Ads

টিউশনি কথন

মোঃ আতিকুল ইসলাম

টিউশনি।মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেদের জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার এক হাতিয়ারের নাম।সখ করে নয়, নিতান্ত পেটের দায়েই তারা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস,প্রাক্টিক্যাল শেষে দুপুরের কড়া রোদে বা বিকালে বন্ধু বান্ধবীদের আড্ডা ফেলে শহরের এ মাথা থেকে ঐ মাথা পর্যন্ত দৌড়ায়। এই টিউশনির সাথে মিশে আছে আনন্দ, বেদনা, হাসি, কান্না, শ্রদ্ধা, অশ্রদ্ধা,হিংসা ও ভালবাসার কতনা স্মৃতি। স্মৃতির আয়নায় পিছন ফিরে দেখা সেইসব রাত্রিদিনের কয়েকটি উপাখ্যান।

এক

তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। সপ্তম শ্রেনী পড়ুয়া বাঁধন নামের এক স্কুল বালিকার গৃহ শিক্ষক হিসেবে তাকে গণিত শেখাই। বাঁধনদের বাসার সংস্কারের কাজ শুরু হওয়ায় ওদের পাশের বাসায় ওকে পড়ানো শুরু করলাম। নতুন বাসায় পড়ানো শুরু করার দ্বিতীয় দিন আমাদের পড়ার টেবিলে এসে হাজির হলেন চতুর্দশ বর্ষীয় এক রূপবতী বালিকা। নাম তুলি। বাঁধনের ফুপি। আমার কাছে ত্রিকোনমিতির কিছু অংক বুঝে নিতে চায়, যদিও তার একজন গৃহ শিক্ষক আছেন। অনেকটা দ্বিধার সাথেই তাকে ত্রিকোনমিতির ছবক দেওয়া শুরু করলাম। প্রথম দিনেই বুঝতে পারলাম, এই মেয়েটির মেধা তার রুপের ব্যস্তানুপাতিক। মুখে কথার ফুলঝুরি আর ঠোটের কোণে হাসির ফোয়ারা লেগেই আছে উচ্ছল ঝরনার মত।এরপর প্রায় প্রতিদিনই সে এসে বসে আমাদের পড়ার টেবিলে। কিছুক্ষণ অংক করে, জ্যামিতি বুঝে নেয়ার চেষ্টা করে। ভুল করে বকা শুনেও খিলখিল করে হাসে।একটু পর পড়া রেখে নাস্তা নিয়ে আসে। কোনদিন সিংগাড়া, সামুচা, পিয়াজু। কোনদিন মৌসুমি ফল। কোনদিন নিজের হাতে তৈরি নুডলস বা পিয়াজ, মরিচ, তেল ও চানাচুর দিয়ে মাখানো মুড়ি। যেদিন নিজ হাতে কিছু তৈরি করে সেদিন জিজ্ঞেস করবে, স্যার, আমার হাতে তৈরি নুডলস/ মুড়ি কেমন হয়েছে?
_খুব পঁচা হয়েছে বলতেই বলবে, আপনার মুখের টেস্ট নস্ট হয়ে গেছে। কতজন আমার হাতের নুডলস খেয়ে পাগল হয়ে গেছে। বলতে বলতে হাসির ফোয়ারা ঝরে তার ঠোটের কোণে।
আমি হেসে বলি, আর কোন দিন তুমি আমাকে নুডলস খাওয়াবা না। আমি পাগল হতে চাই না।
এক জ্যৈষ্ঠের দুপুরে পড়াতে গিয়েছি। পড়ানো শেষে ফেরার সময় বাঁধনের মা বললেন, আতিক একটু বস। আম খেয়ে তারপর যাও।
বাধনের মা আম কাটছে আর আমার সাথে গল্প করছে। পাশে বসে আছে বাঁধন ও তুলি।গল্পের এক পর্যায়ে বাঁধনের মা বললেন, তুমিতো আম পছন্দ কর।তাহলে আমের রাজধানী রাজশাহীতে বিয়ে করিও।
আমি বললাম, রাজশাহীর মানুষের আতিথিয়েতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমারও মাঝে মাঝে মনে হয় রাজশাহীতেই বিয়ে করব। কিন্তু আমার বাবা মা আমার জন্য একটি মেয়ে পছন্দ করে রেখেছেন। মেয়েটিকে যে আমারও খুব অপছন্দ সে কথা বলা যায় না। এখন অপেক্ষা শুধু সময়ের। কবে আমার পড়া লেখা শেষ হয়।
কথা গুলো শেষে আড় চোখে তাকালাম তুলির দিকে। সদা হাস্যোজ্জল চাঁদ মুখে কে যেন মেখে দিয়েছে বেদনার ছাপ। ঠোটের কোণ থেকে মিলিয়ে গেছে চিরচেনা সেই হাসির ফোয়ারা। অশ্রু টলমল চোখে সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
এরপর আরো দেড়মাস বাঁধনকে পড়িয়েছি তুলিদের বাসায়। এই দেড়মাসে সে একবারের জন্যও আসে নাই আমাদের পড়ার টেবিলে। নাস্তাতো দূরের কথা খাওয়ায়নি এক গ্লাস ঠান্ডা জল ও।

