Ads

শেকড়ের সন্ধানে

ফারহানা শরমীন জেনী

একদিন ছুটি দিও আমায়
হাতে নিয়ে রঙিন নাটাই
উড়াবো আমার স্বপ্ন ঘুড়িটা
নীল আকাশে কাটাবো ছুটিটা।
সেই কবে থেকে তৃণা তার স্বামি সৌরভের দেশের বাড়ি যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে।কিন্তু কিছুতেই ছুটিগুলো সমন্বয় করতে পারছে না। কখনও বড় মেয়ে ফারিহার পরীক্ষা, কখনও বা দুই ছেলে অমি আর সামির পরীক্ষা। কর্তা বাবুর এই নিয়ে আক্ষেপের শেষ নেই। সে তার গ্রামের বাড়ি পরিবার সহ বেড়াতে যেতে ভীষণ গর্ব বোধ করে। বাচ্চার সামনে এবং তার প্রাণপ্রিয় সহধর্মিণীর সামনে পূর্ব পুরুষের গল্প,তাদের রেখে যাওয়া নিদর্শন দেখাতে এবং তা বর্ণনা করতে যেয়ে তার চোখে মুখে ফুটে ওঠে আলাদা উচ্ছ্বাস। যাই হোক এবার ডিসেম্বরে এসে গেল সেই কাঙ্ক্ষিত ইচ্ছে পূরণের ছুটি, সবার একসাথে। বাচ্চাদের মধ্যে কী উচ্ছ্বাস। আর মজার ব্যাপার তৃণার কর্তা বাচ্চাদের নিয়ে রীতিমতো পকেট নোটবুক নিয়ে প্ল্যানিং শুরু করে দিলো।সৌরভের এই ছেলেমানুষি তৃণা বেশ উপভোগ করে।

তৃণার শশুর বাড়ি রাজশাহী। শ্বশুরের পৈতৃক বাড়ি নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলার বড়ালের কোল ঘেষে গড়ে ওঠা গ্রাম ছোট পাঁকায়।অসাধারণ সবুজে ছাওয়া গ্রাম।স্টেশন থেকে নেমে সরিষা বোনা জমির মাঝ বরাবর আইল ধরে হেঁটে যেয়ে পাকা সড়ক। সেখানে একটা ছোট্ট সেতু।সেই সেতুতে দাঁড়িয়ে থাকে ভ্যানগাড়ি। নিজেদের যোগসূত্র ধরে আত্মীয়দের কেউ কেউ ভ্যান চালায়, তাদেরই কেউ না কেউ থাকেই।

আড়ানি হয়ে বাসে যাওয়া যায় কিন্তু বাচ্চাদের এবার শখ তারা ট্রেনে করে যাবে।ট্রেনভ্রমণে তৃণার মনেও আলাদা একটা শিহরণ বয় ।ছোট্ট বেলায় দ্বিতীয় শ্রেণীর বাংলা বইয়ে ট্রেন তৈরির ইতিহাসের ওপর একটা গল্প ছিল। সেইখানে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের একটা ছড়াংশ ছিল তৃণা খুব মজা পেত সেটা পড়তে”ট্রেন চলেছে ঝমাঝম পা পিছনে আলুর দম….!”এছাড়া গভীর রাতের নিস্তরঙ্গ ভেদ করে যখন রাজশাহী শহরের বুক চিড়ে পুঁউউউ ঝিকঝিক শব্দে ট্রেন ছুটে যায় তখন তৃণার মনের মধ্যে একসাথে অনেক ছবি ভেসে ওঠে। হয়ত এই ট্রেনেই আছে কোন নববিবাহিত যুগল যারা আগামীর নতুন স্বপ্ন বোনায় ব্যাস্ত,আছে কোন মানুষ যার খুব নিকটজনের বিয়োগ সংবাদে ছুটছে কেউ বুঝতে পারছেনা তার ভেতরের শূন্যতা হাহাকার,আবার কোন হকার সারাদিনের হকারি শেষে হয়তো খুশি মনে বাচ্চাদের জন্য হাতভর্তি স্বপ্ন নিয়ে ফিরছে ঘরে, তার গিন্নি মাসখানেক পর স্বামী আসার অপেক্ষায় ঘুমহীন চোখে অপেক্ষার প্রহর গুনছে সস্তা প্রসাধনী আর তাতের মূল্যবান চওড়া পাড়ের শাড়ি পরে । আবার এই ট্রেনেই আছে হয়তো এমন পাগল বা অচল যারা মরে গেলে কেউ নেই দাবি করার।হয়তো তাদের লাশ নিয়ে যেয়ে ডোম বিক্রি করবে হাসপাতালের ডিসেকশান রুমে। যাদের শরীর ব্যাবচ্ছেদ করে তৈরী হবে দেশ বরেন্য চিকিৎসক,আবার কেউ বা ঘাপটি মেরে বসে আছে ভদ্রবেশী যাত্রী সেজে ছিনতাই গ্রুপের সদস্য আছে সমাজের সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টিকারি হিজড়ার দল।ট্রেনের শব্দ সবসময়ই তৃণাকে এক কল্পনার জগতে নিয়ে চলে যায় যা যাপিত জীবনের বিভিন্ন শ্রেণির চিত্র ভাবায় এবং জীবনকে তৃণা এভাবেই রেলগাড়ীর সাথে তুলনা করে।

