Ads

সন্তানের মুখ দেখে মায়েরা ভুলে যান সব ব্যাথা

ডাঃ আহমেদ জোবায়ের

২০০৭ সালের মে মাস। দেশে সেনা শাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। একজন বন খেকো, বনের রাজা ওসমান গনির বাসায় বালিশের ভেতর, চাউলের ড্রামে, ওয়ারড্রবে খুঁজে পান কোটি কোটি টাকা। সেই কোটি কোটি টাকায় আয়েশি জীবন ছিলো ওসমান গনির। কিন্তু ওসমান গনির মা ভিক্ষা করতেন। ছেঁড়া কাপড় ছিলো পরনে। দু’ মুঠো ভাত খাওয়ার জন্য তিনি মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পাততেন।
ওসমান গনি কি সুখী হতে পেরেছিলেন?

 

১২ বছর এর সাজা হয় তার। সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়, স্ত্রী-সন্তানরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। আজ ওসমান গনি একা। যেই মা তাকে পেটে ধারণ করলো, জন্ম দিলো, পেলে পুষে বড় করলো, সেই মায়ের খবর না রেখে কতটুকু সুখী হলেন ওসমান গনি। অথচ মাকে আগলে রেখে সুন্দর একটা দুর্নীতিমুক্ত পারিবারিক জীবন হতে পারতো।যখন বন খেয়ে কোটি কোটি টাকা ইনকাম করছিলেন, তখন কি ভেবেছিলেন একদিন এই পরিণতি হবে? মাকে কষ্ট দিলে তার কপালে সম্মান ও সুখ কিছুই জুটে না এটা একটা প্রমাণ।

 

আনেক প্রেগন্যান্ট রোগী আসে এন্টিন্যাটাল কেয়ারে।আমি তাদেরকে অবজার্ভ করি। বাচ্চার একটু মুভমেন্ট কম হলেই মায়েরা অস্থির হয়ে যান।বাচ্চারা যখন মায়ের পেটের ভেতর কিক মারে, তখন মায়েরা অনেক ব্যাথা পান। কিন্তু সুখ পান হৃদয়ে।বাচ্চার লাথি খেতেও এত সুখ তা একজন মায়ের মুখ দেখলেই বুঝা যায়।।

 

একজন নারী যখন মা হয়ে যান, তার সব চিন্তা তখন সন্তানকে ঘিরে।সন্তানের জন্য এত ব্যতিব্যস্ত ও বিভোর থাকেন একজন মা যে তার দুনিয়ার মানচিত্রই পালটে যায়।একটা সন্তান কিভাবে একজন মায়ের জগৎ চেঞ্জ করে দেয় তা ভেবে শিহরিত হই আমি প্রতিদিন।
আমার কাছে যখন মায়েরা উনাদের বাচ্চা নিয়ে আসেন তখন আমি তাদের আবেগ ও অস্থিরতা দেখি।

 

একবার একদিনের একটা বাচ্চার ক্যানুলা করতে গেলাম।বাবা বসে আছেন।কিন্তু মা কেঁদে অস্থির। বাচ্চার একটু কান্নায় মা না কেঁদে পারলেন না। উনার গাল গড়িয়ে অশ্রু পড়ছে। আমি সেই পবিত্র অশ্রুর দিকে তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ।বাচ্চার একটু কষ্ট যিনি সইতে পারেন না তিনি ই মা।

 

মাঝে মাঝে যখন ভর্তি রোগী থাকে, আমি রাতে ফলোআপে গিয়ে দেখি সবাই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে কিন্তু জেগে আছেন মা। তাকিয়ে আছেন স্যালাইনটা ঠিকমত পড়ছে কিনা, একটা পোকা বা মশা যেন বাচ্চাকে না কামড় দেয়। অনেক মাকে দেখি নিবিষ্ট চোখে বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
সন্তানের জন্য মায়ের এই ভালবাসার স্বর্গীয় প্রকাশ আমি খুব আবেগ নিয়ে দেখি আর আমার মাকে মিস করি।
আমার স্পষ্ট মনে আছে আমার হাতে প্রথম ডেলিভারি করানোর কথা।

 