দুই

মাত্র পাঁচ দিন পর ঈদ। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, আজ ওদের পড়াতে যাব কিনা? ওরা মানে আমার ছাত্র-ছাত্রী, সবুজ ও সাথী। সবুজ অষ্টম শ্রেণীতে আর সাথী একাদশ শ্রেণীতে।খুবই মেধাবী ও দুষ্ট দুই ভাই-বোন। গত পরশু দিন বলেছে, স্যার কাল দিন পর অবশ্যই আসবেন। আমরা আপনার জন্য ঈদ কার্ড বানিয়ে রাখব।
ওদের মায়াভরা আব্দার রাখতেই পড়াতে গেলাম। পড়ানো শেষে সবুজ বলল, স্যার আমাদের জন্য ঈদ কার্ড আনেন নাই? আমিতো ঈদ কার্ড আনি নাই। তোমাদের খাতা দাও। সবুজের খাতায় গোলাপ এবং সাথীর খাতায় রজনীগন্ধার ছবি আঁকলাম। ছবির নিচে লিখলাম ঈদের চিরায়ত শুভেচ্ছা বাণী -“এবারের ঈদ তোমাদের জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ, সুখ ও সমৃদ্ধি এই শুভ কামনায়…
বললাম, তোমাদের কার্ড কই?
সবুজ তার কার্ড তুলে দিল আমার হাতে। আকাশী রংগের খামে মোড়ানো। খাম খুলতেই বের হল দুই ভাঁজ করা কার্ড। উপরে মসজিদ ও চাঁদতারার ছবি।পিছনে পাজামা,পাঞ্জাবি, টুপি পরিহিত ছোট্ট দুইটি শিশুর কোলাকুলি করার দৃশ্য। ভিতরে লেখা- EID MUBARAK to you, Sir.
– Sobuj.
সবুজের কার্ড খামে ভরতে ভরতে বললাম, সাথীর কার্ড কই?
সাথী নীল খামে মোড়ানো একটি কার্ড আমার হাতে দিয়ে বলল-
স্যার, আমার কার্ড মেসে গিয়ে দেখবেন।
সবুজ বলল, তাহলে আমারটা দেখলি কেন? না স্যার, তা হবে না। দেখি আপু কি লিখেছে। সবুজ নাছোড়বান্দা, কিন্ত সাথী তার কার্ড কিছুতেই খুলতেই দেবে না। দুই ভাই-বোনের চেঁচামেচিতে ওদের মা চলে আসলেন। সব শুনে বললেন, সবুজেরটা দেখেসিস, তোর টা দেখাবি না কেন? দেখি কি লিখেছিস ?
না। আমি দেখতে দেব না বলে আমার হাত থেকে কার্ডটি ছিনিয়ে নিল। দুই হাতে দুমরে মুচরে নীল খামে মোড়া কার্ডটিকে একটি কাগজের বল বানিয়ে ফেলল। এরপর ছুড়ে দিল জানালা দিয়ে। কিন্তু জানালার শিকের সাথে ধাক্কা খেয়ে কাগজের বলটি গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। সবুজ দ্রুত সেটি কুড়িয়ে এনে নিপুন হাতে কাগজের বলটিকে আবার কার্ডে রুপান্তর করল। সাথী রুম থেকে পালিয়ে গেল। সবুজ কার্ডটির ভাঁজ খুলল। সাথীর মা, সবুজ ও আমি এই তিনজনের ছয়টি চোখ ভাঁজ খোলা কার্ডে। যেখানে সবুজ জেল পেন দিয়ে লেখা, স্যার, আমি আপনাকে খুব ভালবাসি, খুব।
ঘটনার আকস্মিকতায় থ হয়ে গেলাম আমি। দুই কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে মনে হয়।খেই হারিয়ে বসে পরলাম।
কিন্তু কেন? একজন সুন্দরী ষোড়শী তরুনী আমাকে ভালবাসা নিবেদন করেছে এ জন্য ?
না! আমি তখন খুব করে ভাবছিলাম,এই দামী টিউশনিটা চলে গেলে আমাকে খুব কষ্টে পড়তে হবে, খুব!

