।। মাসরুর আনোয়ার চৌধূরী ।।
মোদি বিরোধী একটি স্ট্যাটাসের কারণে আয়নাঘরের মেহমান হয়েছিলেন মাসরুর আনোয়ার চৌধূরী । নতুন ওপেন হওয়া তেঁজগাতে একটি multinational hotel Chain এ Purchase Manager হিসবে জয়েন করার তৃতীয় মাস। ক্যারিয়ারের চার বছরের মধ্যেই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে Procurement Manager পদে সিক্স ডিজিট স্যালারিতে কর্মরত ছিলাম।
ক্যারিয়ার গ্রোথের পাশাপাশি আমার লিখালিখির একটা নেশা হয়ে যায়।প্রথম দিখে রম্য টাইপ লিখা লিখলেও, পরে আমার লিখালিখির বিষয় হয়ে উঠে আওয়ামীলীগের জুলুম অত্যাচার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ইসলাম বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে। ভয় ডর না করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লিখালিখির নেশা আমি কখনো ছাড়তে পারিনি শত ব্যাস্ততার মাঝেও!
২০২০ সাল, মোদীর আগমনের বিরুদ্ধে দেশ উত্তাল। তারই ধারাবাহিকতায়, ফেব্রুয়ারি এর শেষদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি বিরোধী একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। তাও দুই লাইনের। তারই ফলাফল, ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি আইনাঘরে যাত্রা …সে যাত্রার এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা আজ আপনাদের জানাবো।
সকাল ৮- ৮.৩০ মিনিটে রিকশা নিয়ে অফিসে রওনা দিলাম বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকার বাসা থেকে। হাতিরঝিল পুলিশ প্লাজার সামনে আসার পর আমার রিকশাকে আটকে দেয় একটি সাদা মাইক্রো, সাথে সাথে নেমে আসে পাঁচ ছয় জন সাদা পোশাক পরা ব্যাক্তি। আমাকে রিকশা থেকে নামিয়ে আমার সেই ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখিয়ে বলে আমার নাম মাসরুর কিনা, আমি বল্লাম ” হ্যাঁ ” সাথে সাথে আমার দুই পাশে দুইজন হাত ধরে মাইক্রোতে উঠার জন্য বলে, আমি আতঙ্কিত হয়ে বলতে থাকি “ভাই আমার দুইটা ছোট ছোট সন্তান, আপনারা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। “টিমের অফিসার তার RAB এর আইডিকার্ড দেখিয়ে বলেন, বুঝতেই তো পারছেন, আমরা কে? গাড়িতে উঠেন এখুনি, নাইলে শুট করবো।
আমি ভয়ে উঠে পড়ি। পেছনের সিটে উঠিয়ে আমার চোখ বেঁধে ফেলে, পেছনে হাত নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে দেয় সাথে সাথে।পেছনে অস্ত্র সস্ত্র দেখে আমি অনেক ভয় পেয়ে গেলাম। গাড়ি চলা শুরু করলো, আমার মোবাইল নিয়ে ফেলল, আমার ফেসবুক এ ঢুকে, বিভিন্ন পোস্ট নিয়ে কথা বলতে লাগলো তাচ্ছিল্যের সূরে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন স্যার? অফিসার জবাব দিলো, ‘তোমাকে তোমার অফিসে নিয়ে যাবো, জিজ্ঞাসাবাদ করবো কিছু। তারপরে ছেড়ে দেবো।’ আমি আর কিছু বললাম না।
আরও পড়ুন-