বাচ্চাদের আবদার পূরণে তারা ভোরের মেইল ট্রেন ধরার জন্য খুব ভোরে রওনা হলো স্টেশনের উদ্দেশ্যে। স্টেশনে পৌঁছে দ্রুত টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে বসলো নির্ধারিত আসনে।বসা নিয়ে এক বিড়ম্বনা। তিন বাচ্চাই বসতে চায় জানালার ধারে। শেষে তৃণা একটা সমাধান দিল যে একঘন্টা সময়ে প্রতি বিশ মিনিট একজন করে বসবে জানালার ধারে।তাতে আপাত সমস্যার সমাধান হলো।কুয়াশার চাদর কেটে ছুটে চলেছে ট্রেন।ট্রেন থেকেই দেখা যাচ্ছিল গ্রাম বাংলার শীত নীদ্রার আড়মোড়া ভাঙা আদূরে ভোর।ট্রেন সারদা ছেড়ে ছুটে চলেছে নন্দন গাছির দিকে। অসম্ভব সুন্দর একটা চিত্রে তৃণার নয়ন জুড়িয়ে গেল।সবুজে ঢাকা মাঠের চারিদিকে লাগানো খেজুর গাছে ঝুলে আছে হাঁড়ি।তাতে কাঠি চুঁইয়ে রস পড়ছে।গাছিরা দলবেঁধে সেই হাঁড়ি গাছ থেকে নামাচ্ছে। উত্তরান্চলের খেজুরের রস সারাদেশে খ্যাতি আছে। শীতের পিঠার গুড়ের জোগান সত্তর ভাগ এই উত্তরাঞ্চল থেকেই সরবরাহ হয়।তৃণা বিয়ের পর প্রথম যখন দাদাশ্বশুর বাড়ি যায় সেবার তার চাচাশ্বশুর তাকে পাশে বসিয়ে দেখাচ্ছিলেন কিভাবে রস জাল দিয়ে গুড় হয়।এখন অবশ্য গাছ গাছিদের কাছে চুক্তিভিত্তিক বিক্রি করে দেয়।ট্রেন এসে থামলো নন্দন গাছি স্টেশনে। এখানে ট্রেন থেকে যে হাইস্কুল দেখা যায় একসময় তৃণার বাবা খুব সুপরিচিত শিক্ষক ছিলেন এই স্কুলের। স্টেশনে ঝাল মুড়ি, বাদাম ও চুড়ি ফিতা চিরুনি এসবের হকারেরা তাদের পন্য নিয়ে ট্রেনে ওঠার জন্য দৌড়াদৌড়ি করছে। এই ট্রেন সেই ট্রেন ঘুরে কত দূরদূরান্ত থেকে ফেরত আসবে কিছু স্বপ্ন নিয়ে বউ বাচ্চার জন্য বুক পকেটে করে। ট্রেন আবার চলছে। তিনজন মিলে জানালার ওপর হুমড়ি খেয়ে বুভুক্ষু দৃষ্টিতে দেখছে আবহমান গ্রাম বাংলার শীতের সকাল। একসময় ট্রেন কাঙ্খিত আড়ানী স্টেশনে পৌঁছে গেল।দ্রুত নামতে হবে।তৃণা আর ফারিহা হাত ধরে নামলো আর অমি-সামি ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়ে বাবার সাথে। বড় দুই ছেলেমেয়ের শৈশব কালে প্রায় আসা হতো গ্রামে। মাঝে সাত বছর বিভিন্ন ব্যাস্ততায় আসা হয়নি। যে কারণে ছোট ছেলের মনে বেশ অভিমান জমে আছে।ট্রেন থেকে নেমে ছোট ছেলে সামির উচ্ছাস দেখার মতো। মনে হচ্ছে সে সব চিনে।খরগোশের মতো লাফালাফি যেন খাঁচা থেকে এই মাত্র মুক্ত হয়ে কচি ঘাসের সন্ধান পেয়েছে। বড় দুজন একটু বড়ত্ব ফলাচ্ছে ছোটভাইয়ের ওপর।

পাঁকা গ্রামের পাকা সড়কে উঠতেই দেখা গেল এক দূরসম্পর্কের দেবর মমতাজ দাড়িয়ে আছে। সে দৌড়ে এসে ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়ে ভ্যানে তুলছে আর অন্যদের বলছে “এইডি আমারে বড় ভাইগো,রাসসাই থাহে। বউ ছাওয়াল লিয়ি গাঁয়ে আইসে বেড়াইত। ভাই আইসপেন তে আমাক ফনে আগে থিন জানালে হতোনা?আমি টেশনে বসি থাকতাম। উমা ভাবি কত মুটা হইছেন ভ্যান টানবোনি ক্যামনে?ভাই বিটিত সমত্ত দেখতিসি তা বিটির বিয়ি দিবি লা?ছেলি দুডিত ভালোই ঝাইড়ি উঠিসে?” আনন্দের আতিশয্যে কত কথা যে একসাথে বলে ফেললো উত্তরের অপেক্ষা না করেই।সৌরভ হেসে বললো কথা কম করি ক,নাহলি বড়ালের মধ্যি ভ্যান পড়ি যাবিনি।সৌরভ দেশে আসলে দেশের ভাষায় কথা বলে এবং গ্রামের মানুষের সাথে একেবারে মিশে যায়।

সৌরভ বাচ্চাদের দেখাচ্ছে শীর্ণকায় বড়াল আর বর্ণনা দিচ্ছে এর ইতিহাস ঐতিহ্য আর ভয়াবহতা নিয়ে। তার দাদা-দাদি বানের সময় কি অবস্থায় থাকতো, বানের পানি ভেঙে সৌরভের বাবা স্কুলে যেতো আবার রাত ভর সৌরভের বাবা,চাচা,ফুফা সবাই মিলে মাছ ধরতেন আর সেই মাছ দেখে সৌরভের দাদি আর ফুফুর রাগ আবার রাগের আড়ালে অনুরাগ সবই সুন্দর জীবন্ত বর্ণনা দিচ্ছে। এই বড়াল নদী দিয়ে একসময় বাণিজ্য জাহাজ যেত সে কথাও বলছে। তৃণার ভীষণ ভালো লাগে গ্রামে এসে থাকতে ঘুরতে। ব্যস্ততায় আর সুযোগ হয় কমই।এর মাঝেই পাল পাড়ার বট গাছের কাছে চলে আসলো ভ্যান।এই বটগাছ নিয়ে অনেক গল্প শুনেছে তৃণা তার ছোট চাচা শশুরের কাছে। সবই ভৌতিক।তৃণা আর সেগুলো নিজেও তুললো না সৌরভকেও থামিয়ে দিল।বাচ্চারা ভয় পাবে ভেবে।একসময় ভ্যান ঢাল বেয়ে বাড়ির দিকে নামছে।এই ঢালে আসলেই তৃণার খুব হাসি পায়।বিয়ের পর নতুন অবস্থায় সৌরভ আর তৃণা পড়ে গেছিলো ভ্যান থেকে। সৌরভ পড়েনি কিন্তু নিজে বাঁচতে গিয়ে তৃণা সৌরভকেও টেনে ধরেছিলো।সৌরভের সেকি কপট রাগ।সে গল্প সৌরভ প্রত্যেকবার গ্রামে আসলে ঢালে পৌঁছার আগে বাচ্চাদের কাছে করবে আর মজা নিবে।তৃণা দারুণ অভিমান করে বাচ্চাদের সাথে তার বাবার এই হাসাহাসি নিয়ে। কিন্তু সে অভিমান বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না।আসলে সৌরভ আর তৃণা বর্তমান ছুটে চলা যন্ত্রের যুগে বাচ্চাদের একটা নির্মল প্রাকৃতিক বিশুদ্ধ পরিবেশ চেনাতে চায়,সাথে শেকড়ের কাছাকাছি এনে তার পূর্ব পুরুষের ইতিহাস জানাতে চায়,শেখাতে চায় সামাজিকতা সর্বপরি এমন একজন মানুষ সন্তানদের বানাতে চায় যারা প্রকৃত দেশেপ্রেমী ও উদার মানবিকতা সম্পন্ন হবে।