২০১০ এর জানুয়ারি মাস।বিকাল বেলা আমি লেবার রুমে ডিউটিতে। ওই মা-টার বয়স ১৭ বছর। হ্যাংলা পাতলা মেয়ে। ব্যাথার চিৎকারে আমারই কান্না চলে আসছিল।বাচ্চাটার জন্মানোর সময় সেই মাকে ইপিসিওটমি করা লাগলো। যখন বাচ্চাটাকে লেবার রুমের মাসী সেই মায়ের মুখের সামনে ধরলো, মা-টা একটা লাজুক হাসি দিলো যা আজো আমি ভুলতে পারিনি।চোখ গড়িয়ে অশ্রু নামলো কয়েক ফোঁটা। বুঝলাম সুখের অশ্রু। উনার ইপিসিওটমি রিপেয়ার করলাম লোকাল এনেস্থিসিয়া না দিয়েই।বাচ্চাকে দেখার পর একটি বারো উঁহু শব্দ করলো না সেই মা।
সন্তানের মুখ দেখে মায়েরা ভুলে যান সব ব্যাথা।

 

অনেক মায়েরা আমাদের কাছে এসে শুধু অভিযোগ করেন উনাদের বাচ্চারা খায় না। অন্য বাচ্চা এত খায় আমারটা খায় না কেন? খাবারের রুচির ওষুধ দিতে জোরাজুরি করেন।অবাক করা ব্যাপার সেদিন এক মা উনার এক বছর বয়সী বাচ্চাকে নিয়ে আসলেন, উনি আবদার করছেন উনার বাচ্চার রুচি কম, ওষুধ দিতে।আমরা যখন দেখি বাচ্চার বয়সের তুলনার ওজন ঠিক আছে বা বাচ্চাটা নাদুস-নুদুস তখন মুচকি হাসি দিয়ে বুঝাই সেই মাকে।
সন্তান হয়তোবা ছোটখাটো হাতি হয়ে আছে তারপরও মা এর সন্তানের খাবার নিয়ে এমন আকুলতা আমাকে মুগ্ধ করে।

 

একবার ৩০ বছরের এক যুবক আসলো একিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসের ব্যাথা নিয়ে। তীব্র ব্যাথায় ছেলেটি যখন কষ্ট পাচ্ছিল তখন মাকে বলতে শুনলাম, হে আল্লাহ আমাকে দুনিয়া থেকে নিয়ে যাও, বিনিময়ে আমার ছেলেকে সুস্থ করে দাও। শুধু মায়েরাই এমনকরে বলতে পারেন।
২০০০ সালে আমাদের ঘরের সবার চিকেন পক্স হলো। আমার বাবার আর বড় বোনের বেশি হলো বাবার চেহারাই চেনা যাচ্ছিলো না।ব্যাথা,জ্বরে উনি বেহুঁশ হবার উপক্রম। গভীর রাতে আমার দাদী চিৎকার করে কান্না করতে করতে আমাদের ঘরে আসলেন। দাদাভাইকে ধরে কান্না করছিলেন।
বলছিলেন আমার ছেলে মরে যাবে।আপনি কিছু করেন। তখন দাদী আব্বার সুস্থতার জন্য একটা খাসি মানত করলেন আল্লাহ এর কাছে। মা এমনই!
সেই মাকে আমরা ভালো রাখছি কিনা একটা আত্মজিজ্ঞাসা দরকার।
আজ যখন আমরা আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে এত কনসার্ন সেদিন এমনই উদ্বিগ্ন থেকে সেই দিনগুলো পার করেছেন আমাদের মায়েরা।উনারা এখন বৃদ্ধ।বয়স হয়েছে উনাদের। সংসারের কর্তৃত্ব আর নাই। অনেক মা স্বামীকে হারিয়ে অসহায়। নিজের কথা বলার কেউ নেই উনাদের।কে শুনবে উনাদের কথা?