তিন

মেরিনা আপা। আমার এক ছাত্রের মা। আমাকে খুব করে ধরলেন তার পরিচিত এক ভাবীর দশম শ্রেণী পড়ুয়া কন্যাকে জীব বিজ্ঞান পড়াতে হবে। হাতে সময় নেই বললেও কয়েকদিনের উপুর্যুপরি অনুরোধে রাজী হলাম। একটি কাগজে উপশহরের একটি বাসার ঠিকানা লিখে দিয়ে আমাকে সেখানে যোগাযোগ করতে বললেন । দুদিন পর বিকেল বেলা সেই বাসায় হাজির হলাম। কলিং বেল চাপতেই মধ্যবয়সী এক ভদ্র মহিলা দরজা খুললেন।মেরিনা আপা আমাকে পাঠিয়েছেন , বলতেই বললেন, ভিতরে আসুন।ভিতরে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই মহিলা এসে আমার সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করলেন।
কোথায় থাকি,কোন বর্ষে পড়ি,আর কয়টি টিউশনি আছে,সপ্তাহে কতদিন পড়াতে পারব,সিজিপিএ কত ইত্যাদি। বাদ গেল না ভাই-বোনের সংখ্যা ও তাদের বৈবাহিক অবস্থাও। নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকার শেষে তিনি আসলেন আসল কথায় মানে বেতন সংক্রান্ত আলোচনায়।
তিনি বললেন- ” আচ্ছা, আমি যদি প্রতিদিন নাস্তা দেই তাহলে বেতন কত দিতে হবে, আর নাস্তা না দেই তাহলে বেতন কত দিতে হবে?”
বেতনের সাথে নাস্তার প্রসঙ্গ আসতেই আমার ব্যাক্তিত্বে আঘাত লাগলো। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, আর যাই হোক এই টিউশনি আমি করাব না। আমি উঠতে উঠতে তাকে বললাম- ” আচ্ছা, আমি যদি বাইরে থেকে নাস্তা এনে আপনার কন্যাকে দিয়ে খাই তাহলে বেতন কত দিবেন, আর যদি না দিয়ে খাই তাহলে বেতন কত দিবেন?”
না… মানে…। আসলে আমি…।
বিব্রত ভদ্র মহিলা কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন।
-না, ঠিক আছে। এখনি বলার দরকার নাই।ভেবে চিন্তে মেরিনা আপাকে জানিয়ে দিলেই হবে। ভদ্রমহিলাকে থামিয়ে দিয়ে আমি বেরিয়ে আসলাম বাসা থেকে। এরা জোঁকের মত শোষণ করে আমাদের। মাসে কতদিন পড়াতে গেলাম সব দাগ দেওয়া থাকে তাদের ক্যালেন্ডারের পাতায়।কয়দিন কত মিনিট কম পড়িয়েছি সব এদের মুখস্থ। শুধু এদের মনে থাকে না, কতদিন বেশি পড়িয়েছি, কতদিন পড়াতে এসেও পড়াতে পারিনি কারন না জানিয়েই তাঁরা গিয়েছেন শপিং করতে বা কারো জন্মদিনের উৎসবে। কেবল বেতনের সময় মনে পড়ে আমরা কবে আসি নাই বা যথাসময়ে আসি নাই।আজ আবার এসেছে নাস্তার প্রশ্ন।
চোখের সামনে ভেসে উঠল, একটু আগে আমার উত্তর শুনে বিব্রত বোধ করা মধ্যবয়সী ঐ ভদ্রমহিলার কাচুমাচু করা মুখখানা।
জোঁকের মুখে নুনের ছিটা দেওয়ার এক অপার্থিব আনন্দে ভরে উঠল আমার হৃদয়ের আঙিনা।

লেখকঃ কলামিস্ট এবং ব্যাংকার

 

আরও পড়ুন