গ্রামের মানুষের একটা অভ্যাস ভ্যানের শব্দ বা গাড়ির শব্দ পেলে দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখা কে আসলো। সবাই যে যার বাড়ি থেকে বের হয়ে অভ্যার্থনা জানাচ্ছে ।গ্রামের সহজ সরল মানুষ খুব আন্তরিক। তাদের সাথে একটু হেসে কথা বললে সেটাই তাদের সারাজীবনের একটা সঞ্চয়। অবশেষে এসে তৃণার পরিবার পৌছুলো সবুজ ঘেরা বাড়িটায়।
তৃণার ছোট ছেলের আনন্দের সীমা নাই। বাসার সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সকালের নাস্তার আয়োজন করতে। যেহেতু এক ঘন্টার ট্রেন জার্নি এজন্য বাচ্চারা কেউই ক্লান্ত হয়নি।তারা এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে। তৃণার ছোট ছেলে খুব মজা পেয়েছে ছাগলের গায়ে সোয়েটার দেখে।সে ছাগলের বাচ্চা কোলে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে আর বড়ছেলে আর মেয়ে ফটোগ্রাফিতে ব্যাস্ত।

সৌরভের কোন খাবার ভালো লাগে সব ওর চাচির জানা।খোলা চিতায় জ্বাল দেয়া ঘন খেজুর রসে ভিজিয়ে খাওয়ার মজাই আলাদা। সে আয়েশ করে খাচ্ছে। তৃণাও চুলার পারে বসে জায়ের সঙ্গে গল্প করছে আর চিতাই খাচ্ছে। এরই মাঝে গ্রামের সব নিকটস্থ বাড়ির সবাই দেখা করতে আসছে। কথা স্মৃতি চারণ সবই চলছে।বাচ্চাদের বহুকষ্টে ধরে এনে খাওয়ানো হলো।এবার সৌরভ বাচ্চাদের একটা নতুন অভিজ্ঞতা দিতে চায় তা হলো পুকুরে মাছ ধরা।বাড়ির সাথেই পুকুর। সে দক্ষ জেলের মতো পুকুরে জাল ফেললো।পাঙ্গাশ আর খয়রা মাছ উঠলো। বাচ্চারা মাছ ধরা আর জালের মাঝে মাছের লাফালাফি দেখে খুব মজা পেল।

এরপর সৌরভ ওদের নিয়ে বাগানে গেল।তৃণা জানে কিন্তু বাচ্চারাত এই বাগানে সৌরভের দূরন্ত শৈশব সম্পর্কে কিছুই জানে না।সে তার ছেলেবেলায় চাচাদের সাথে চাচাত ফুফাতো ভাই বোনদের সাথে খেলতো আর তার ছোট ফুফু মটরশুঁটি জমি থেকে তুলে মাটির হাড়িতে করে ইট দিয়ে বানানো চুলায় বসিয়ে ফুঁ পাড়তো আর সিদ্ধ করতো। সে বাচ্চাদের এভাবে গল্প করছে মনে হচ্ছে সব দেখতে পাচ্ছে।গল্পগুলো যেন লাফিয়ে লাফিয়ে এক চরিত্র থেকে আরেক চরিত্রে চলে যাচ্ছে।সৌরভের সহজ সরল বাবা একবার কলা গাছ তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন রাজশাহীর বাসায় লাগাবেন তাই।উদ্দেশ্য তার জন্মভূমিতে বেড়ে ওঠা গাছের নিবিড় সান্নিধ্য।কখনও কখনও চোখের কোণ আবেগীয় বাষ্পে ভরে উঠছে।
এগুলো দেখতে দেখতে দুপুর হলো।বাসায় ফিরে আসলো বাগান থেকে। দুপুরে পুকুর থেকে ধরা তাজা মাছের সাথে গরম ভাত আর লাল ঝাল ঝাল ঝোল অসাধারণ। সজনে শাকের ভাজি আর পাঁচফোড়নে বাগাড় দেয়া ডাল।ভাত খেয়ে তৃণার চাচি শাশুড়ীকে বাচ্চারা ধরলো বেড়াতে যাওয়ার জন্য। বিশেষ করে তৃণার মেয়ে। চাচি একটু বিশ্রামের পর ওদের ঘুরিয়ে নিয়ে আসলেন পাড়ার নিকটবর্তী বাড়িগুলোতে।

এরপর তারা যাবে আজিম চাচার নৌকায় শীর্ণকায় বড়ালের বুকে ঘুরতে। চাচা শ্যালো নৌকায় তাদের নিয়ে যতদূর যাওয়া যায় বেড়িয়ে আসলো।নদীর বুকে জীবনের কত রোজ নামচা।কেউ গরু গোসল করাচ্ছে কেউবা বরশী দিয়ে মাছ ধরছে।আবার বাচ্চারা ডিঙি নৌকা বেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুইদিকে ফসলের জমি। কিছু কিছু দূরে বিশাল আমবাগান। যে বাগান গুলোর বয়স কম করেও একশ’রও বেশি। একটা গাছ আরেকটা গাছের সাথে মাথায় মাথায় লেগে ঘন এক বূহ্য তৈরি করেছে।এর মাঝেই বড়ালের পশ্চিম কোণে বিশাল লাল থালার মত সূর্যটা ডুবে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। বাচ্চারা বিপুল আগ্রহে তাকিয়ে আছে সূর্যটা নদীর মধ্যে পড়ে যায় কিনা।ওরা যেহেতু নদীতে আছে এজন্য মনে হলো সূর্য আস্তে আস্তে গাছের ফাঁক গলিয়ে মিলিয়ে গেল দিগন্তে। সামি বারবার মাকে বিরক্ত করছে “মা সূর্য কোন গাছে ঢুকে গেল? কোন গাছে ঘুমাবে? ” ইত্যাদি ।তৃণা বা সৌরভ কেউই বাচ্চাদের এই ধরনের প্রশ্নে বিরক্ত হয় না।কারণ শিশু মনে হাজার প্রশ্ন জাগে এবং এই প্রশ্ন থেকেই তার জীবনের সঠিকটা বেছে নেয় এবং এ ক্ষেত্রে বাবা মা উত্তম বন্ধু।সন্ধ্যার আলো আধারীতে আবারও সৌরভের শৈশব কৈশোরের স্মৃতিকথন মুগ্ধ হয়ে শুনছে তৃণা ও আত্মজেরা।শীতের হিমেল হাওয়া কুয়াশা আর নদীর পানিতে সৃষ্ট তরঙ্গ এক অন্য আবহ তৈরি করেছে। সৌরভ তার দাদির গল্প আত্মজদের কাছে এত জীবন্ত করে বর্ণনা দিচ্ছে মনে হচ্ছে যেন সে তার দাদির ঘটনা সমস্ত চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে আর তার সমস্ত অবয়বে এক স্বর্ণালি অতীত খেলছে। আসলে আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত সন্তানের কাছে তার পূর্ব পুরুষের গৌরবময় গল্প তুলে ধরা।সৌরভ আরও গল্প বলছে তার বাবারা এই নদীতে কিভাবে সাঁতার শিখেছে, তারা ভাই বোনেরা যখন ছুটির সময় আসত তখন এই নদীতে কতটা লাফিয়েছে,সাঁতার কেটেছে তার বর্ণনা। এসব গল্প হতে হতেই নৌকা চলে আসলো নদীর পারে।দূরের ফসলি মাঠ থেকে ভেসে আসছে শিয়ালের চিৎকার যা বাচ্চাদের থেকে তৃণাকেই ভয় পাইয়ে দেয় বেশি। নদীর চরের সরিষা ক্ষেতের একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আলাদা এক ছন্দ সৃষ্টি করেছে।দূরে কোন গাছ থেকে প্যাঁচার তুথুলু মুথুলু টাইপের একটা শব্দ ভেসে আসছে। গ্রামের অন্ধকার স্বর্পিল রাস্তায় চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে। এত সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য শহরে কোথায়? নিয়ণের আলোয় বদলে যাওয়া গাত্র বর্ণ অথবা পদ্মা নদীর ধার ঘেষে সাদা লাইটের আলোয় ঝকমকে চাঁদ নদীর বুকে আঁছড়ে পড়ছে ছায়া হয়ে তা দেখেই শহরবাসী নয়নজুড়ায়।