 

সবাই তো ব্যস্ত নিজ জগতে। মা পড়ে থাকেন একা শূন্য ঘরে।অনেক সন্তান আছেন যারা মাকে বুঝেন। মাকে পরম মমতায় আগলে রাখেন। কিন্তু আজকাল মানুষরুপী অমানুষও দেখি প্রায়শই।মা শুয়ে আছেন ভাঙ্গা খাটে,পরনের কাপড়টা মলিন, একটু ফল খেতে ইচ্ছে করে কিন্তু খেতে পাননা।
অথচ সন্তানরা ফুটানি করে বেড়াচ্ছে। দামী জামাকাপড় পড়ে দামী রেস্টুরেন্টে খাচ্ছে গার্লফ্রেন্ড বা স্ত্রী কে নিয়ে।কিন্তু মা এর মেডিসিন কেনার টাকা নেই।
মা অভুক্ত।এমন অমানুষ আমার নিজ চোখে দেখা।

 

আমার মা জীবনে কাপড়ের অনেক কষ্ট করেছেন। এখন আলহামদুলিল্লাহ উনার অনেক কাপড়। প্রতিবারই আমি বাসায় গেলে আড়ংয়ে যাই আম্মার জন্য কাপড় কিনতে। কাপড় কিনে নেওয়ার পর উনি চিল্লাফাল্লা করেন। আব্বার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলেন, দেখেন পাগল ছেলে কতগুলো টাকা অপচয় করে আসলো। উনাকে নিয়ে কিছু কিনতে গেলে উনি সস্তা জিনিস খুঁজেন তাই উনাকে নেই না আমি।
একবার আমি সিলেট আড়ং থেকে দুইটা শাড়ি নিয়ে গেলাম। উনি খুব রাগ করলেন। বিকালে বাসার সবাই ঘুমাচ্ছে। আমার ঘুম ভেঙে গেলো। উঠে দেখি উনি সেই দুইটা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে আয়না দেখছেন উনাকে কেমন লাগছে। আমার মায়ের চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। সেই সুখের অপার্থিব দৃশ্য আজো আমার হৃদয়ে প্রশান্তি জোগায়।

 

অনেক ডিভোর্সি মা আছেন।সন্তান নিয়ে তাদের সংগ্রামটা অনেক বেশি কঠিন। একদিকে তাদের নিজের জীবনে নতুন করে গুছানোর চিন্তা,অন্যদিকে সন্তানের ভবিষ্যৎ ও নিরাপত্তা, এই দুই চিন্তায় সন্তানকেই প্রাধান্য নিয়ে অনেক মা নীরবে সব সয়ে যান।

 

এমন অনেক মায়ের নায়ের নিদারুণ জীবন আমি দেখি। বাবা সন্তানকে ছেড়ে চলে গেছেন, সন্তান প্রতিবন্ধী তাই বাবা আর খবর নেয়না কিন্ত মা সন্তানকে ফেলে নিজ সুখের জন্য চলে যায়না কোথাও।হে মানব সন্তান মা কে ভালবাসো।মা কে আগলে রাখো।মা-ই তোমার জান্নাত।
সহীহ মুসলিমের হাদিসে এসেছে,
একবার হয়রত মুহাম্মাদ (সা.) বলে উঠলেন সেই ব্যক্তি দুর্ভাগা। সেই ব্যক্তি দুর্ভাগা। সেই ব্যক্তি দুর্ভাগা। তিনবার বললেন নবীজী এই কথাটা। তখন উপস্থিত সাহাবীগন জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল,কোন ব্যক্তি দুর্ভাগা।তখন নবীজী বললেন,সেই ব্যক্তি যে বাবা মা দুজনকে বা একজন যে বৃদ্ধ অবস্থায় পেয়েও তাদের সেবা করে জান্নাত নিশ্চিত করতে পারলো না। সেই ব্যক্তিই দুর্ভাগা।

 

আপনি যদি বেহেশতে যেতে চান,তবে মা বাবার সেবা করুন। তাদের পরম মমতায় আগলে রাখুন।মা-বাবাকে আপনি সম্মান করলে দুনিয়া আপনাকে সম্মান দেখাবে।মা-বাবার অসম্মান অযত্ন ও অবহেলা করে কেউ সম্মানিত হয় না,কেউ সুখী হয় না,হতে পারে না।পৃথিবীর সকল মায়ের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।ভালো থাকুক,যত্নে ও সম্মানে থাকুক সকল মা।বাবাদের কথাও ভুলে যাওয়া যাবে না।

 

লেখকঃ কলাম লেখক ও চিকিৎসক
আরও পড়ুন