অফিসার বলা শুরু করলো “মাসরুর তুমি যদি আমরা যা জিজ্ঞাসা করি তার সত্য উত্তর দাও, তাহলে তোমাকে ছেড়ে দেবো। “এরপরে আমার সম্পর্কে, আমার পরিবার সম্পর্কে, ক্যারিয়ার নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকলো আর আমি গাড়িতেই সব উত্তর দিতে থাকলাম। এক ঘন্টা গাড়ি চলার পর দেখলাম গাড়ি থামলো। অফিসার ফোনে কথা বলছে নেমে, শুনতে পেলাম, তারা তিনশ ফিট আছে। তা শুনে আমার বুক ধুক করে উঠলো,কারণ তিনশ ফিটে অনেক ক্রস ফায়ার হয়েছে। আমি শিওর হয়ে গেলাম তারা আমাকে ক্রস ফায়ার দেবে। কালেমা পড়ে নিলাম, দোয়া পড়তে লাগলাম। এবং জোরে জোরে দোয়া ইউনূস পড়তে লাগলাম। সাথে সাথে চোখে ভেসে আসতে লাগলো আমার ছোট দুই সন্তানের ছবি, আমার মা বাবা, স্ত্রীর ছবি।
কিন্তু তারা আবারো গাড়ি চালানো শুরু করলো। পাশের একজন আমাকে বিভিন্ন আলেমের ওয়াজ শোনাতে লাগলো, মোবাইল দিয়ে। আর বলতে লাগলো, জিহাদি ওয়াজগুলো তো তোমার খুব প্রিয় তাই না?তোমরা তো জঙ্গি হতে চাও তাই না? আমি তখন রেগে গিয়ে বলি “ভাই এইসব আমাকে শোনাইতেসেন কেন? পারলে চোখ খুলে দেন!! এইরকম অমানবিকতা কেন করছেন? কি অপরাধ করেছি আমি? ”
তখন আমার ঘাড় চেপে ধরে বলে “চোপ শালা কথা বলবি না একটাও ।’ আমি চুপ মেরে যাই। আর এক ঘন্টা চালানোর পর আমাকে নামানো হয় গাড়ি থেকে ছোট একটা রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার চোখ আর হ্যান্ডকাপ খুলে দেয়া হয়। সে রুমে তিন ফিট উচু দেয়াল দেয়া পার্টিশান টয়লেট। পাশে শোয়ার বিছানা। মানে টয়লেট আর বিছানা এক সাথে।
তখন শীতকাল ছিলো, গায়ে একটা জ্যাকেট ছিলো। আমি জ্যাকেট খুলে, মুখের উপরে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আমি জানি না আমি ক্যামনে ঘুমিয়েছি। আল্লাহ তায়ালা যেন আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলেন সে দিন। ঘন্টাখানেক পর, পাশে একজনের কান্না শুনে ঘুম থেকে উঠে পড়ি। তাকে জিজ্ঞাসা করি, ভাই আপনাকেও কি তুলে এনেছে? সে কোন উত্তর দেয় না।
কিছুক্ষণ পর এক রক্ষী এসে আবার চোখ বন্ধ করে আমাকে নিয়ে যায় আরেক রুমে। চেয়ারে বসিয়ে, পা বাঁধা হয়, হাত বাঁধা হয়। আমি বুঝে নিলাম আমাকে টর্চার করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হঠাৎ করে লাঠি দিয়ে আমাকে পেঠাতে থাকে, দুই পাশ থেকে। আর বলে, তোর সাথে আর কে কে আছে, নাম বল। তোর সাথে তোর বাসার সামনে আড্ডা দেয়, চা খায় এরা কারা, নাম বল। আমি তখন দুইটা ভাইয়ের নাম বলি, যাদের সাথে আমি আড্ডা দিতাম অফিস শেষ করে।
নাম বলার পর ওরা আমাকে ফেসবুক থেকে ছবি বের করে, আমার চোখ খুলে ওদের ছবি দেখায় এবং জিজ্ঞাসা করে ওরাই তারা কিনা, সাথে ফোন নাম্বার নেয় আমার কাছ থেকে। আবার চোখ বন্ধ করে আমাকে সেলে নিয়ে আসে। আমি বলেছিলাম, আমার অনেক ক্ষিধা লেগেছে। তখন আমাকে একটি বন রুটি দিয়ে যায়। আর পানি খেতে বললো টয়লেটের কলের পানি থেকে। আমি খেয়ে নিলাম। কারারক্ষীকে অনুরোধ করলাম আমাকে একটা কোরআন দিতে। সে একটি কোরআন দিয়ে যায়, আমি সারাদিন নামাজ পড়লাম, কান্না করে করে, চিৎকার করে কোরআন পড়তে থাকলাম! আমাকে এসে হুমকি দিয়ে গেলো যাতে আস্তে পড়ি।
আরও পড়ুন-
একিই দিন মধ্যরাতে আমাকে আবারো ইন্টারোগেশনে নিয়ে আসা হয়! আবারো জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকলো। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চ্যারিটির কাজ করেছিলাম সেসব নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবার করা হলো।আমাকে জঙ্গি দলের সাথে সম্পৃক্ততা থাকা স্বীকার করতে বলল। আবারো কিছু নাম বলতে বলল। আমি বললাম আমি কোন রাজনীতি করি নাই, কোন দল করি নাই। তাই কোন নাম বলতে আমি পারবো না। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আমাকে আবারো ফিরিয়ে আনা হলো সেলে।
পরের দিন! চোখ, হাত বেঁধে ফেলা হলো। আবারো একটা গাড়িতে তোলা হলো। গাড়ি চলতে লাগলো এক অজানা গন্তব্যে।এবং এবারো শিওর হয়ে গেলাম আমাকে ক্রস ফায়ার দিতে নিয়ে যাচ্ছে। আমি পেছনের সিটে বসে হেলান দিয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম কোথায় যাচ্ছি আমরা। এক ঘন্টা পর গাড়ি এসে থামলে আমি পিলার সাইনবোর্ড এ লিখা দেখি “RAB হেডকোয়াটার” বাংলাতে লিখা।
একজন RAB সদস্য বুঝে ফেলে আমি দেখছি সবকিছু, সে সাথে বলে উঠলো, ‘এই এই ও তো সব দেখছে !!’ সাথে পাশে থাকা সদস্য আমার চোখের বাঁধন টাইট করে দেয়। আরে নিচে টিস্যু ঢুকিয়ে দেয়। তারা আমাকে ধরে সিড়ি বেয়ে উপরে নিয়ে যায়। উপরে নিয়ে চোখ আর হাত খুলে দিলে দেখতে পাই, একটা অন্ধকার রুম চারপাশে কালো কাপড়। মাথা নিচু করে থাকতে বলল লাঠি দিয়ে গুঁতো দিয়ে। আর এক প্লেট ভাত এনে দিলো, সাথে এক টুকরো বিস্বাদ মাছ। বলল সব ভাত খাবি, আর খাওয়ার পর হাত ধুয়ে সে পানি গিলবি!! আমি বললাম আমি খেতে পারবো না এই ভাত। তারা কয়েকবার জোর করলো, আমি খেতে পারি নাই। পরে এক গ্লাস পানি খেলাম।
ঐ রুমেই কিছুক্ষণ আমাকে বসিয়ে রেখে, এক সেট কাপড় দিলো, লুঙ্গি আর টি শার্ট।কাপড় চ্যান্জ করে সেগুলো পড়তে বল্লো।আমি পরে নিলাম। আবার চোখ বেঁধে, হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে একটা অন্ধকার সেলের দরজা খুলে আমাকে ফেলে গেলো। আর বলে গেলো, যাতে নাড়াচাড়া না করি। কোন আওয়াজ না করি। আমার হাত পেঁছন থেকে হ্যান্ডকাফ, খুব টাইট করে বাঁধা ছিলো। বল্লাম ভাই আমার হাত কেটে যাচ্ছে। প্লিজ একটু ঢিল দেন।রক্ষী ঢিল করে দিলো।
এবার আমি শুয়ে শুয়ে কান্না করতে থাকি। শুনশান নিরবতার মধ্যে বিপরীত থেকে কে যেনো শশশশ করে আওয়াজ করছে। আমি আবারো চোখের নিচ দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম। করিডোর দিয়ে আসা হালকা আলোতে দেখলাম আমার ঠিক বিপরীত এ একজন হাত নাড়ছেন। আমি উঠে বসলাম এবার। বুঝতে পারলাম আমার মত কোন এক হতভাগা। এবার সে আমাকে ইশারাতে শিখিয়ে দিলো, পেছন থেকে হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় কিভাবে হাত সামনে আনতে হয়। আমি পায়ের নিচ দিয়ে হাত সামনে আনলাম। সাথে চোখের বাধনটা উপরে উঠালাম।তিনি এও বলে দিলেন, সে কাশি দিলেই যাতে আবার আগের মত চোখের বাধন বন্ধ করে দিয়। হাত পেছনে নিয়ে। কারণ ওরা যদি বুঝতে পারে আমি চোখ খুলেছি, তাহলে প্রচুর মারবে।
আস্তে আস্তে দেখতে পেলাম আমার অপজিটে চারটা সেলে চার জন। আর আমার দুই পাশে আছে দুইজন, কিন্তু তাদের আমি দেখতে পাইনি। বিপরীত এর সে ভাই আমাকে মেন্টাল সাপোর্ট দেয়া শুরু করলেন। তিনি আমাকে শান্ত হতে বলেন, ধৈর্য ধরার নসিহা করেন।
আর বলেন সবকিছু ভুলে এক আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতে। আল্লাহ তায়ালাই সেইভ করবেন। তিনি এই সব কিছুই ইশারা আর ফিশ ফিশ করে মুখ নেড়ে আমাকে বলতে থাকেন। অনেক সময় অনেক কথা বুঝতাম না। তখন দেয়ালে হাতের ইশারায় লিখে বুঝাতে চেষ্টা করেন। কিছু বুঝতাম, কিছু বুঝতাম না।
এক ভাইকে কাতার থেকে আসার পর এয়ারপোর্ট থেকে তুলে আনা হয়। আরেক ভাই বয়স ১৭-১৮ বছর মাত্র, তাকেও চট্টগ্রাম থেকে তুলে এনে সেখানে রাখা হয়। ১৭ -১৮ বছরের ছেলেটা এত শান্ত, এত নিরীহ। ওল্টা সে আমাকে মুরুব্বির মত শান্তনা দিচ্ছিলো, যখন আমাকে দেখতো আমি হতাশ হয়ে পড়ছি। কান্না করছি। পাশের আরো দুইজন ভাই ,একজন ভোলা থেকে। অন্যজনদের গুলো খেয়াল নেই। আরেকজন ছিলো, যে হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার করে উঠতো, ভয়ঙ্কর চেহেরার কিছু রক্ষী তাকে গরুর মত পেটাতো। পিটা খেয়ে সে ভয়ঙ্কর করুণ সূরে কান্না করতো।
আরও পড়ুন-
ওরে চলে যাওয়ার পর আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন তাকে মারে। এক ভাই বল্লেন মার খেতে খেতে সে পাগল হয়ে গেছে, এবং ল্যাংটা থাকে। তাই মারে। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলাম তারা এইখানে কত দিন ধরে। কেও বলে তিন বছর, কেও বলে দুই বছর, জিজ্ঞাসা করলাম মিনিমাম কতদিন রাখে এইখানে।তারা বল্লো এক, দুই বছর!!
আমি সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে বিশ্বাস করে নিলাম আমি আর হইতো বের হতে পারবো না। আমার বাবা মা, আত্মীয়স্বজন কখনো জানবে না আমি মরে গেছি নাকি বেচে আছি। আমার ছোট দুই সন্তাকে খুব মনে পড়তে থাকে। আমার মা বাবা আর স্ত্রীর কান্নামাখা মুখ বার বার মনে পড়ছিলো। আমি জিকির করতে থাকি, নামাজ পড়তে থাকি!আর মাঝে সুযোগ পেলে অন্য বন্ধিদের সাথে কথা বলতে থাকি! এভাবেই এদিনটি কেটে যায়।
বাই দ্যা ওয়ে সেলের একটু বর্ণনা দিচ্ছি। আপনারা যে আয়নাঘর নামের ঘরগুলো দেখছেন, তার চাইতেও নোংরা অন্ধকার সেল ছিলো সেগুলো। সূর্যের আলোও আসতো না।সবসময় রাত হয়ে থাকতো। আজান হলে রক্ষীরা এসে বলে যেতো কোন ওয়াক্তের নামাজ। ওযু টয়লেট গোসল করার জন্য পাঁচ মিনিট টাইম নির্দিষ্ট করা থাকতো। তারা এসে হাত ধরে টয়লেট করতে নিয়ে যেতো, আবারো টয়লেট শেষ হলে তারা ধরে এনে সেলে ঢুকিয়ে দিতো। এমনকি টয়লেটের দরজা পুরো বন্ধ করা যেতো না। তারা দেখে থাকতো কি করছি।
পরের দিন সকালে আমাকে সেল থেকে বের করে আরেকটা রুমে নিয়ে ইন্টারোগেশন শুরু করলো। এবার তিন চারজন ইন্টারোগেইট করলো ভিন্ন ভিন্ন কন্ঠ তাই মনে হলো। সেইম প্রশ্ন, আমিও সেইম উত্তর দিই। তারা বিরক্ত হয়ে আমাকে পেটাতে থাকে। আমি কান্না করে বল্লাম ভাই আমি কি বানিয়ে বানিয়ে বলবো। আমাকে পাশ থেকে ফিস ফিস করে একজন বল্লো তোকে এইবার আরো কঠিন শাস্তি দেবো, কিছু নাম বল। ছেড়ে দেবো। আমি বলি, আমি কাউকেই চিনিনা। শেষে আমার ফেসবুক ম্যাসেন্জারের আইডি ধরে ধরে জিজ্ঞাসা করছিলো। তারা হতাশ হলো কোন সন্তুষ্টজনক উত্তর না পেয়ে। ওরা কোন উত্তর না পেয়ে আমাকে আবারো সেই অন্ধকার সেলে নিয়ে এলো।