বাসায় ঢোকার মুখে সুঘ্রাণ ভেসে আসছে রান্নাঘর থেকে বাহারি সব খাবারের আয়োজনের।দেশি মোরগের ভূণা আর কলায় ডালের ঝরঝরে খিচুড়ি সাথে কয়েক বছরের পুরনো আচারের আয়োজন আর বেগুন ভাজা। সব ঘরের মেঝেতে চাচি আর তার পুত্র বধূ মিলে সাজিয়ে রেখেছে। বাচ্চারা খাবারের মৌ মৌ গন্ধে দৌড়ে বাড়ির ভেতরে যেয়ে খাবারের আয়োজনে বসে পড়তে লাগলো, সাথে সাথে তৃণা আর সৌরভ বাচ্চাদের খুব আদরের সাথে কিন্তু আদেশের স্বরে হাত মুখ পা ধোঁয়ার কথা বলা মাত্র বাচ্চারা পরিচ্ছন্ন হয়ে এসে খেতে বসলো।আসলে বাবা মায়ের আদরের সাথে সাথে ডিসিপ্লিন গুলোও শেখানো খুব জরুরী। বাচ্চা হওয়ার আগেই বাবা এবং মা উভয়ের জন্য প্যারেন্টিং কোর্স করানো দরকার।তৃণা এটা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করে কারণ বাচ্চাদের গড়ে ওঠার সময়ই শাসন ও আদর উভয় দিকে কিছু ঘাটতি ছিল বা পদ্ধতিগত ভুল ছিল।

দূরের বাগানগুলো থেকে ভেসে আসছে প্যাচা ও বাদুড়ের ডাক।তৃণার খুব ঘুম পাচ্ছে তাই সে শুয়ে পড়লো। আর বাচ্চারা তাদের চাচাতো ভাই বোনের সাথে খেলতে বসলো লুডু। শৈশবের এই অপার্থিব আনন্দগুলো হয়ে থাকবে তাদের অমূল্য স্মৃতি। এসব ভাবতে ভাবতেই তৃণা তলিয়ে গেল ঘুমের জগতে আর চলে গেল এক স্বপ্নরাজ্যে।প্রায় তৃণা তার পরপারে চলে যাওয়া মায়ের লালন করা এই স্বপটার বাস্তবায়ন দেখে ঘুমরাজ্যের স্বপ্ন জগতে। স্বপ্নটা হলো তৃণা অবসর জীবনের পর প্রত্যন্ত এক সুনিবিড় ছায়া ঢাকা গ্রামে গড়ে তুলেছে এক নারী সচেতনতা মূলক নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র যেখানে নারীরা অক্ষর জ্ঞান শিখবে, সঠিক পদ্ধতিতে কুরআন শিখবে, শিখবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, অধিকার সম্পর্কে জ্ঞান এবং হস্তশিল্পজাত দ্রব্য উৎপাদনের কাজ।আর সাথে তার মাকেও দেখে হাস্যোজ্জল চপল চঞ্চল কর্মব্যস্ত অবস্থায় পরিপাটি সাজে।এই স্বপ্নটা ঘুমের মাঝে সে প্রায়ই দেখে এবং ঘুম ভেঙে স্বাভাবিক জগতে আসতে অনেকটা সময় লাগে।

