Ads

স্টকহোম সিনড্রোমঃ অপরাধীর প্রতি সহানুভূতির অদ্ভুত ব্যাধি

ডাঃ আহমেদ জোবায়ের

অপরাধীর প্রতি ভিকটিমের সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠার মানসিক অবস্থাকে স্টকহোম সিনড্রোম বলে।এই Mental state কে কেন স্টকহোম সিনড্রোম বলা হয় তার গল্প শুনুন।

১৯৭৩ সালে যখন চারজনকে অপহরণ করা হয় সুইডেনের স্টকহোমে অবস্থিত একটি ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনায়, তখন পর্যন্ত এর সাধারণ নাম ছিল “Capture bonding syndrome”।দিনটি ছিল ১৯৭৩ সালের ২৩শে অগাস্টের সকাল, স্টকহোমের ব্যাংকটিতে এমন নাটকীয়তার সূত্রপাত হলো যা সারা বিশ্বের খবরের কাগজের প্রথম পাতায় জায়গা করে নিলো এবং মনোবিজ্ঞানের জগতে স্টকহোম সিনড্রোম নামের এক নতুন বিষ্ময়ের জন্ম দিলো।

ব্যাংকে ঢুকে অপরাধীরা তাদের বন্দুক চালিয়ে ঘোষণা করলো যে “The party has just begun”।দুজন ডাকাত তখন পরবর্তী প্রায় ১৩১ ঘন্টার জন্যে চারজনকে জিম্মি করলো, যার মধ্যে তিনজন ছিলো মহিলা এবং একজন পুরুষ।স্টকহোম সিনড্রোম নামটা তখন থেকেই চালু হয় যখন এই চারজন অপহৃত ব্যক্তি মুক্তি পাবার পর অদ্ভুত ব্যবহার করা শুরু করে।

মুক্তি পাবার পর গণমাধ্যমে দেওয়া তাদের সাক্ষাৎকারে বিষয়টি আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, তারা মানসিকভাবে তাদের অপহরণকারীদের সমর্থন করা শুরু করেছেন এবং মনে করছে আইনরক্ষাকারী বাহিনী তাদের আঘাত দেওয়ার চেষ্টা করছে। তারা মনে করতে থাকলো যে, অপরাধীরাই তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে।

তারা শুধু অপরাধীদের কোর্টে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করতে অস্বীকারই করেনি, বরং তাদের মুক্তির জন্য অর্থ সংগ্রহ করা শুরু করে।এমনকি তাদের মধ্যে একজন মহিলা অপহরণকারীদের একজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যান। স্পষ্টভাবে এই ঘটনাটিতে অপরাধীদের সাথে অপরাধের শিকার ব্যক্তিরা মানসিকভাবে আবদ্ধ হয়ে যায়। অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার পর থেকেই আক্রান্ত ব্যক্তির মনের এই অবস্থাকে স্টকহোম সিনড্রোম বলে ডাকা শুরু হয়।

প্যাটি হার্স্ট ছিলো একজন কোটিপতি প্রকাশকের উত্তরাধিকারী। সে অপহৃত হয়েছিলো সিমবায়োনিজ লিবারেশন আর্মি (SLA) নামের একটা গ্রামীণ গেরিলা দল দ্বারা। কিন্তু ঘটনার দু’মাস পরেই তাকে দেখা যায় অপহরণকারীদের সাথেই স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে একটা ডাকাতিতে। এমনকি পুলিশের কাছে ধরা পড়ার পরও সে পারিবারিক পরিচয় গোপন করে এবং নিজেকে একটি মিথ্যা নামে (তানিয়া) পরিচয় দেয়।

আদালতে এক পর্যায়ে যখন SLA এর প্রতি তার সহানুভূতির কথা সে প্রকাশ্যে জানায় তখন ৭ বছরের কারাদন্ডের আদেশও তাকে তার অবস্থান থেকে সরাতে পারেনি। পরবর্তীতে মানসিক অসুস্থতার কথা বলে এফ. লি বেইলি নামের একজন উকিল তার মুক্তির ব্যবস্থা করেন।

২০০২ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে স্টন হর্ণব্যাক নামের আরেকজনকে অপহরণ করা হয়েছিল। দুই বছর পর অপহরণকারীর বাসা থেকে যখন তাকে উদ্ধার করা হয়, তখন দেখা যায় অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সে পালানোর কোনো চেষ্টা করেনি। এমনকি তার কাছে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পর্যন্ত ছিলো।

আরেকজন অস্ট্রিয়ান মেয়ে নাতাশা ক্যাম্পুশ মাত্র দশ বছর বয়সে উলফগ্যাং প্রিকলোপিল এর দ্বারা অপহৃত হয়। প্রায় আট বছর পর সে যখন পালায়, তার অপহরণকারী মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে রেলের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। অন্যদিকে নাতাশা সে মৃত্যুতে শোকার্ত হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে সে তার অপহরণকারী সম্পর্কে লিখেছেন-“আমি তার জন্য অনেক অনেক দুঃখ পাচ্ছি, সে খুব দুখী একটা মানুষ ছিলো।”

১৯৩৩ সালেও এরকম আরেকটা ঘটনা নজর কাড়ে বিশ্বের। ২৫ বছর বয়সী মেরী ম্যাকইলোরী মে মাসের ২৭ তারিখ সন্ধ্যায় যখন তার বাবার বাসায় গোসল করছিলেন তখন হঠাৎ চারজন লোক দ্বারা অপহৃত হন। ওই চারজন লোকের মধ্যে ছিলেন দুই ভাই জর্জ এবং ওয়াল্টার ম্যাকজি। লোকগুলো তালা ভেঙে ঘরে ঢোকে এবং মেরীর জামা কাপড় পরা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় শহর থেকে দূরের এক বাড়িতে এবং তাকে শিকল দিয়ে বন্দি করে রাখা হয়।মেরীর বাবা ধনী রাজনীতিবিদ হওয়ায় অপহরণকারীরা ৬০,০০০ হাজার ডলার মুক্তিপণ চায় এবং পরে ৩০,০০০ হাজার ডলারেই মেরীকে মুক্তি দেয়। পরবর্তীতে অপহরণকারীদের তিনজন ধরা পড়ে এবং আশ্চর্যের বিষয় এই যে, মেরী তখন অপহরণকারীদের পক্ষ নিয়ে বলে যে তারা বন্দিদশায় তার খুবই খেয়াল রাখতো। এমনকি তাদের মধ্যে একজন তাকে ফুলও দেয়। যখন বিচার শেষে তিনজনকে কঠোর শাস্তি দেয়া হয়, মেরী তখন অপরাধবোধে কুঁকড়িয়ে ওঠে। মেরী প্রকাশ্যে তাদের প্রতি সহানুভূতি জানাতে থাকে এবং আদালতকে অনুরোধ করে তাদের শাস্তি কমিয়ে দিতে। পুরো বিচার এবং কারাবাসের সময়টা মেরী ম্যাকজি ভাইদের পাশে থাকে, তাদের সাথে নিয়মিত দেখা করে, এমনকি তাদের জন্যে উপহার পর্যন্ত নিয়ে যেতো।

বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে তার জীবনের বাকি ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে। জীবনের এই কঠিন অগ্নিপরীক্ষা মেরীকে মাল্টিপল নার্ভাস ব্রেকডাউনের দিকে নিয়ে যায়। ১৯৩৯ সালে বাবার মৃত্যুর পর তার মানসিক অবস্থা আরো ভঙ্গুর হয়ে ওঠে। ১৯৪০ সালের ২১শে জানুয়ারি মেরী আত্মহত্যার মাধ্যমে পৃথিবীকে বিদায় জানায়। আর যাবার আগে তার সুইসাইড নোটে লিখে যায়- “আমার চারজন অপহরণকারীই সম্ভবত পৃথিবীতে একমাত্র মানুষ যারা আমায় পুরোদস্তুর বোকা ভাবেনি।”

এবার আসি স্টকহোম সিনড্রোম নিয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত, সাম্প্রতিক এবং আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনায়। ২০০২ সালের ৫ জুন নিজের বাসার শোবার ঘর থেকে অপহৃত হয় মাত্র ১৪ বছর বয়সী এলিজাবেথ স্মার্ট। অপহরণকারী ব্রায়ান ডেভিড মিশেল এবং তার স্ত্রী এলিজাবেথকে বন্দী করে রাখে এবং মিশেল এলিজাবেথকে জোর করে বিয়ে করে ও ধর্ষণ করে। এরপর থেকে প্রায় নয় মাস পর্যন্ত তাকে গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতন করা হতো। কোনো রকম অবাধ্যতা তার জন্যে ভয়ঙ্কর শাস্তি নিয়ে আসতো।

ধীরে ধীরে এলিজাবেথ একজন আদর্শ বন্দীতে পরিণত হয়। অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এলিজাবেথ পরবর্তী নয় বছরে পালানোর কোনো চেষ্টা করেনি। এমনকি একবার রাস্তায় এক পুলিশ অফিসারের সাথে কথা হলেও সে তার আসল পরিচয় দেয়নি। পরবর্তীতে তাকে অপহরণকারীদের থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয় এবং ঘটনার সাত বছর পরে সে অপরাধীদের চিহ্নিত করতে রাজি হলে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়।

হোলি আর্টিজানের নারকীয় জঙ্গি হামলার পর দেখা গেলো আমাদের দেশের একশ্রেণীর মেয়েরা জঙ্গী নিবরাসের প্রতি ক্রাশ খেলো। একজন জঙ্গি যার হাতে মানুষের রক্ত লেগে আছে,যে খুনী, তাকে বিয়ে করার কথাও ভেবেছেন কেউ কেউ।অনেকেই আফসোস করেছেন সেই জঙ্গীর জন্য।একজন ভয়ংকর জঙ্গীর প্রতি মেয়েদের এই সহানুভূতিশীল মনোভাব আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে স্টকহোম সিন্ড্রোমের অন্যতম উদাহরণ ধরা যায়।

স্টকহোম সিন্ড্রোমের ধারণা এখন আর অপহরণ ও মুক্তিপণে সীমাবদ্ধ নয়।ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, নারী নির্যাতন,রাজনৈতিক দ্বন্ধ ও মতবিরোধে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্যায়কারীর প্রতি জুলুমের শিকার হওয়া ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সহানুভূতিশীল আচরণকে স্টকহোম সিন্ড্রোম বলা হচ্ছে আজকাল।

সাম্প্রতিক বসুন্ধরার এমডি এত অপকর্ম করার পরেও, একজন মেয়েকে খুন বা আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার মত জগণ্য অপরাধের পরেও আনভীর সোবহানের প্রতি তার স্ত্রীর সহানুভূতিশীল আচরণ, কিছু চাটার দল সাংবাদিকদের তার কলিজা হিমালয় সমান ভাবা, একজন তার মত ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানে দশ বছর ধরে চাকুরী করে গর্বিত হওয়াকেও স্টকহোম সিন্ড্রোমের উদাহরণ হিসেবে টানা যায়।

যেই লোকটি তার অপরাধের জন্য নিন্দিত ও শাস্তি পাওয়া উচিত এবং তার শাস্তির দাবীতে যারা সোচ্চার হওয়ার কথা,উল্টো তারা তাকে নিয়ে গর্ব অনুভব করছে, তাকে রক্ষায় নানা তদবির করছে,তাদের পত্রিকায় তার নাম নিচ্ছে না, উলটো মৃত মেয়েটির চরিত্রে কালিমা লেপ্টে একজন অপরাধীকে রক্ষায় সচেষ্ট, এই মানসিকতাই স্টকহোম সিন্ড্রোম।

এদের চিকিৎসা হওয়া জরুরী।

লেখক: চিকিৎসক এবং লেখক

আরও পড়ুন