অতঃপর এভাবেই কেটে যায় দিন রাত, ইন্টারোগেশন, আবারো সেলে। আমাদের ভাত দেয়া হতো, যেগুলো ছিলো বিস্বাধ, খাওয়ার পরে হাতে ধূয়ে প্লেটের পানিগুলো খেতে হতো!! প্লেট পরিস্কার করেই ফেরত দিতে হতো। সকালে নাস্তাগুলোও ছিলো নিকৃষ্ট। এরপর সাত আটদিন পর একদিন একজন রক্ষী এসে আমাকে, আমার কাপড়চোপড় দিয়ে বলে, এগুলো পড়ে নে।
আমি বুঝলাম এইবার আর রক্ষা নাই। ক্রসফায়ার দিয়েই দিবে। কালেমা দোয়া পড়ে নিলাম। স্মরণ করলাম আমার পরিবার কে। তাদের জন্য দোয়া করলাম।
হঠাৎ আমাকে নিয়ে বের হয়ে যাওয়াতে ভাইদের আর বিদায় জানাতে পারলাম না।
গাড়িতে তোলা হলো, আবার গাড়ি চলতে লাগলো। এক ঘন্টা পর গাড়ি থেকে নামানো হলো। আবারো সেই প্রথমদিনের সেলে ঢুকানো হলো। তখনো পর্যন্ত বুঝতে পারিনি সেই সেলটি কোন জায়গায়।দেখলাম যে দুই ভাইয়ের নাম ওরা জিজ্ঞাসা করেছিলো সে জুনিয়র দুইটা ভাইকেও ওরা তুলে এনেছে। ওরাও ছিলো অন্য আয়নাঘরে!! আমাকে একবারের জন্যও বুঝতে দেয়নি, ওরা আমার এই দুই ভাইকেও ধরেছে। এক ভাইকে পাশের সেলেই রাখলো। আরেক ভাইকে অন্য সেলে! নিজেকে তখন ক্রিমিনাল মনে হতে থাকলো। অনুশুচনা করতে লাগলাম কেন তাদের নাম বল্লাম। আমার জন্য তাদের জীবনটাও গেলো।
ঐদিন রাতেই আমরা তিনজন সাথে আমাদেরও আগে তুলে আনা এক মাদ্রাসার ভাইকে , গাড়িতে তোলা হলো। এত রাতে গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে দেখে আমরা সবাই গাবড়ে গেলাম।
কিন্তু আবার আমার নিজের মনে হতে লাগলো আমাদের মে বি ছেড়ে দেবে। গাড়ি চলতে চলতে কিছুক্ষণ পর থামলো, আমি চোখ বাঁধা অবস্হাতেই ফাঁক দিয়ে দেখলাম দেখলাম একটা হোটেলের সামনে, গাড়িটা দাড়িয়েছে। গাড়িটার দরজা খুলে এক সদস্য নামলো। সে দেখলাম হঠাৎ করে চিৎকার দিয়ে উঠলো,”এই জ ঙ্গি ধর, জ ঙ্গি ধর “এই ধর ধর ”
আমি আরো আতঙ্কিত হয়ে গেলাম, মনে করলাম এই গুলি করে দেবে!! কিন্তু চোখের নিচ দিয়ে দেখতে পেলাম হোটেল থেকে চারটা ছেলেকে ওরা ধরে নিয়ে আসলো। গাড়িতে তুল্লো। মনে মনে ভাবলাম সত্যি সত্যি জঙ্গি ধরে আমাদের সাথে হয়তো মিশিয়ে দেবে। গাড়ি দরজা বন্ধ করে দিয়ে, আবারো একিই জায়গাই আসলো। পুরাই ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে গেলাম। কিন্তু দেখলাম যে যে চারটা ছেলেকে তারা গাড়িতে উঠালো, গাড়ি থেকে নেমে তাদের সাথেই দাড়িয়ে তারা আবার গল্প করছে। হাঁসি ঠাট্টা করছে। বুঝতে পারলাম, ওরা আসলে সোর্স ছিলো।
আমি এবার দেখলাম আশপাশে RAB 11 লিখা কিছু গাড়ি। শিওর হলাম প্রথমে এনে তারা এখানেই রেখেছিলো। এবং RAB 11 এর কয়েকজন অতি উৎসাইী ব্যাক্তি এই কাজটি আমাদের সাথে করেছে। যাই হোক …আবারো সেলে ঢোকানো হলো। সবকিছু শান্ত হয়ে আসলে, পাশের জনকে জিজ্ঞাসা করলাম “ছোট ভাই কাহীনি কি ? ছোট ভাই বল্লো “ভাই বুঝলেন না, কেস সাজিয়েছে তারা । আমি জাস্ট কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলাম।এত জঘন্য, জালিম, নিকৃষ্ট RAB এর ঐ ব্যাক্তিগুলো?
