও সে তার প্রাপ্য প্রশংসা বা সহানুভূতিটুকু পায় না, তখন তার মনে এক গভীর একাকীত্বের সৃষ্টি হয়। সে তার ভেতরে এক নিঃশব্দ কান্না নিয়ে বাঁচে, যার সূর কেউ শোনে না।
আরও পড়ুন-
কিন্তু অনেক সময় তার এই ত্যাগের মূল্য কেউ দেয় না। পরিবারের সদস্যরা তার সেই নিষ্ঠুর পরিশ্রম ও সংকটের প্রতি সচেতন হন না। তার অনুভূতি বুঝতে ব্যর্থ হন। দিনশেষে, পুরুষকে শুধু কার্যকারিতার পরিমাপেই দেখা হয়। কিন্তু, একটি সংসারে শুধু পুরুষের কাজ বা পরিশ্রমই মূখ্য নয়, তার মনোভাব এবং অনুভূতির গুরুত্বও অনেক বেশি। তাকে যথাযথ সম্মান, আদর এবং যত্ন দেওয়া উচিত, যেন সে না শুধু পুরুষ হিসেবে, বরং একজন মানবিক সত্তা হিসেবে তার জায়গা এবং মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
একজন পুরুষ যখন গৃহকর্মী, সন্তানদের বাবা কিংবা পরিবারের কর্তা,তখন সে তার কষ্টের কথা কখনো প্রকাশ করে না। সংসারের জন্য সে দীর্ঘ সময় কাজ করে, হয়তো নিজের স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পায় না। মনে রাখবেন, পুরুষরা ভিতরে ভিতরে মায়ার জন্য, স্নেহের জন্য, একটু মনোযোগের জন্য আকুল থাকে। তারা চাইতে পারে না, কিন্তু কখনো কখনো তারা প্রচন্ড ” আদুরে ভালবাসার অভাব” অনুভব করে, যা তাদের যন্ত্রণা দেয়,ব্যথিত করে তোলে। কেউ তাদের কষ্টের কথা জিজ্ঞেস করে না, কেউ জানতে চায় না, “তুমি কেমন আছো?” অথবা “তোমারও কি একটু বিশ্রাম প্রয়োজন?”
কিন্তু অধিকাংশ সময়েই স্ত্রী বা সন্তানরা তাকে শুধুমাত্র “উপার্জনকারী” হিসেবে দেখে। তারা জানে না, তারও প্রয়োজন একটুখানি প্রশংসা, একটুখানি যত্ন, অথবা ছোট্ট একটি “ধন্যবাদ” যা তাকে মনে করিয়ে দেবে যে, তার পরিশ্রম মূল্যবান। অথচ, পুরুষরা কখনোই এই অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে চায় না, কারণ আমাদের সমাজে পুরুষদের শক্তি, দৃঢ়তা, এবং আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। আমরা জানি না, তারা কতটা একা, কতটা ক্লান্ত, কতটা অবহেলিত—সব কিছু সহ্য করেও তারা সংসারের দায়িত্ব পালন করতে থাকে।
আরও পড়ুন-
আমার খুব কাছের দুজন মাহরাম পুরুষকে এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলাম।তারা সাবলীল ভাষায় তাদের অন্তরের কথাগুলো শেয়ার করলেন। ওনাদের কথা গুলো দিয়েই আমি এখানে অলঙ্কৃত করলাম।
“আমাদের জীবনের অনেকটা সময় কাটে নিজের কাজ, কর্তব্য আর দায়িত্বের মধ্যে। সেই কাজের সাথেই জড়িয়ে থাকে ক্লান্তি, অবসাদ, কিন্তু দিনশেষে যখন বাড়ি ফিরে আসি, তখন আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার থাকে একটি ছোট্ট স্পর্শ, একটু স্নেহের উপস্থিতি, আর একজন কাছের মানুষ যে আমাদের চাওয়া-পাওয়া এবং আমাদের চোখের ভাষা বুঝতে পারে। যখন শরীরটা একদম ক্লান্ত, মনটা একপ্রকার নিস্তেজ হয়ে পড়ে, তখন আমাদের সবচেয়ে বড় আশ্রয় সঙ্গীর উপস্থিতি। আমরা চাই, আমাদের প্রিয় মানুষটি যেন আমাদের চোখের আর মনের ভাষা বুঝে নেয়। যেন কোনো কথার প্রয়োজন না হয়, শুধু একটুখানি হাসিমুখে এসে পাশে বসে। সেই ছোট্ট কিছু মুহূর্তই আমাদের মনে প্রশান্তি নিয়ে আসে, আর মনে হয়— “হ্যাঁ, আমি একা নই, কেউ আছে,যে কিনা আমার ক্লান্তি বুঝতে পারে, যে আমার অনুভূতিগুলো গভীরভাবে অনুভব করে।”
পরিশেষে এসে বলতে চাই,নারীদের উচিত বাবা, ভাই,স্বামী, সন্তানের হৃদয়ের ভাষা আত্মস্থ করা।একজন পুরুষ শুধু উপার্জনের যন্ত্র নয়।তার ও আছে মানবিক সত্ত্বা।অতএব, কোনো নারীর দ্বারা যেনো এতটুকু কষ্ট না পায় তার প্রিয় মানুষটি(সমাজে ব্যতিক্রম পুরুষ আছে এবং থাকবে)।কিন্তু নারীদের উচিত পুরুষের প্রতি সর্ব্বোচ্চ নমনীয়, শ্রদ্ধাশীল, স্নেহময় এবং প্রেমময় আচরন করা।ভালো থাকুক আমাদের বাবা, ভাই, স্বামী, ছেলে সন্তানরা।
লেখকঃ গল্পকার ও কলাম লেখক
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল, আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেইজ মহীয়সী/Mohioshi-তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হ্যাঁ, মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইল-
[email protected] ও [email protected] -এ; মনে রাখবেন, “ধন দৌলত খরচ করলে কমে যায়, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়”। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনি জ্ঞান দান করেন।” (সহিহ বুখারী- ৭১, ৩১১৬, ৩৬৪১, ৭৩১২, ৭৪৬০; মুসলিম- ১০৩৭; ইবনে মাজাহ- ২২১) ।
মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম; আজই আপনি যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে। আসুন, ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি। আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমীন।