Ads

বিয়ে ও জেনারেশন গ্যাপ

ইমরান হোসাইন নাঈম

বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে বিয়ে। এই কথা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা দ্রুতই বিয়ে করতে চায়। বিশেষ করে দ্বীনের বুঝ পাওয়া ছেলে-মেয়েরা বিয়ের বিষয়ে বেশ আগ্রহী। কেননা তারা হারাম রিলেশনে জড়াতে চান না। হারাম থেকে বাঁচতে চান। জেনারেশন গ্যাপ এর জন্য কিন্তু মুরুব্বীরা বিষয়টা বুঝতে পারেন না। এই বিষয়ে তারা আমাদের ওপর একটু নাখোশও বটে। বিয়ের কথা বললেই তারা বলেন: তোমার বাপও তো এই বয়সে বিয়ে করে নাই। তোমার বয়সই বা আর কতটুকু। পড়ালেখা আরও করে নেও, তারপর বিয়ে। চাকরি করো। নিজের পায়ে দাঁড়াও। ইত্যাদি আরও কত কী!

আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, পরিবারকে বিয়ের কথা বলতে না পারা। ২৩-২৪ বছরের ছেলেদেরকেও দেখা হয় বাচ্চার চোখে। সেই বাচ্চা কীভাবে বিয়ের কথা বলবে! আর বিয়ের কথা বললেও মুরুব্বীরা কেন তার কথায় কান দেবেন— বাচ্চারো তো কত কিছুই বলে!
পরিবারকে বিয়ের কথা কীভাবে বলতে হয়, সেই গল্প এক ভাইয়ের মুখে শুনেছি। উত্তম পুরুষে সেই ভাইয়ের অভিজ্ঞতাটাই শেয়ার করছি।

“আমি যখন বিয়ের কথা বলি, তখন পরিবার কিছুটা ধাক্কা খায়। তারা এতো তাড়াতাড়ি আমার বিয়ে নিয়ে চিন্তা করছিলেন না। আমিও বলতে পারছিলাম না বিয়ের কথা। অথচ আমার প্রয়োজন ছিলো বিয়ের। কিন্তু ভরসা পাচ্ছিলাম না। কারণ পরিবারের বাঁধার কথা মাথায় ছিলো।
বিয়ের কথা বলতে হবে, এই বিষয়টা প্রথমে নিজেকে বোঝালাম। মানসিক প্রস্তুতি নিলাম। তারপর একদিন পরিবারকে জানালাম যে, বিয়ে করতে চাই।
তারা বিষয়টাকে হালকাভাবেই নিলেন প্রথমে। হাঁ বা না কিছুই বললেন না তারা। কিন্তু বারবার বলার পর বাবা-মাকে সম্মত করতে পারি। আমার জন্য মেয়ে দেখবেন, এতুটুকু তারা জানান।

কিন্তু পরিবার বিষয়টা নিয়ে তখনও সিরিয়াস হচ্ছিল না। আমি যখন একবার মুখ ফুটে বলতে পেরেছি যে, বিয়ে করতে চাই। তখন বিয়ের কথা বলার জট ছুটে গিয়েছিল। পরিবারকে তাগাদা দিলাম। মায়ের সাথে কথা বললাম। কিন্তু তবু তারা তেমন সিরিয়াস হচ্ছিলেন না, যেমনটা হওয়া দরকার।
একদিন মা’কে বললাম: আমাকে যদি বিয়ে না করান, তবে আমি যত গুনাহ করবো; তার ভাগিদার হতে হবে আপনাদের। এই কথায় কাজ হয়। তারা তখন সিরিয়াস হন। বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনকে মেয়ে দেখতে বলেন। আত্মীয়রা সাহায্য করা তো দূরের কথা, তারা বরং আমার পরিবারকে আরও অনুৎসাহিত করত। আমার বয়স কম, বলে তারা অবাক হতো বিয়ের কথায়। অথচ বয়স তখন আমার চব্বিশ। এই বাচ্চা ছেলেকে বিয়ে করাবি, ইত্যাদি নানান কথা শুনতে হয়েছে আমার পরিবারকে।

ওদিকে মেয়ে পেলেও তার পরিবারকে রাজি করানো যেত না। কারণ আমার বয়স কম। এই কম বয়সী ছেলে তাদের জামাই হতে পারে না। তাদের চাই ত্রিশের কাছাকাছি বয়সের জামাই।তবে আমি বিয়ের কাজে এক ধাপ এগিয়ে আসতে পেরেছি। কেননা পরিবারকে বোঝাতে পেরেছি যে, আমার বিয়ে করা দরকার।পরিবারকে বোঝানোটাই এখন সবচে’ বড় চ্যালেঞ্জ।”

মুরুব্বীদের ও এই প্রজন্মের মাঝে একটা বড় গ্যাপ তৈরী হয়ে গেছে। তারা ঠিক বুঝতেই পারেন না যে, যুবকরা কেন দ্রুত বিয়ে করতে চায় বা চাইবে!
তাদের প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের সময় তো এমনটা হতো না! আমরা তো এত দ্রুত বিয় করতে চাইতাম না! এই সব ছেলেপিলেদের বাবারাও এতো দ্রুত বিয়ে করে নাই! দ্রুত বিয়ে না করলে কী হয়? বিয়ে বিয়ে করে এখন ছেলেরা যে মাথা খেয়ে নিচ্ছে!

উক্ত প্রশ্ন থেকে তারা একটা ভুল সমীকরণ উপস্থাপন করেন। তারা মনে করেন, বিয়ে করতে চাওয়া ছেলেদের ফাজলামি। পড়ালেখা না করার একটা ধান্দা। বাউণ্ডুলেপনা করবার একটা ফন্দি। তাদের কালেও এমনটা হতো—উড়নচণ্ডি পোলাপানদের তখন বিয়ে করার বাতিকে ধরত।

কিন্তু জেনারেশন গ্যাপ এর কারণে এই মুরুব্বীরা বুঝতে চান না যে, তাদের কাল আর এই কালে কতো পার্থক্য। তারা যে যুগে ও পরিবেশে বড় হয়েছেন, বর্তমানের যুবকরা সেই যুগ ও পরিবেশে বড় হয়নি বা হচ্ছে না। এই যুগটাকে ঠিক মতো পড়তে পারছেন না আমাদের বড়রা। তারা সব কিছুকেই নিজেদের কালের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চান। এবং সেই অনুসারেই ফায়সালা করেন সব কিছুর।

তাদের কালে হলিউড-বলিউড ইত্যাদির এতো ছড়াছড়ি ছিলো না। এখন যেমন বিৃকত যৌনতা সহজলভ্য হয়ে গেছে। তৎকালে তা এতো সহজলভ্য ছিলো না। এখনকার ছেলেরা অল্প বয়সেই নেট দুনিয়ায় বিচরণ শুরু করে। এবং তাদের হাতের কাছেই চলে আসে ভালো-খারাপ সব কিছু। এমন একটা বয়সে তারা এগুলো পায়, যখন ভালোমন্দ বিচার করার মতো বুদ্ধি তাদের থাকে না। নেট দুনিয়া তাদেরকে প্রলুব্ধ করে নিয়ে যায় “অন্ধকার দুনিয়ায়”।
একটা ছেলে যখন ঘুরতে পার্কে যায়, অথবা যায় কোন দর্শনীয় স্থানে, তখন সে দেখতে পায় অজস্র বিকৃতি। ছেলে-মেয়ের অবাধ চলাফেরায় তার আকৃষ্ট হওয়ারই কথা। তার ভেতরে সহজাতপ্রবৃত্তি আছে—যা থাকাটাই স্বাভাবিক। সুতরাং শয়তানের ধোঁকায় সে যে পড়বে না, তার গ্যারান্টি কী? সে-ও যে এক দিন পাপের সাগরে গা ভাসাবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে? আর সে যখন পাপের দরিয়ায় ডুব দেবে, তখন তার দায় ও দায়িত্ব নেবে কে বা কারা?
শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচতেই তার বিয়ে করা উচিত, এই কথাটা মুরুব্বীরা বুঝতে চান না।

মুরুব্বীরা যখন যৌবন পার করছিলেন, তখন তারা এই সব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাননি । আমাদের সাথে তাদের বেশ জেনারেশন গ্যাপ আছে। তারা বেড়ে উঠেছেন আমাদের চে’ও অনেকটা ভালো পরিবেশে। আধুনিক সভ্যতার ভয়াল থাবাটা তখনও ঠিকঠাক পড়েনি। তাদের হাতের মুঠোর মধ্যেই বিকৃত জিনিস সহজলভ্য হয়নি তখনও। তারা নির্মল পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন—অন্তত বর্তমানের চে’ অনেক ভালো অবস্থায় তারা বেড়ে উঠেছেন।