ফজরের আযানে ঘুম ভেঙে তৃণা নামাজ পড়ে রেডি হলো সৌরভের সাথে ফসলি জমির মাঠগুলো দেখতে যাওয়ার জন্য। এবার পেঁয়াজের দাম পেঁয়াজের ঝাঁজের মতোই ঝাঁজালো ছিল। তাই অনেকটা জমিতে পেঁয়াজ লাগানো আছে। পেঁয়াজের কলিগুলো শিশির সিক্ত তরতাজা হয়ে মাথা উঁচিয়ে দাড়িয়ে আছে। ধানগাছগুলো কুয়াশা ভেদ করে শিশিরস্নাত দেখতে বেশ লাগছে।আজ তারা বাড়ি ফিরে যাবে তাই গোছগাছের জন্য ফিরে আসলো বাড়ি অভিমুখে। এসে দেখে বাড়ির সামনে আঙিনায় চাচি আগুন পোয়ানোর একটা আয়োজন করে খড়ের গাদার সাথে গাছের মরাডাল স্তুপ করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয় আর তার চারিদিকে বুড়ো থেকে শিশু সবাই গোল হয়ে বসে। ছোটদের গলায় চাদর বা লুঙ্গি এক বিশেষ ভঙ্গিতে পেঁচিয়ে পড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর আগুনের উষ্ণতার পরশ পেয়ে শীতকাতুরে মানুষগুলোর মাঝে প্রাণসঞ্চার হয় এবং কর্মোদ্যম ফিরে পেয়ে খেজুরের রস আর মুড়ি খেয়ে লেগে পড়ে কাজে। তৃণা দেখছে তার তিন সন্তানই ঘুম ঘুম চোখে বসে পড়েছে আগুনের পাশে আর উপভোগ করছে এই সবুজ ঘেরা গ্রামীণ জীবনের এক নির্মল আনন্দ।
বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছে রস জ্বাল দিয়ে গুড় বানানোর ম-ম গন্ধ। বাসায় ঢুকে তৃণা দেখলো তার জা মিনা তাদের জন্য খোলা চিতই বানিয়েছে আর রাতেই কিছুটা বানিয়ে রসে ভিজিয়ে রেখেছে। তৃণার মা শহুরে মানুষ হলেও রস চিতই বানাতো অসাধারণ। তৃণা মায়ের বানানো সেই রস চিতইয়ের খুব অভাববোধ করে।
নাস্তা খেয়ে সবার চোখমুখে এক বিষন্নতা যেন আরও কটা দিন থেকে যেতে পারলে খুব ভালো হতো। তাত সম্ভব নয় ছকবাঁধা এই ব্যাস্ত জীবনে। তাই সবার থেকে বিদায় নিয়ে ফিরতেই হলো তাদের। ট্রেন আসলো নয়টার সময় স্টেশনে।ট্রেনে চেপে তরতাজা সবুজের সমারোহ পিছে ফেলে ট্রেন একসময় ঢুকে পড়লো রাজশাহী শহরের কর্মব্যাস্ত নগরজীবনে।দূর থেকে ভেসে আসছে অটোওয়ালার তারস্বরে চিৎকার বা-জা-র!বা-জা-র অথবা ভদ্রা বিনোদপুর। অটোতে উঠে বাড়ি যাওয়ার পথে সজীব মনের ক্লান্ত চোখে দেখতে লাগলো নগর জীবনের প্রতিযোগিতা! এক অটো আরেক অটোকে পিছে ফেলে যাত্রী নেয়ার প্রতিযোগিতা।

লেখকঃ শিক্ষক, সাহিত্যিক ও সহ-সম্পাদক, মহীয়সী

আরও পড়ুন