এত চোখের পানি ফেল্লাম, তাদের মন গলেনি। আমার ছোট দুই সন্তানের কথা শুনেও তাদের মন গলেনি। আরো মিথ্যা মামলা সাজানোর নাটক করলো? পরের দিন আমাদের চারজনকে সকালে বন আর মিস্টি খাওয়াইয়ে। বের করে আনলো বাইরে। এবার চোখ খোলা, কিন্তু হ্যান্ডকাফ পড়ানো। সামনে দেখলাম সময় টিভিসহ এক ডজন মিডিয়া। তারা হাটতে বল্লো। দুই পাশে দুই RAB সদস্য আমাদের হাঁটাতে থাকলো। হাঁটিয়ে আবারো সেলে ঢোকানো হলো।
আমরা স্তব্ধ হয়ে, নিশ্চুপ থেকে সব দেখে রইলাম। কোন টু শব্দও করলাম না।
সেদিন রাতেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় নারায়ণগন্জের ফতুল্লা থানায়। আমি উদ্গ্রিব হয়ে খুঁজছি একটা ফোন। হঠাৎ পেয়ে গেলাম এক মুরুব্বিকে। তাকে রিকোয়েস্ট করে তার ফোন নিয়ে আমি আমার মাকে কল দিয়ে। ধরে আমার বাবা, “আমি কান্না করে বলি বাবা আমি মাসরুর ”
আমার বাবা হু হু করে কান্না করতে থাকেন!! জিজ্ঞাসা করেন আমি কোথায়, আমি বল্লাম ফতুল্লা থানায়। এক পুলিশ সদস্য এসে ছো মেরে ফোনটি কেড়ে নেয়। অতঃপর পুরো রাত আমাদের থানার গাড়দে রেখে পরের দিন চালান করে দেয় নারায়ণগঞ্জ জেলখানায়।
আর আমাদের নামে মামলা হয় এই বলে যে, “নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকার হোটেলের সামনে গোপন বৈঠকে থানায় নাশকতা পরিকল্পনা করার সময় আমাদের হাতেনাতে ধরে ফেলে RAB 11। তারা প্রমাণ পেয়েছে আমরা জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। আমরা রাষ্ট্রদ্রোহী। আমাদের সাথে পেয়েছে বিভিন্ন জঙ্গি বই। মিথ্যা দিয়ে ভরা, সাংঘর্ষিক বর্ণনার এই মামলা দেখে যে কেও বলে দিতে পারে এটি একটি ভুয়া মামলা।
অতঃপর এই মিথ্যা মামলাতে জামিন ক্যান্সেল হতে হতে জেলখানায় কাটিয়ে দিলাম মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত, প্রায় দশ মাস। দশ দিন ভয়ঙ্কর গুম জীবন, দশ মাসের দুর্বিষহ জেল জীবন এর মুক্তির পর ….আমি এসে দেখি আমার আট মাসের হামাগুড়ি দেয়া ছেলে ইনতিসার দৌড়াচ্ছে। আমার মেয়ে ইয়ামিনা বড় হয়ে গেছে।
সে জেল জীবনের গল্প না হয় আরেকদিন বলবো ….
সংগ্রহ ও সম্পাদনাঃ জামান শামস
লেখকঃ লেখক ও আয়নাঘরের বন্দী
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে- [email protected] ও [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে । আসুন ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।