এখন তো ক্লাস সেভেন এইট থেকেই “গার্ল ফ্রেন্ড-বয় ফ্রেন্ড” নিয়ে মেতে ‍ওঠে বাচ্চারা। মুরুব্বীরা কি এইসব কখনও কল্পনাও করতে পেরেছেন? মুরুব্বীরা তো দূর কি বাত! যাদের বয়স এখন ২৫/৩০, তারাও তো এমন পরিবেশে বেড়ে ওঠেননি। বাচ্চাদের এইসব কাহিনী দেখে এরাও লজ্জা পান।

কলেজ-ভার্সিটিতে উঠেও প্রেম করতে না পারাটা এখন রীতিমতো লজ্জার বিষয়। বন্ধুদের সামনে মুখ দেখাবারই জোই থাকে না। হাজার রকমের টিটকারী শুনতে হয়।বিভিন্ন দিবসে সকল বন্ধুরা যখন গফ নিয়ে সেল্ফি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাড়বে, তখন অন্য সিঙ্গেল বন্ধুর কি একটুও মন-কেমন করবে না? সেই মন-কেমন করাটাকে কি দোষ দেয়া যাবে?

ছেলের মেয়ের প্রতি আর মেয়ের ছেলের প্রতি আকর্ষণ থাকাটা সহজাত প্রবৃত্তিরই অংশ। এই প্রবৃত্তিই তাদেরকে টেনে নিয়ে যায় প্রেমের পথে। তো এখন, যে ছেলেটা বা মেয়েটা দ্বীন নিয়ে বাঁচতে চায়, দ্বীনের পথে চলতে চায়, হারাম রিলেশন থেকে রক্ষা পেতে চায়; সে কী করবে? তারও তো মনে চাইতে পারে একজন সঙ্গীর। সে যখন তার বন্ধু বা বান্ধবীকে প্রেম করতে দেখবে, তারও তখন প্রেম করতে মন চাওয়াটাই স্বাভাবিক। এখন সে কী করবে? হালালভাবে তার সহজাত প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ করতে চাওয়াটা কি দোষের? হারামভাবে করলে যদি দোষের না হয়, তবে হালালভাবে করলে কেন দোষ হবে?

মুরব্বীদেরকে এসব কথা চট করেই বলা যায় না। কথার পিঠে কথা বললে কিছু মুরুব্বী খুবই বিরক্ত হন—রাগ দেখান। তারা মনে করেন, আমরা তাদেরকে জ্ঞান দিচ্ছি।তাই দরকার হেকমত।

আমি নিজে, সময় ও সুযোগ বুঝে; কিছু মুরুব্বীকে এসব কথা বলে দেখেছি। কাজ হয়। বাস্তবেই কাজ হয়। বদ্ধমূল চিন্তায় ধাক্কা মারলে তারা একটু হলেও নড়েচড়ে বসেন। নিজে থেকেই তখন নানান প্রশ্ন করেন। সেই প্রশ্নগুলোর জবাব যখন তারা পেয়ে যান। তখন শুভ্রকেশী মাথা দুলিয়ে নীরব সম্মতি জানান।আমাদের কেবল প্রয়োজন হেকমত প্রয়োগ করা।

মুরুব্বীদেরও বা দোষ দেবেন কীভাবে? জেনারেশন গ্যাপ এর জন্য তারা তো এমন যুগের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নাই—যে যুগটা আমরা পার করছি।তাদেরকে যামানার হালহাকিকত বোঝানোর চেষ্টা একেবারে বিফলে যাবে না। শুধু দরকার সতর্কতার সাথে বোঝানো। ধীরে-সুস্থে তাদের বদ্ধমূল চিন্তাধারায় আঘাত করা।
বিয়েকে সহজ করার চিন্তা তখন তারাই করবেন—ইন শা আল্লাহ।

লেখকঃ কলাম লেখক 

আরও পড়ুন-

“বিয়ে ও বোঝাপড়া” বই নিয়ে কিছু কথা

আরও পড়ুন